বাংলাদেশের প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য আলোচনা কর
বাংলাদেশের প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য আলোচনা কর |
বাংলাদেশের প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য আলোচনা কর
- অথবা, বাংলাদেশের প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার উদ্দেশ্যসমূহের বিবরণ দাও।
- অথবা, বাংলাদেশের প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা কী? এর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যসমূহ ব্যাখ্যা কর ।
উত্তর : ভূমিকা : প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের প্রাথমিক উন্নয়নের মডেলস্বরূপ । যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও পুনর্গঠনের জন্য ১৯৭৩ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সরকারের পক্ষ থেকে একটি পরিকল্পনা কমিশন গঠন করা হয়।
প্রথম এ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় দারিদ্র্য বিমোচন, জাতীয় পুনর্গঠন, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের উৎপাদন বৃদ্ধি, বৈদেশিক বাণিজ্যের ওপর নির্ভরশীলতা হ্রাস, বৈজ্ঞানিক কৃষি পদ্ধতি প্রবর্তন, জনসংখ্যার বৃদ্ধি হ্রাস, সেবামূলক প্রবৃদ্ধি হ্রাস প্রভৃতি বিষয় ফুটে ওঠে।
বাংলাদেশের প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা : স্বাধীনতা সংগ্রামে জয়লাভের পর বাংলাদেশের অর্থনীতি চরম বিপর্যস্ত অবস্থার সম্মুখীন হয়ে পড়ে। দেশের অর্থনীতির পুনর্গঠন ও দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্যে ১৯৭৩-'৭৮ প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা প্রণীত হয় ।
মন্ত্রিসভার অনুমোদনক্রমে ১৯৭৩ সালের ১ জুলাই হতে প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার কার্যক্রম শুরু হয় এবং ১৯৭৮ সালের ৩০ জুন এ পরিকল্পনার মেয়াদ শেষ হয়।
এ পরিকল্পনায় মোট বরাদ্দ ছিল ৪,৪৫৫ কোটি টাকা এই পরিকল্পনায় সরকারি খাতের ওপর বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করা হয়।
প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় সরকারি খাতে মোট বরাদ্দের পরিমাণ ছিল ৩,৯৫২ কোটি টাকা, যা মোট বরাদ্দের শতকরা ৮৮.৭ ভাগ।
বেসরকারি খাতে বরাদ্দের পরিমাণ ধরা হয় ৫০৩ কোটি টাকা, যা মোট বরাদ্দের শতকরা ১১.৩ ভাগ। প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার আর একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো অভ্যন্তরীণ সম্পদের ওপর অধিকতর গুরুত্বারোপ।
যা মোট আয়ের ৬০ ভাগ এবং বাকি ৪০ ভাগ বৈদেশিক উৎস হতে সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করা হয়। প্রথম এ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে বাংলাদেশ অত্যন্ত দ্রুততার সাথে পরিকল্পিত উন্নয়নের পথে অগ্রসর হয়।
বাংলাদেশের প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য : বাংলাদেশের প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার উল্লেখযোগ্য লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যসমূহ নিম্নে তুলে ধরা হলো :
১. দারিদ্র্য মুক্তকরণ : দেশকে দারিদ্র্যের অভিশাপ থেকে মুক্ত করে কর্মহীন মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা, আয়ের সুসম বণ্টন, জাতীয় আয়ের যুক্তিসংগত পরিমাণ বৃদ্ধি, অধিক কর্মসংস্থান সৃষ্টি প্রভৃতি ছিল এ পরিকল্পনার মৌলিক লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ।
২. জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ : প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার হ্রাসের ক্ষেত্রে গুরুত্বারোপ করা হয়। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি গ্রহণের মাধ্যমে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার শতকরা ৩ ভাগ থেকে কমিয়ে ২.৮ ভাগে নামিয়ে আনার লক্ষ্য নির্ধারিত হয়।
৩. রপ্তানি বৃদ্ধি : এ পরিকল্পনায় উৎপাদন কাঠামোর পরিবর্তন আনয়নের মাধ্যমে প্রচলিত ও অপ্রচলিত উভয় প্রকার দ্রব্যের রপ্তানির বৃদ্ধির ওপর বিশেষ দৃষ্টিপাত করা হয়।
পাশাপাশি কৃষি, শিল্প ও অন্যান্য ক্ষেত্রে উৎপাদন বৃদ্ধি করে জাতীয় পুনর্গঠন কাজের ধারা বজায় রাখা ছিল এ পরিকল্পনার অন্যতম লক্ষ্য।
৪. অর্থনীতির পুনর্গঠন : পরিকল্পনার অন্যতম লক্ষ্য হলো যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতির দ্রুত পুনর্গঠনের মাধ্যমে কৃষি ও শিল্পখাতে উৎপাদন ১৯৬৯-৭০ সালের পর্যায় উন্নীত করা।
৫. জাতীয় উৎপাদন বৃদ্ধি : প্রথম পঞ্চবার্ষিকী এ পরিকল্পনায় মোট জাতীয় উৎপাদন (GDP) শতকরা বার্ষিক ৫.৫ ভাগ হারে বৃদ্ধি করার নিশ্চয়তা ধার্য হয় ।
৬. জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন : প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার অন্যতম লক্ষ্য ছিল নিত্যপ্রয়োজনীয় অন্ন, বস্ত্র, চিনি প্রভৃতি ভোগ্যসামগ্রীর উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে জনগণের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন।
পাশাপাশি শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসগৃহ, পানি সরবরাহ প্রভৃতি খাতগুলোর উন্নয়নের মাধ্যমে জনসাধারণের কর্মদক্ষতা বৃদ্ধি।
৭. অর্থনৈতিক উন্নয়ন : এ পরিকল্পনায় দেশের সব অঞ্চলের মধ্যে আয় ও কর্মসংস্থানের সুযোগের সুসম ও ব্যাপক সম্প্রসারণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত হয়। সম্পদের সুসম বণ্টনের মাধ্যমে অর্থনৈতিক উন্নয়নসাধনই ছিল এ পরিকল্পনার প্রধান উদ্দেশ্য।
৮. মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি : জনগণের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের লক্ষ্যে প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার আমলে মোট মাথাপিছু আয় ২.৫ ভাগ হারে বৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় ।
৯. বৈদেশিক বাণিজ্যের ওপর নির্ভরশীলতা হ্রাস : বাংলাদেশের প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার অন্যতম লক্ষ্য ছিল বৈদেশিক বাণিজ্যের ওপর নির্ভরশীলতা হ্রাসের মাধ্যমে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন।
এ লক্ষ্যে জাতীয় সম্পদ সুসংহত করে আত্মনির্ভরশীলতা অর্জনের মাধ্যমে বৈদেশিক সাহায্যের ওপর নির্ভরশীলতা হ্রাস করা।
১০. বেকার সমস্যার সমাধান : প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার গুরুত্বপূর্ণ একটি লক্ষ্য হলো বেকার সমস্যার সমাধান। এ পরিকল্পনার ফলে ৪১ লাখ বেকারের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত হয় ।
১১. দ্রব্যমূল্যের স্থিতিশীলতা : এ পরিকল্পনার অন্যতম লক্ষ্য হলো দ্রব্যমূল্যের দাম স্থিতিশীল রেখে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম কমিয়ে আনা। তাই পরিকল্পনা প্রণয়নের প্রাথমিক পর্যায় থেকে শেষ পর্যন্ত মূল্যস্তরের ওপর সতর্কতা অবলম্বন করা হয়।
১২. সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক কাঠামো : দেশে সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক কাঠামো গড়ে তোলার লক্ষ্যে গৃহীত সব ব্যবস্থাকে আরও সুসংহত করা ছিল অন্যতম একটি লক্ষ্য।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারমূলক পরিকল্পনা।
যদিও এর আগে বাংলাদেশে ১৯৭২-৭৩ সালে একটি বার্ষিক পরিকল্পনা (Annual planning) প্রণীত হয়েছিল তথাপি প্রথম পদ্মবার্ষিকী পরিকল্পনা ছিল বাংলাদেশ গড়ার প্রাথমিক প্রচেষ্টা।
এ পরিকল্পনায় বেশ কয়েকটি খাতের ওপর বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করা হয়। তন্মধ্যে কৃষি, শিল্প, প্রাকৃতিক সম্পদ, সেবা খাত অন্যতম ।