বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিকল্পনার প্রধান সমস্যাসমূহ আলোচনা কর

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিকল্পনার প্রধান সমস্যাসমূহ আলোচনা কর
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিকল্পনার প্রধান সমস্যাসমূহ আলোচনা কর

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিকল্পনার প্রধান সমস্যাসমূহ আলোচনা কর

  • অথবা, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সমস্যাসমূহ আলোচনা কর ।
  • অথবা, বাংলাদেশের উন্নয়ন পরিকল্পনার দোষত্রুটিগুলো চিহ্নিত কর।

উত্তর : ভূমিকা : কোনো দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য গৃহীত সুচিন্তিত ও সুপরিকল্পিত কর্মসূচিই হলো অর্থনৈতিক পরিকল্পনা। 

বর্তমান বিশ্বের প্রত্যেকটি দেশই অর্থনৈতিকভাবে নিজেদের উন্নয়ন প্রত্যাশা করে। বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ । 

এদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং গৃহীত পরিকল্পনা বাস্তবায়নের যথাযথ পূর্বশর্তসমূহ বিদ্যমান না থাকায় অর্থনৈতিক পরিকল্পনাসমূহ বাস্তবায়নে নানাবিধ সমস্যাসমূহ দেখা দিচ্ছে ।

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিকল্পনার প্রধান সমস্যাসমূহ : নিম্নে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিকল্পনার প্রধান সমস্যাগুলো আলোচনা করা হলো :

১. তথ্য ও উপাত্তের অভাব : কোনো পরিকল্পনা প্রণয়ন ও তা বাস্তবায়নের জন্য সঠিক তথ্য ও উপাত্ত প্রয়োজন । সঠিক তথ্য-উপাত্ত উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের অন্যতম নিয়ামক হিসেবে কাজ করে। 

কিন্তু বাংলাদেশে নির্ভরযোগ্য ও পর্যাপ্ত পরিসংখ্যান এবং তথ্য-উপাত্তের যথেষ্ট অভাব রয়েছে। যার কারণে অর্থনৈতিক পরিকল্পনা বারবার ব্যাহত হচ্ছে।

২. সৎ ও দক্ষ প্রশাসনের অভাব : বাংলাদেশের প্রশাসনের রন্দ্রে রন্দ্রে দুর্নীতি ঢুকে গেছে। দুর্নীতিমুক্ত ও দক্ষ প্রশাসন হলো সব পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য অপরিহার্য বিষয়। 

কিন্তু অধিকাংশ অনুন্নত দেশের মতো বাংলাদেশের প্রশাসনিক কাঠামো অদক্ষ, অসৎ ও দুর্বল হওয়ায় উন্নয়ন পরিকল্পনা যথাযথভাবে সফল হয় না।

৩. মূলধন সংস্থানের অনিশ্চয়তা : বাংলাদেশের স্বপ্ন আয় ও সঞ্চয়ের জন্য অভ্যন্তরীণ মূলধন গঠনের হার খুবই কম। অন্যদিকে, বিদেশ থেকে পাওয়া ঋণ ও বৈদেশিক সাহায্যের ক্ষেত্রেও ঘাটতি ও অনিশ্চয়তা বিরাজমান। প্রয়োজনীয় মূলধনের অভাবে আমাদের উন্নয়ন পরিকল্পনা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে।

৪. বিশেষজ্ঞের অভাব : সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের জন্য দক্ষ বিশেষজ্ঞের প্রয়োজন। কিন্তু আমাদের দেশে এ ধরনের বিশেষজ্ঞের যথেষ্ট অভাব রয়েছে। 

দেশীয় পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য বিদেশ থেকে বিশেষজ্ঞ আনা হয়। কিন্তু তারা দেশের বাস্তব অবস্থার সাথে পরিচিত না হওয়ায় পরিকল্পিত পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হচ্ছে না।

৫. দক্ষ শ্রমিকের অভাব : দক্ষ শ্রমিকের অভাবে দেশের অর্থনৈতিক পরিকল্পনাগুলো সঠিকভাবে বাস্তবায়িত করা যাচ্ছে না। বাংলাদেশে শিক্ষার যথেষ্ট সুযোগ সুবিধার অভাবে দেশের জনশক্তির দক্ষতা ও কারিগরি জ্ঞান খুবই নিম্নমানের। যার দরুন পরিকল্পিত কর্মসূচি বাস্তবায়নে ত্রুটি ও সমস্যা দেখা দেয় ।

৬. রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা : যেকোনো দেশের অর্থনৈতিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পূর্বশত হলো সেখানকার রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। 

যার ফলে দেশে হরহামেশা অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি হয়। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার ফলে দেশের পরিকল্পনাগুলো যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হয় না।

৭. গণসহযোগিতার অভাব : শিক্ষার অভাব ও বিভিন্ন সামাজিক প্রতিষ্ঠানের প্রতিকূলতা প্রভৃতির কারণে বাংলাদেশের বিপুলসংখ্যক জনগণ রক্ষণশীল ও উন্নয়নবিমুখ। 

এজন্য দেশের জাতীয় অর্থনৈতিক পরিকল্পনায় দলমতনির্বিশেষে সবার সহযোগিতা পাওয়া যায় না বলে পরিকল্পনার সুষ্ঠু বাস্তবায়ন হয় না।

৮. শিক্ষার উপযুক্ত কাঠামোর অভাব : উপযুক্ত নৈতিক ও কারিগরি শিক্ষা কাঠামোর অভাবে দেশে সৎ ও দক্ষ প্রশাসক শ্রেণির সৃষ্টি হয় না । 

এছাড়া সুশৃঙ্খল ও কুশলী কর্মীবাহিনীও গড়ে উঠেনি। এসবের অভাবে এবং জনগণের নৈতিক মানের অবনতির ফলে দেশের পরিকল্পনাগুলো সফল হয় না।

১. অবাস্তব ও উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা : বাংলাদেশে গৃহীত উন্নয়ন পরিকল্পনাগুলো লক্ষ করলে দেখা যায় যে, এ পরিকল্পনাগুলো সম্পদ ও বাস্তব অবস্থার সাথে অনেকাংশে সামঞ্জস্যহীন এবং কিছুটা উচ্চাভিলাষী। 

যার কারণে পরিকল্পনামাফিক কাজ শুরু করার পর এর আকৃতি ও প্রকৃতি পরিবর্তন করা হয় ফলে কাঙ্ক্ষিত পরিকল্পনার বাস্তবায়ন হয় না। 

১০. বৈদেশিক মুদ্রার অভাব : অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করার জন্য প্রচুর পরিমাণ কাঁচামাল ও যন্ত্রপাতি বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। 

কিন্তু প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রার অভাবে এসব কাঁচামাল ও যন্ত্রপাতি আমদানিতে সক্ষম হয় না । ফলে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে অর্থনৈতিক পরিকল্পনাগুলো বাস্তব রূপ পায় না।

১১. মুদ্রাস্ফীতি : মুদ্রাস্ফীতি দেশের অর্থনৈতিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নে বাধার সৃষ্টি করে। আমাদের দেশের অর্থনৈতিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নের প্রধান সমস্যা হলো মুদ্রাস্ফীতি। মুদ্রাস্ফীতির কারণে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে অস্থিতিশীল অবস্থার সৃষ্টি হয়।

১২. অসম প্রতিযোগিতা : বর্তমানে আন্তর্জাতিক অর্থব্যবস্থায় অসম প্রতিযোগিতার ব্যাপক প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। যার কারণে বাংলাদেশের ন্যায় উন্নয়নশীল দেশগুলো আন্তর্জাতিক বাজারে নিজেদের পণ্য নিয়ে বেশিদিন টিকে থাকতে পারে না। এরূপ অবস্থায় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যায় এবং পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সরকারকে হিমশিম খেতে হয়।

১৩. দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধি : ছোট আয়তনের দেশ হিসেবে বাংলাদেশের জনসংখ্যা অনেক বেশি। বলতে গেলে এখানে জনসংখ্যার বিস্ফোরণ ঘটেছে। 

এসব বাড়তি জনসংখ্যার খাদ্যঘাটতি পূরণের জন্য সরকারকে প্রতিবছর লক্ষ লক্ষ টন খাদ্যশস্য আমদানি করতে হচ্ছে। ফলে উন্নয়ন পরিকল্পনাগুলো ব্যাহত হচ্ছে।

১৪. মিশ্র অর্থনীতি ব্যবস্থা : বর্তমান বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সরকারি খাতের পাশাপাশি বেসরকারি খাতও বিদ্যমান। এসব বেসরকারি খাত নিয়ন্ত্রণের জন্য আর্থিক রাজস্ব ও বাণিজ্য নীতি যথাযথভাবে কার্যকর হয় না। 

এসব বেসরকারি খাতগুলো কর ফাঁকিসহ বিভিন্ন ধরনের অনিয়ম করে আসছে। ফলে দেশীয় পরিকল্পনার সুষ্ঠু বাস্তবায়ন হচ্ছে না ।

উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, উপরোল্লিখিত বিষয়াবলি ছাড়াও বাংলাদেশের জনসংখ্যা বিস্ফোরণ, মুদ্রাস্ফীতি, বৈদেশিক সাহায্যের ওপর নির্ভরতা, পশ্চাৎপদ সামাজিক অবকাঠামো প্রভৃতি সমস্যা দেশের অর্থনৈতিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশের পরিকল্পনার সুষ্ঠু বাস্তবায়নের জন্য এসব সমস্যা সমাধান করতে হবে। 

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url
আরও পড়ুনঃ
আরও পড়ুনঃ