বাংলাদেশের স্থানীয় সরকারের পরিকল্পনা প্রণয়নের সমস্যাসমূহ আলোচনা কর
বাংলাদেশের স্থানীয় সরকারের পরিকল্পনা প্রণয়নের সমস্যাসমূহ আলোচনা কর |
বাংলাদেশের স্থানীয় সরকারের পরিকল্পনা প্রণয়নের সমস্যাসমূহ আলোচনা কর
- অথবা, বাংলাদেশের স্থানীয় সরকারের পরিকল্পনা প্রণয়নের সমস্যাসমূহ বর্ণনা কর।
- অথবা, বাংলাদেশের স্থানীয় সরকারের পরিকল্পনা প্রণয়নের সমস্যাসমূহ ব্যাখ্যা কর।
উত্তর : ভূমিকা : যেকোনো দেশের গণতন্ত্রের পূর্বশর্ত হচ্ছে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা শক্তিশালী হওয়া। বাংলাদেশে যেহেতু প্রতিনিধিত্বমূলক শাসনব্যবস্থা সেহেতু স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাও প্রতিনিধিত্বমূলক।
১৯৭১ সালের পর থেকে সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত বাংলাদেশে সংসদীয় শাসনব্যবস্থা থাকলেও বিভিন্ন অবস্থায় শাসনতন্ত্র পরিবর্তন ঘটে যা স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকে প্রত্যক্ষভাবে প্রভাবিত করেছে।
এ ব্যবস্থায় রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, সামাজিক প্রেক্ষাপট, বৈশ্বিক রাজনীতি এবং আর্থিক অবস্থাও প্রভাবক হিসেবে দেখা যায়।
যাই হোক সরকার এ ব্যবস্থাকে সফল করার জন্য যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল তার ব্যত্যয় ঘটাকে পরিকল্পনা প্রণয়নের সমস্যা বলা হয়। এ সমস্যা কখনো এককভাবে কখনো দলীয়ভাবে আবার কখনো জাতিগত দ্বন্দ্বের কারণে ঘটে থাকে।
বাংলাদেশের স্থানীয় সরকার পরিকল্পনা প্রণয়নের সমস্যাসমূহ: যেসব সমস্যার কারণে বাংলাদেশের স্থানীয় সরকার পরিকল্পনা প্রণয়নে বাধার সম্মুখীন হয় তা নিম্নে আলোচনা করা হলো :
১. কাঠামোগত সমস্যা : স্থানীয় সরকারকে পিরামিড আকৃতির গঠন হিসেবে দেখা যায়। কিন্তু প্রত্যেকটি গঠনে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জন্য সংরক্ষিত কোনো আসন নেই।
যদিও পার্বত্য চট্টগ্রামে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় নৃগোষ্ঠীদের আলাদা ব্যবস্থা আছে। কিন্তু যারা বাংলাদেশে বিশেষ করে উপজাতি অধ্যুষিত এলাকায় বসবাস করে তাদের জন্য আলাদা কোনো ব্যবস্থা নেই।
২. জনগণের অসচেতনতা : স্থানীয় সরকারের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পূর্বশর্তই হচ্ছে স্থানীয় জনগণের সচেতনতা। কিন্তু বাংলাদেশের স্থানীয় পর্যায়ের জনগণ নিরক্ষর, অশিক্ষিত থাকার ফলে সরকারের প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড সম্পর্কে সচেতন নয়। ফলে স্থানীয় সরকারের পরিকল্পনা প্রণয়নে সমস্যার সৃষ্টি হয়।
৩. আধুনিক শিক্ষার অভাব : সরকার কর্তৃক আধুনিকভাবে শিক্ষার প্রচলন প্রসার ও প্রচার না করলে ভোটাররা ভোট সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখতে পারে না।
ফলে নির্বাচিত চেয়ারম্যানরা সরকারের গৃহীত পদক্ষেপ কিংবা পরিকল্পনা বাস্তবায়নে হিমশিম খায়। তাই শিক্ষার অভাব থাকাটা পরিকল্পনা প্রণয়নে দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা।
৪. রাজনৈতিক কোন্দল : বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর ভিতর রাজনৈতিক কোন্দল প্রকট আকার ধারণ করছে। দলগুলোর ভিতরে নেতাকর্মীদের হিংসাত্মক মনোভাবের কারণে সরকারের গৃহীত পরিকল্পনা প্রণয়নে সমস্যা হয়।
৫. বিরোধীদলের অনড় অবস্থান : সরকার সংসদে স্থানীয় সরকার বিষয়ক আইন বা নিয়ম নীতি পাস করতে গেলে বিরোধী সাংসদরা ব্যাপক বিরোধিতা প্রদান করে।
ফলে একটি সুষ্ঠু আইন পাস করতে পারে না সরকার। আর আইন পাস করতে না পারায় স্থানীয় সরকারের পরিকল্পনা প্রণয়নে সমস্যা হয় ।
৬. সংবাদপত্রের ভূমিকা : স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় আইন প্রণয়নের পূর্বে সরকার বিভিন্ন মহলে আলোচনা চলাকালে কিছু কিছু সাংবাদিক এমনভাবে প্রচার করে যা স্থানীয় লোকজনের কাছে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। ফলে এক ধরনের সমস্যা সৃষ্টি হয় । তাই পরিকল্পনা প্রণয়নে সাংবাদিকতা প্রকট সমস্যা।
৭. আঞ্চলিক কোম্পল : বাংলাদেশে বিভিন্ন অঞ্চলগুলোর মাঝে আঞ্চলিক কোন্দল আছে। যেমন পার্বত্য চট্টগ্রামে লোকজনের সাথে উত্তরাঞ্চল কিংবা দক্ষিণাঞ্চল বা পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের সংস্কৃতিক ভিন্নতা আছে।
তাই সবার জন্য একই স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা প্রযোজ্য নয়। এটিও স্থানীয় সরকারের পরিকল্পনা প্রণয়নে একটি সমস্যা।
৮. প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ : বাংলাদেশ সরকার এখনো ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। বিকেন্দ্রীকরণ ব্যবস্থা থাকলে কেন্দ্রীয় সরকার নীতি প্রণয়ন করে তা হস্তান্তর করত।
কিন্তু প্রশাসনিকভাবে বিকেন্দ্রীকরণ না থাকায় স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা সুষ্ঠু পরিকল্পনা প্রণয়নে সমস্যার সম্মুখীন হয় ।
৯. লালফিতার দৌরাত্ম্য : স্থানীয় সরকার পরিকল্পনা প্রণয়নে অন্যতম সমস্যা হচ্ছে আমলাদের লালফিতার দৌরাত্ম্য। এটির কারণে স্থানীয় পর্যায়ের সেবাসমূহ সহজেই জনগণের দোরগোড়ায় যাচ্ছে না। এটি একটি অন্যতম সমস্যা।
১০. মূলধনের অভাব : অর্থনীতিই হচ্ছে সকল পরিকল্পনার মূল। বাংলাদেশে অর্থনৈতিক অবস্থা নাজুক তাই স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা পরিকল্পনা প্রণয়নে মারাত্মকভাবে সমস্যার সম্মুখীন হয়। ফলে দেশের অভ্যন্তরীণ সঞ্চয় অনেক সময় পরিকল্পিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ব্যর্থ হয়।
১১. উপযুক্ত তথ্য ও পরিসংখ্যানের অভাব : সঠিক তথ্য ও পরিসংখ্যানের অভাবে কোনো পরিকল্পনা প্রণয়ন সম্ভব হয় না। স্থানীয় পর্যায়ে সঠিক তথ্য সংগ্রহ করা কঠিন ভাই সরকার পরিকল্পনা প্রণয়নে বড় ধরনের সমস্যায় পড়ে।
১২. জনগণের জীবনযাত্রার মান উন্নত নয় : স্থানীয় জনগণের জীবনযাত্রার মান অনুন্নত থাকার কারণে পরিকল্পনা প্রণয়ন সম্ভব নয় । জনগণের স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বাসস্থান, চিকিৎসা উন্নত না হলে স্থানীয় সরকার পরিকল্পনা অগ্রসর হতে পারে না। এ অবস্থা বাংলাদেশের অঞ্চলভেদে হয়।
১৩. বিশেষজ্ঞের অভাব : যেকোনো পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য দক্ষ পরিকল্পনাকারীর গুরুত্ব অপরিসীম। কিন্তু বাংলাদেশের স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় দক্ষ বিশেষজ্ঞের অভাব পরিলক্ষিত হয়। তাই দক্ষ বিশেষজ্ঞের অভাবে বাংলাদেশের স্থানীয় সরকারে পরিকল্পনা প্রণয়নে সমস্যার সৃষ্টি হয়।
১৪. দুর্নীতি : বাংলাদেশে সব সেক্টরে দুর্নীতি রন্ধ্রে রন্দ্রে ঢুকেছে। স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় সরকারি কর্মচারী থেকে শুরু করে দলের নেতাকর্মীরাও দুর্নীতি করে থাকে।
ফলে সব ধরনের পরিকল্পনা প্রণয়নে সমস্যার সম্মুখীন হয়। তাই দুর্নীতিকে পরিকল্পনা প্রণয়নে সবচেয়ে বড় সমস্যা হিসেবে দেখা হয় ।
১৫. প্রাকৃতিক দুর্যোগ : বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। এদেশে প্রায়ই প্রত্যেকটি অঞ্চলই বর্ষাকালে প্লাবিত হয়। এছাড়াও বিভিন্ন রোগের মহামারি আকার, ঘূর্ণিঝড়, ভূমিকম্প, নদীভাঙন ইত্যাদির কারণে সরকারের বরাদ্দকৃত অর্থ বাস্তবায়ন সম্ভব নয়।
তাই স্থানীয় সরকার অন্য খাতে বরাদ্দকৃত অর্থ ব্যয় করে থাকে। ফলে সরকার সুষ্ঠুভাবে পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে পারে না। তাই প্রাকৃতিক দুর্যোগ একটি বড় সমস্যা।
১৬. পরিকল্পনাকারীদের অদক্ষতা : স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় পরিকল্পনাকারীরা যদি অদক্ষ হয় তবে সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করে। বর্তমান বাংলাদেশে অযোগ্য, অদক্ষ, আমলাতান্ত্রিকতার কারণে পরিকল্পনা প্রণয়নে ভুল-ত্রুটি দেখা যায়।
তাই পরিকল্পনাকারীদের অক্ষমতা, অদক্ষতা, অযোগ্যতা হচ্ছে সকল সমস্যার মূল। এসব সমস্যার কারণে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার পরিকল্পনা প্রণয়নে সমস্যা দেখা যায়।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিত বলা যায় যে, বাংলাদেশ স্বাধীনতার পর নানা চড়াই-উতরাইয়ের মাঝে বর্তমান বিশ্বে উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হয়েছে।
বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে স্থানীয় সরকারের সমস্যাগুলো মোকাবিলার মাধ্যমে এক সুষ্ঠু অবস্থানে আছে।
সুতরাং দলমত নির্বিশেষে সবাইকে গণতন্ত্রের স্বার্থে স্থানীয় সরকারকে এক শক্তিশালী অবস্থানে দাঁড় করাতে হবে। আর সেটি সম্ভব সুষ্ঠু পরিকল্পনা এবং এর বাস্তবায়নের মাধ্যমে।