সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার বৈশিষ্ট্যসমূহ আলোচনা কর
সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার বৈশিষ্ট্যসমূহ আলোচনা কর |
সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার বৈশিষ্ট্যসমূহ আলোচনা কর
- অথবা, সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার বৈশিষ্ট্যগুলো উল্লেখ কর ।
- অথবা, সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার কী কী বৈশিষ্ট্য রয়েছে? বর্ণনা কর ।
উত্তর : ভূমিকা : যে দর্শনের ওপর ভিত্তি করে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে তা ছিল অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক মুক্তি, মধ্যস্থতাকারী উন্নয়ন দর্শন, যা বিনির্মাণে নিয়ামক ভূমিকায় থাকবে জনগণ।
এ প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের যতগুলো পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা গৃহীত হয়েছে তার মধ্যে সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা অন্যতম।
আর এ সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার মেয়াদ জুন ২০১৬ থেকে জুন ২০২১ পর্যন্ত। সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হলো “প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিতকরণ, নাগরিকের ক্ষমতায়ন ।”
সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার বৈশিষ্ট্য : নিম্নে সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার বৈশিষ্ট্যগুলো তুলে ধরা হলো :
১. সাধারণ নাগরিক সেবা : সাধারণ নাগরিকের সেবা প্রাপ্তির নিশ্চয়তা প্রদান ও সেবা প্রদানের জন্য যুগোপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণ করা সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য।
দেশের সব স্তরের প্রবীণ নাগরিকের জন্য সুযোগ সুবিধা সৃষ্টি এ পরিকল্পনার অংশ। এছাড়াও দেশের সব নাগরিকের জন্য তথ্য ও ইন্টারনেট সেবা প্রদানে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে।
২. জনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা কার্যকর : বাংলাদেশ সরকার জনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা বিধানের জন্য সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় অনেক সুযোগ সুবিধা প্রদান করেছে।
দেশের নাগরিকের জানমালের নিরাপত্তা বিধানে অনেক কার্যকরী ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে যা অত্যন্ত সময়োপযোগী ।
৩. শিল্প ও অর্থনৈতিক সেবাসমূহ : দেশকে ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করার ক্ষেত্রে শিল্প, ও অর্থনৈতিক সেবা নিশ্চিতকরণ সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও চিন্তাশীল পদক্ষেপ।
যা দেশের অভ্যন্তরে শিল্পের বিকাশ ও শক্তিশালী অর্থনৈতিক সেবা প্রকাশে কার্যকরী ভূমিকা পালন করবে।
৪. কৃষিখাতসমূহ সম্প্রসারণ : সরকার কৃষিখাতে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে কৃষিখাতকে দেশের অন্যতম একটি সম্ভাবনাময় খাতে পরিণত করার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেছে সপ্তম পণবার্ষিকী পরিকল্পনার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
সবক্ষেত্রে উৎপাদন বৃদ্ধি যা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে ভূমিকা রাখবে এবং পতিত জমিগুলো সংস্কার পদক্ষেপ গ্রহণ করাসহ কৃষিক্ষেত্রে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ একটি সুচিন্তিত পদক্ষেপ।
৫. বিদ্যুৎ ও জ্বালানিক্ষেত্রে সংস্কার : সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা বাস্তবায়নের প্রধান কার্যক্রম ক্রমবর্ধমান বিদ্যুতের চাহিদার সঠিক যোগান প্রদানের জন্য সরকার বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিভিন্ন পদক্ষেপ হাতে নিয়েছে।
দেশের অভ্যন্তরে বিদ্যুৎ উৎপাদন ২৩ হাজার মেগাওয়াট লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণসহ দেশের মোট এলাকার ৯৬% লোককে বিদ্যুৎ সুবিধা প্রদানের পরিকল্পনা সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার একটি অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য ।
৬. পরিবহণ ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন : সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো পরিবহণ ও যোগাযোগ ব্যবস্থায় উন্নতিসাধন। দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার সাথে ৮৫৬ কি মি. নতুন রেলপথ বিনির্মাণ করা এবং ২০২০ সালের মধ্যে পদ্মা সেতুর কাজ শেষ করা ও ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কাজ করা সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় নতুনমাত্রা যোগ করবে ।
৭. স্থানীয় সরকার ও পল্লি উন্নয়ন : সুবিধাবঞ্জিত জনগোষ্ঠীকে সবরকম সুযোগ সুবিধা প্রদানসহ পল্লি এলাকার বিভিন্ন রকম উন্নয়ন সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
শিক্ষা, বিভিন্ন রকম জনসচেতনতামূলক প্রশিক্ষণ, বিশুদ্ধ খাবার পানি সরবরাহ ও বিভিন্ন সেবামূলক খাতে ব্যাপক উন্নয়নের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে এ পরিকল্পনায়।
৮. পরিবেশগত সুরক্ষা কর্মসূচি : পরিবেশ দূষণ বর্তমানে একটি প্রধান সমস্যা। তাই পরিবেশগত সুরক্ষার বিষয়টিকে সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় খুব গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা হয়েছে। কারণ টেকসই উন্নয়ন বলতে যা বুঝায় তা মূলত পরিবেশের সাথে অত্যন্ত সম্পর্কযুক্ত।
৯. গৃহায়ন ও কমিউনিটি সুবিধাসমূহ : গৃহহীন ও বাসস্থানহীন লোকদের আবাসন সুবিধা প্রদান করার জন্য বিভিন্ন রকম নির্মাণ প্রকল্প গ্রহণ ও তাদের হাতের কাছে সেবা প্রদান কর্মসূচির আওতায় কমিউনিটি সুবিধা প্রদান করা সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার একটি কার্যকর পদক্ষেপ।
১০. সর্বস্তরের মানুষের জন্য স্বাস্থ্য সুবিধা প্রদান : স্বাস্থ্য সুবিধা তথা চিকিৎসাসেবা সবার মৌলিক অধিকার। তাই সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় সকল জনগণের স্বাস্থ্য সুবিধা প্রদানপূর্বক ৫ বছরের নিচের শিশুদের মৃত্যুর হার (প্রতি হাজারে) ৩৭ জনে নামিয়ে আনার জন্য সরকার কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। এছাড়াও মাতৃস্বাস্থ্য ও প্রজনন স্বাস্থ্যের ওপর সরকার গুরুত্ব আরোপ করেছে।
১১. বিনোদন, সংস্কৃতি ও ধর্ম : বিনোদন, সংস্কৃতি ও ধর্ম মানুষের মূল্যবোধ ও নৈতিকতার সাথে সম্পর্কিত। তাই সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় বৈশিষ্ট্যের বিচারে বিনোদন, সংস্কৃতি ও ধর্ম গুরুত্বপূর্ণ।
জাতিধর্মনির্বিশেষে সব মানুষ যেন সব ধরনের সামাজিক বিনোদন ও সংস্কৃতি উপভোগ করতে পারে তা নিশ্চিত করা এ পরিকল্পনার বিশেষ বৈশিষ্ট্য।
১২. শিক্ষা ও প্রযুক্তিক্ষেত্রে উন্নয়ন : শিক্ষা ও প্রযুক্তিক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য।
১০০ ভাগ প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা নিশ্চিতকরণসহ ৬০ ভাগ দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত উন্নীতকরণ, তথ্যপ্রযুক্তির উন্নয়ন ও দেশের মোট জনসংখ্যার মধ্যে ২০ শতাংশকে উচ্চশিক্ষিত করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয় এই পরিকল্পনায় ।
১৩. সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি : সামাজিক সুরক্ষা, নারীর ক্ষমতায়ন, নারী-পুরুষের সমতা, দারিদ্র্য বিমোচন, অবসরকালীন ভাতা প্রভৃতি ক্ষেত্রে উন্নয়ন সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য।
১৪. পরিবেশগত সুরক্ষা কার্যক্রম : পরিবেশগত সুরক্ষা কার্যক্রম সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে স্থান পেয়েছে। পরিবেশবান্ধব উন্নয়ন কর্মসূচিতে পরিবেশের সুরক্ষার বিষয়টি মাথায় রেখেই টেকসই উন্নয়নের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।
১৫. কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও আত্মকর্মসংস্থান বৃদ্ধি : আত্মকর্মসংস্থান বৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির বিষয় সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার ক্ষেত্রে গুরুত্ব পেয়েছে। এই পরিকল্পনার মাধ্যমে দেশের প্রায় ১ কোটি ২৯ লাখ লোকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
১৯ লাখ দক্ষ শ্রমিক দেশের বাইরে ও ১ কোটি ১০ লাখ দেশের অভ্যন্তরে আত্মকর্মসংস্থানের মাধ্যমে এবং কর্মসংস্থানের মাধ্যমে আত্মনির্ভরশীল করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
১৬. রপ্তানি আয় বৃদ্ধি : রপ্তানি আয় ৫৪.১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে উপনীত হওয়ার লক্ষ্যে সরকার সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় রপ্তানি আয়কে ব্যাপক গুরুত্ব দিয়েছে। কারণ রপ্তানি আয় বৃদ্ধি করা সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার অন্যতম লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য।
১৭. বনাণঞ্চলের আয়তন বৃদ্ধি : দেশের মোট আয়তনের মধ্যে শতকরা ২০ ভাগ বর্নাল করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় বনাঞ্চলের পরিমাণ বৃদ্ধির বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা হয়েছে।
১৮. জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার নিয়ন্ত্রণ : বর্তমানে বাংলাদেশের প্রধান সমস্যা জনসংখ্যা সমস্যা। তাই সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্য নির্ধারিত হয়েছে।
১৯. অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিতকরণ : অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে প্রবৃদ্ধির হার নির্ধারণ করা হয়েছে অতি উচ্চমাত্রায় । সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার গড় প্রবৃদ্ধির হার নির্ধারিত হয়েছে ৭.৪ শতাংশ।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, সাতটি পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার মধ্যে সব থেকে তাৎপর্যপূর্ণ পরিকল্পনা হলো সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা।
কারণ এ পরিকল্পনার মাধ্যমে দেশকে নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশ থেকে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করার পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে।
মানব সম্পদ উন্নয়ন, দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে সামাজিক সুরক্ষা প্রদান, টেকসই উন্নয়নের মাধ্যমে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা, তথ্যপ্রযুক্তির উন্নয়ন ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধি করে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার বিষয়টি এ পরিকল্পনার অন্যতম লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য।