চতুর্থ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য আলোচনা কর
চতুর্থ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য আলোচনা কর |
চতুর্থ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য আলোচনা কর
- অথবা, চতুর্থ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য কী কী?
- অথবা, চতুর্থ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার প্রধান প্রধান লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বর্ণনা কর।
উত্তর : ভূমিকা : বাংলাদেশের তৃতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার মেয়াদ ১৯৯০ সালের জুন মাসে শেষ হয়। মেয়াদ শেষে দেখা যায় যে, তৃতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার অধিকাংশ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা সম্ভব হয়নি।
অতীতের সমস্যা দূরীভূত করে নতুন আঙ্গিকে ১৯৯০ সালে বাংলাদেশের চতুর্থ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা প্রণীত হয়।
যদিও বাংলাদেশের ইতিপূর্বে তিনটি পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার ন্যায় দারিদ্র্য দূরীকরণ, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন, মানবসম্পদ উন্নয়ন, কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন ইত্যাদি একই মৌলিক উদ্দেশ্য ছিল এ পরিকল্পনায়। তথাপি এ পরিকল্পনা অধিক কার্যকরী করার প্রত্যয় ব্যক্ত হয় ।
চতুর্থ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা : বাংলাদেশের চতুর্থ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার মেয়াদ শুরু হয় ১৯৯০ সালের জুলাই মাস থেকে এবং এর মেয়াদ শেষ হয় ১৯৯৫ সালের জুন মাসে। পাঁচবছর মেয়াদি এ পরিকল্পনায় মোট ব্যয়বরাদ্দের পরিমাণ ছিল ৬৭,২৩০ কোটি টাকা।
তন্মধ্যে সরকারি খাতে মোট ব্যয়বরাদ্দের পরিমাণ ছিল ৪০,৭৩০ কোটি টাকা যা মোট ব্যয়ের ৬০.৫৮% এবং বেসরকারি খাতে মোট ব্যয়ের পরিমাণ ধার্য হয় ২৬,৫০০ কোটি টাকা যা মোট ব্যয়ের ৩৯.৪২%।
বাংলাদেশের চতুর্থ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় ৩৪,৫৫০ কোটি টাকা এবং বৈদেশিক উৎস হতে ৪৪ শতাংশ বা ২৭,৪৫০ কোটি টাকা সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা স্থির করা হয়।
বাংলাদেশের চতুর্থ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় বিশেষত কৃষি, পানি সম্পদ ও পল্লি উন্নয়ন খাতে সর্বোচ্চ বরাদ্দ দেওয়া হয়।
চতুর্থ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য : নিম্নে চতুর্থ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যসমূহ তুলে ধরা হলো :
১. অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতি ত্বরান্বিতকরণ : বাংলাদেশের চতুর্থ পদাবার্ষিকী পরিকল্পনার অন্যতম লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতি ত্বরান্বিত করা। এ পরিকল্পনায় মৌলিক অর্থনীতির সমস্যা সমাধানের জন্য বেশকিছু কৌশল অবলম্বন করা হয়।
সাধারণ ও বিশেষ কৌশলের মাধ্যমে অর্থনৈতিক গতি সঞ্চার করাই ছিল চতুর্থ পণ্যবার্ষিকী পরিকল্পনার অন্যতম লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য।
২. দারিদ্র্য বিমোচন : চতুর্থ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় দারিদ্র্য বিমোচনের ওপর অধিক গুরুত্বারোপ করা হয়। এ পরিকল্পনায় গ্রামীণ ও শহরের দারিদ্র্যপীড়িত অবহেলিত জনগোষ্ঠীর দারিদ্র্য বিমোচনে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিভিন্ন সহায়তা প্রদান কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। এ লক্ষ্যে মানব সম্পদ উন্নয়নের ওপর বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করা হয়।
৩. অর্থনীতিকে চাঙাকরণ : চতুর্থ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় অর্থনীতিতে দক্ষতার সংস্কৃতি প্রবর্তনের ব্যবস্থা করা হয়। এ লক্ষ্যে কারিগরি উন্নয়ন, মানব সম্পদ উন্নয়ন, প্রশাসনিক ও ব্যবস্থাপনাগত উন্নয়ন প্রভৃতি ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে অর্থনীতিকে চাঙা করার পদক্ষেপ গ্রহণ করার লক্ষ্যমাত্রা প্রণীত হয়।
৪. কৃষির আধুনিকীকরণ : বাংলাদেশের চতুর্থ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় কৃষি আধুনিকীকরণের মাধ্যমে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির ওপর পুরুত্ব আরোপ করা হয়।
১৯৯০-৯৫ পরিকল্পনার আমলে কৃষি খাতে শতকরা বার্ষিক ৩.৬ ভাগ প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করা হয় । এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনকল্পে চতুর্থ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় মোট ব্যয়বরাদ্দ ধরা হয় ১৮,২৩৩ কোটি টাকা।
৫. বেকারত্ব দূরীকরণ : চতুর্থ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় বেকারত্ব দূরীকরণের লক্ষ্যে বেশকিছু কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে ফলমূল চাষ, বনায়ন, শাকসবজি, খাল খনন প্রভৃতি কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। তবে এক্ষেত্রে জনশক্তি রপ্তানির বিষয়টিও বিশেষ পুরুত্ব পায় ।
৬. শিল্পায়ন : চতুর্থ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় শিল্পায়নের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করা হয়। এ লক্ষ্যে শিল্পায়ন প্রক্রিয়া জোরদার করা এবং ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্পের সম্প্রসারণ ঘটানোই ছিল এ কর্মসূচির প্রধান উদ্দেশ্য। পাশাপাশি এক্ষেত্রে শিল্পখাতে রপ্তানি বৃদ্ধি করাও ছিল চতুর্থ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার অন্যতম লক্ষ্য।
৭. জিডিপির হার বৃদ্ধিকরণ : বাংলাদেশের চতুর্থ পদ্মবার্ষিকী পরিকল্পনায় মোট GDP এর অংশ এমনভাবে বৃদ্ধি করা হয়। যাতে দরিদ্র ও অসুবিধাগ্রস্ত শ্রেণি উপকৃত হয়। এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনকরে মোট জিডিপির অংশ হিসেবে শতকরা ১৭.৬৪ ভাগ . বিনিয়োগের লক্ষ্যমাত্রা স্থির করা হয়।
৮. সঞ্চয় বৃদ্ধিকরণ : এ পরিকল্পনার অন্যতম লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হলো সঞ্চয় বৃদ্ধি করা। এ লক্ষ্যে বিনিয়োগ বৃদ্ধি, সঞ্জয় বৃদ্ধি, অতিরিক্ত রাজস্ব আয় সৃষ্টি করে কর কাঠামোর সংস্কারসাধনই ছিল এ পরিকল্পন র প্রধান লক্ষ্য। ১৯৯০-৯৫ এ পরিকল্পনা আমলে অভ্যন্তরীণ সঞ্চয়ের হার শতকরা ৭.১ ভাগ অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা ধার্য হয়।
৯. বৈদেশিক সাহায্যের ওপর নির্ভরশীলতা হ্রাস : এ পরিকল্পনার অন্যতম লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হলো বৈদেশিক সাহায্যের ওপর নির্ভরশীলতা হ্রাস করা। ১৯৯০-৯৫ এ সময়।স্তে বাংলাদেশের বৈদেশিক নির্ভরশীলতার হার শতকরা ৪৪ ভাগে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা স্থির করা হয়।
পাশাপাশি এ পরিকল্পনায় উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে দেশীয় সম্পদের উৎপাদন বৃদ্ধি ও স্বনির্ভরতা অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত হয়।
১০. সামাজিক নিরাপত্তা : বাংলাদেশের চতুর্থ পণবার্ষিকী পরিকল্পনায় সামাজিক নিরাপত্তার বিষয়টি বিশেষভাবে স্থান পায় । এ লক্ষ্যে মানব সম্পদ উন্নয়ন, সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা, নিরক্ষরতা দূর, সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার, অভ্যন্তরীণ সম্পদের যোগান বৃদ্ধি প্রভৃতি লক্ষ্যমাত্রা স্থির করা হয়।
১১. প্রাকৃতিক সম্পদ বৃদ্ধিকরণ : এ পরিকল্পনার আমলে বিদ্যুৎ, গ্যাস ও প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর শতকরা ১২.৪২% প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করা হয়। এ লক্ষ্যে সর্বমোট এ খাতে ৮,৩৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয় ।
১২. সেবাখাত : বাংলাদেশের চতুর্থ পণবার্ষিকী পরিকল্পনায় ফিজিকেল প্ল্যানিং গৃহনির্মাণ ও পানি সরবরাহের ওপর ইতিবাচক গুরুত্ব প্রদান করা হয় । সেবামূলক এ খাতের সামগ্রিক উন্নয়নে সর্বমোট ৭,৪৫৫ কোটি টাকা বরাদ্দ হয় যা মোট বায়ের ১১.০৯%।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, বাংলাদেশের চতুর্থ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বিশেষ প্রশংসার দাবিদার ।
কিছু কিছু ক্ষেত্রে এসব লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হলেও সামগ্রিকভাবে চতুর্থ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনাটি অতীতের পরিকল্পনার মতোই অধিকাংশ ক্ষেত্রে নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে।
তবে সর্বোপরি এ পরিকল্পনায় বেসরকারি খাতের ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর উজ্জ্বল সম্ভাবনা লক্ষ করা যায়।