সর্বস্তরে বাংলা ভাষার ব্যবহার রচনা | সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন রচনা

সর্বস্তরে বাংলা ভাষার ব্যবহার রচনা  সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন রচনা
সর্বস্তরে বাংলা ভাষার ব্যবহার রচনা  সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন রচনা

সর্বস্তরে বাংলা ভাষার ব্যবহার রচনা | সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন রচনা

কবি রামনিধিগুপ্ত বলেছেন-

নানান দেশের নানা ভাষা।

বিনে স্বদেশী ভাষা পূরে কি আশা।

মানুষের আবেগ, আনন্দ-বেদনা, ইচ্ছা-আকাঙ্ক্ষা মাতৃভাষার পাশাপাশি মাতৃভাষায় প্রকাশ পায়। একটি জাতির সার্বিক উন্নয়নে সেই জাতির মাতৃভাষার প্রচলন সর্বস্তরে অপরিহার্য।

বাংলা ভাষা

বাংলা আমাদের মাতৃভাষা। এটি প্রাচীনতম এবং ধনী ভাষাগুলির মধ্যে একটি। অনেক বাধা-বিপত্তি ও চড়াই-উতরাই পেরিয়ে ধীরে ধীরে এই ভাষা গড়ে উঠেছে। 

বিভিন্ন সময়ে নানা অপচেষ্টা ও ষড়যন্ত্রের মুখোমুখি হয়েও বাংলাভাষী মানুষের ভালোবাসা ও সততার কারণে বিশ্বে বাঙালি অত্যন্ত সম্মানজনক স্থান পেয়েছে। মাতৃভাষার অধিকার ও সম্মান প্রতিষ্ঠার উৎকৃষ্ট উদাহরণ ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন। ভাষার জন্য আত্মত্যাগের এমন বিরল নজির পৃথিবীর ইতিহাসে নেই।

আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি

বাংলা ভাষা এখন সারা বিশ্বে স্বীকৃত। সারা বিশ্বে এই ভাষার মর্যাদা আজও অব্যাহত রয়েছে। জাতিসংঘে শিক্ষা, বৈজ্ঞানিক ও সাংস্কৃতিক সংস্থা ইউনেস্কোর ঘোষণা অনুযায়ী ২১ ফেব্রুয়ারি বা শহীদ দিবসকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে মনোনীত করা হয়েছে। ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর বাংলা ভাষা ও ভাষা শহীদদের স্মরণে সংগঠনটি এ ঘোষণা দেয়।

নিজভূমে পরবাসী

সারা বিশ্বে এটি শ্রদ্ধেয় ও সম্মানিত হলেও অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় যে বাংলা ভাষা বাংলাদেশ ও বাংলাভাষী জনগোষ্ঠীর কাছে অবহেলিত। গরিব বাংলা অবহেলিত। বাংলার মহান সন্তানদের যে স্বপ্ন বাংলা ভাষার প্রসার ও সর্বস্তরে এর ব্যবহারে রক্ত ​​দিয়েছিল, সে স্বপ্ন আজ ক্রমেই ফিকে হয়ে আসছে। 

ব্যক্তিগত পর্যায় থেকে সরকারি-বেসরকারি অফিস, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, আইন-আদালত, মিডিয়া সর্বত্রই বাঙালি অবহেলিত। শিক্ষায় বাঙালি বিশেষ করে উচ্চশিক্ষায়।

কিন্তু ভাষার দিক থেকে বাংলা অনেক সমৃদ্ধ। তবে বাংলা তার নিজের দেশে বিদেশীর মতো। কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের ভাষায়-

হে বঙ্গ, ভান্ডারে তব বিবিধ রতন;-

তা সবে, (অবোধ আমি!) অবহেলা করি।

গুরুত্ব এবং প্রয়োজনীয়তা

সর্বস্তরে বাঙালির প্রচলন শুধু আবেগের বিষয় নয়, এর সঙ্গে দেশের সার্বিক উন্নয়ন ও অগ্রগতির সম্পর্ক রয়েছে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও সুশাসন নিশ্চিত করতে হলে অফিস, আদালত ও জনভাষার মধ্যে সামঞ্জস্য থাকা প্রয়োজন। 

আদালতের ভাষা বোঝেন না এমন মামলাকারীরা বাড়তি খরচ এবং হয়রানির সম্মুখীন হন, যা ন্যায়বিচারের অ্যাক্সেসকে বাধাগ্রস্ত করে। একইভাবে, জ্ঞানের বই যতই মূল্যবান এবং তথ্যপূর্ণ হোক না কেন বা বিদেশী ভাষায় লেখা হোক না কেন, যদি শিক্ষার্থীর মনে তার মাতৃভাষা থাকে। 

অন্য কথায়, বোঝার জন্য মাতৃভাষা ব্যবহার করতে হবে। স্বনির্ভর ভাষাগোষ্ঠী হিসেবে বিশ্বে একটি শক্তিশালী অবস্থান গড়ে তুলতে বিশুদ্ধ দেশীয় সাংস্কৃতিক চর্চা ও বিকাশ, সর্বস্তরে বাংলা ভাষার ব্যবহার অত্যন্ত জরুরি। 

সর্বোপরি, অল্প-ব্যবহৃত বিশৃঙ্খল বাংলা ভাষাকে পেছনে ফেলে আগামী প্রজন্মের জন্য একটি সমৃদ্ধ ও উন্নত ভাষা রেখে যেতে হলে সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু করার আন্দোলন এখনই বাস্তবায়ন করা উচিত।

সকল স্তরে বাংলা ভাষার ব্যবহার সংক্রান্ত আইন

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারিতে বাংলা একাডেমিতে উদ্বোধনী ভাষণে বলেছিলেন, আমি ঘোষণা করছি যেদিন থেকে আমরা ক্ষমতায় আসব, সেদিন থেকে দেশের সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু করা হবে। 

১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর বাংলা স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা হয়। সংবিধানের 3 অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে "বাংলা সাংবিধানিকভাবে প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা হিসাবে স্বীকৃত", তবে সর্বস্তরে বাংলা ব্যবহারের প্রতি তেমন মনোযোগ দেওয়া হয় না। 

ফলস্বরূপ, 8 মার্চ, 1987 তারিখে "বাংলা ভাষা প্রচার আইন-1987" প্রণীত হয়। ওই আইনের ৩(১) ধারায় বলা হয়েছে, 'এই আইন কার্যকর হওয়ার পর বাংলাদেশের সরকারি দফতর-আদালত, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত, আইন আদালতের প্রশ্নোত্তর ও অন্যান্য আইনি কাজসহ সর্বত্র নথিপত্র ও চিঠিপত্রের কাজ করতে হবে। বাংলায় করা। 

বিদেশী দেশের সাথে যোগাযোগ ব্যতীত অন্যান্য সকল বিষয়ে প্রতিষ্ঠান লিখিত হবে। এই ধারা অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি যদি কোনো কর্মক্ষেত্রে বাংলা ভাষা ব্যতীত অন্য কোনো ভাষায় আবেদন বা আপিল করেন, তবে তা অবৈধ ও অবৈধ বলে বিবেচিত হবে।'' 

এর কাজের পরিধি বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ, স্বায়ত্তশাসিত সংস্থায় সম্প্রসারিত হয়েছে। বৃটিশ যুগ।প্রতিষ্ঠান ও আদালতের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য ইংরেজী আইনকে বাংলায় রূপান্তরিত করতে হবে। এই তৎপরতা কিছু সময়ের জন্য জোরালোভাবে চলতে থাকলেও এক পর্যায়ে এর গতি শেষ হয়ে যায়। আজ তা প্রায় নেই বললেই চলে।

সর্বস্তরে বাংলা ভাষা ব্যবহারে সমস্যা

ব্যক্তি পর্যায়ে থেকে শুরু করে জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে এ ভাষা ব্যবহারযোগ্য। ধ্বনিতাত্ত্বিক দৈন্য কিংবা প্রয়োগিক কোনো সমস্যাও এ ভাষার নেই। কতিপয় সমস্যা লক্ষ্য করা যায়, যা সমাধানযোগ্য যেমন-

বাংলা পরিভাষাগত জটিলতা।

  • মানসম্পন্ন অনুবাদ শব্দ তৈরি ও ব্যবহারে অক্ষমতা।
  • সরকারি কাজে সাধু ভাষার ব্যবহার।
  • আইনি, বৈজ্ঞানিক এবং চিকিৎসা পদ অনুবাদে জটিলতা।
  • উচ্চ শিক্ষায় মানসম্মত বইয়ের অভাব।
  • সাম্রাজ্যবাদী বিদেশী ভাষার আগ্রাসী নখর।
  • মুক্ত বায়ু সংস্কৃতি। বাংলা ব্যবহারে হীনমন্যতা।

সমস্যা সমাধানের জন্য পদক্ষেপ প্রয়োজন

বাংলা ভাষার প্রসারে উদ্ভূত সমস্যা সমাধানে সর্বস্তরে প্রয়াস চলছে। বাংলা একাডেমির উদ্যোগে ইতিমধ্যে বেশ কিছু শব্দভান্ডারের বই প্রকাশিত হয়েছে। আইন, আদালত ও উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে বাংলা ব্যবহারের কার্যকর উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে। 

বাংলা আইন অভিধানটি বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান এবং অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের সম্পাদনায় রচিত। বর্তমান কথোপকথন, সংবাদপত্র এবং পাঠ্যপুস্তক সহ আধুনিক ভাষা প্রায় সর্বত্র ব্যবহৃত হয়। 

সাধু ভাষা এখনও শুধু অফিস-আদালতে ব্যবহৃত হয়। এমন পরিস্থিতিতে কথ্য ভাষা প্রচলিত হয়ে গেলেও বাংলা ভাষার ব্যবহার বাড়বে। সর্বস্তরে বাংলা ভাষার ব্যবহার এবং ভাষার সার্বিক উন্নয়নের জন্য সরকারি-বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। সঠিক উচ্চারণ ও সাবলীলতার পাশাপাশি বাংলা ভাষাকে সর্বস্তরে ছড়িয়ে দিতে এই প্রতিষ্ঠানগুলো নিরন্তর কাজ করে যাচ্ছে।

কিছু দৃষ্টান্তমূলক উদাহরণ

আইনি-আদালতের পরিভাষার জটিলতা সর্বস্তরে মাতৃভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে প্রধান বাধা হিসেবে বিবেচিত হয়। এর জন্য বৈজ্ঞানিক ও চিকিৎসা পরিভাষার অভাবকেও দায়ী করা হয়। 

কিন্তু চীন ও জাপান তাদের লিপির দুর্ভেদ্য ভাষার কারণে উচ্চশিক্ষায় স্থান পেয়েছে। চীন, জাপান, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর এমনকি প্রতিবেশী নেপালেও তাদের নিজস্ব ভাষায় আদালত রয়েছে। 

খোদ বাংলাদেশেই কিছু ভাষাবিদ পণ্ডিত বিচারক আদালতে সম্পূর্ণ বাংলা ভাষা ব্যবহার করে অনন্য নজির স্থাপন করেছেন। মহান ভাষা দিবস উদযাপনের জন্য বিচারপতি এবাদুল হক বাংলাদেশের হাইকোর্টে বাংলা ভাষায় প্রথম রায় প্রদান করেন। 

এরপর বিচারপতি আবদুস সালাম ও বিচারপতি খায়রুল হক বাংলা ভাষায় রায় প্রদান করে হাইকোর্টে বাংলা ভাষার মর্যাদা নিয়ে আলোকপাত করেন। উচ্চ আদালতে বাংলা ভাষায় সর্বোচ্চ রায় প্রদান করে অমর হয়েছেন চট্টগ্রামের সন্তান মাননীয় বিচারপতি আব্দুস সালাম মামুন। 

এছাড়া বিচারপতি মোহাম্মদ হামিদুল হক, বিচারপতি আবদুল আউয়াল, বিচারপতি মোহাম্মদ আবু তারিক, বিচারপতি এস. এম জিয়াউল করিমসহ অন্যদের নাম মনে থাকবে।

বুদ্ধিজীবীদের মতামত ও সুপারিশ

ভাষাবিদসহ দেশের নেতৃস্থানীয় বুদ্ধিজীবীগণ সর্বস্তরে বাংলা ভাষার ব্যবহারে যেসব সমস্যা দেখা দিয়েছে তা থেকে উত্তরণের জন্য দিকনির্দেশনা ও মতামত প্রদান করেছেন। নীচে কিছু সুপারিশ এবং মতামত আছে. অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বাংলাদেশে সর্বস্তরে বাংলা ব্যবহার না হওয়ার জন্য রাজনৈতিক উদাসীনতা এবং সরকারি উদ্যোগের অভাবকে দায়ী করেন। 

তার মতে, স্কুল-মাদ্রাসায় ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষা ব্যবস্থার বিভাজনও সমান দায়ী। তিনি বলেন, এটি নিয়ন্ত্রণে সরকারি পর্যায়ে উদ্যোগ নেওয়া উচিত। মাতৃভাষায় শিক্ষাকে জনপ্রিয় করতে হবে। এক দেশে তিন ধরনের শিক্ষার পরিবর্তে ধনী-গরিব উভয়ের জন্য এক ধরনের শিক্ষা চালু করতে হবে। 

এ ছাড়া বাংলা ভাষায় প্রচুর সাহিত্য রচনা ও গবেষণা করা উচিত যাতে এই ভাষা আরও সমৃদ্ধ হয়। সব ক্ষেত্রেই বাংলা ব্যবহারে সবচেয়ে বড় বাধা হীনমন্যতা। বাংলা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না এমন কিছু নেই। 

তা সত্ত্বেও দীর্ঘ প্রচেষ্টার পরও সব ক্ষেত্রে বাংলা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। এমন মন্তব্য বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খানের। 

আহমদ রফিকের মতে, বাংলা সর্বক্ষেত্রে জনপ্রিয় না হওয়ার জন্য শ্রেণীস্বার্থ দায়ী। ভাষা কনস্টেবল সুফিয়া আহমেদ মনে করেন, বাংলা একাডেমি বা এর মতো প্রতিষ্ঠান যতটা কাজ করা উচিত ততটা কাজ করছে না।

উপসংহার

ভাষা শহীদদের রক্তের মর্যাদা রক্ষা এবং বিশ্বব্যাপী আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মর্যাদা রক্ষায় সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন প্রয়োজন। এর জন্য আপনাকে বেশি কিছু করতে হবে না। শুধু দরকার ভাষার প্রতি একটু ভালোবাসা আর সততা, কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের মতো ফিরে আসতে হবে-

পালিলাম আজ্ঞা সুখে; পাইলাম কালে

মাতৃভাষা রূপ খনি, পূর্ণ মণিজালে।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url
আরও পড়ুনঃ
আরও পড়ুনঃ