বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিকল্পনার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যসমূহ বিস্তারিত আলোচনা কর

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিকল্পনার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যসমূহ বিস্তারিত আলোচনা কর
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিকল্পনার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যসমূহ বিস্তারিত আলোচনা কর

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিকল্পনার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যসমূহ বিস্তারিত আলোচনা কর

  • অথবা, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিকল্পনার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যসমূহ আলোচনা কর।
  • অথবা, অর্থনৈতিক পরিকল্পনার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যসমূহ আলোচনা কর।

উত্তর : ভূমিকা : পরিকল্পনা ছাড়া কোনো কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পাদন করা সম্ভব নয়। কেবলমাত্র সুষ্ঠু পরিকল্পনার মাধ্যমে কোনো কাজে সাফল্য আসতে পারে। 

বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ। এদেশের অর্থনীতিতে অর্থনৈতিক পরিকল্পনার গুরুত্ব অপরিসীম। বাংলাদেশে নানাবিধ সমস্যা বিদ্যমান। 

দারিদ্রা বেকারত্ব, খাদ্যঘাটতি, ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা সমস্যাসহ প্রভৃতি সমস্যা সমাধানে বর্তমানে বাংলাদেশ সরকার যুগোপযোগী পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে।

অর্থনৈতিক পরিকল্পনার সংজ্ঞা : সাধারণত কোনো দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য গৃহীত সুচিন্তিত ও সুপরিকল্পিত কর্মসূচিকে অর্থনৈতিক পরিকল্পনা বলা হয়।

প্রামাণ্য সংজ্ঞা :

অর্থনীতিবিদ মিসেস বারবারা উটন (Mrs. Barbara Utton) বলেছেন, “কোনো সরকারি কর্তৃপক্ষ কর্তৃক সুচিন্তিত ও সুবিবেচিত অর্থনৈতিক গুরুত্বাবলির নির্বাচনকেই অর্থনৈতিক পরিকল্পনা বলে।"

অধ্যাপক হায়েক (Prof. Hayek) বলেন, “কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষ কর্তৃক উৎপাদন কার্যাবলি নিয়ন্ত্রণ করাকেই অর্থনৈতিক পরিকল্পনা বলে।”

অর্থনীতিবিদ রবিনসন (Prof. Robinson) এর মতে, “উৎপাদনে সরকারি নিয়ন্ত্রণকে পরিকল্পনা বলা হয়।”

অধ্যাপক ডারবিন (Prof. Darbin) এর মতে, “নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক কার্যাবলি পছন্দ ও বাছাই করে কার্যাবলি সম্পাদন করাকে অর্থনৈতিক পরিকল্পনা বলে।”

অধ্যাপক টিনবারজন (Prof. Tinbergen) এর মতে, "পরিকল্পনা হলো রাষ্ট্র দ্বারা দেশের অর্থনৈতিক জীবনের সর্বাত্মক নিয়ন্ত্রণের জন্য সর্বাত্মক প্রস্তুতি।”

বাংলাদেশে অর্থনৈতিক পরিকল্পনার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যসমূহ : নিম্নে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিকল্পনার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যসমূহ বিস্তারিত আলোচনা করা হলো :

১. জনগণের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন : দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পূর্বশর্ত হলো সেখানকার জনগণের জীবনযাত্রার মান উন্নত করা। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিকল্পনার অন্যতম লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হলো জনগণের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন করা। 

এ লক্ষ্যে সরকার সম্প্রতি বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। যেমন— দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নত করার জন্য একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্প, কাজের বিনিময়ে খাদ্য (কাবিখা) পরিকল্পনায় অনেক সুফল বয়ে এনেছে।

২. অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা : অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ছাড়া কোনো দেশ উন্নয়নের পথে হাঁটতে পারে না। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিকল্পনার অন্যতম লক্ষ্য হলো অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা আনয়ন করা। 

এজন্য সরকার কতিপয় উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। যেমন— উৎপাদন খাত জোরদার, অধিক পরিমাণ আমদানি নির্ভরতা কমানো, রপ্তানিমুখী পণ্য উৎপাদন ইত্যাদি। 

৩. জাতীয় আয়ের সুসম বণ্টন : জাতীয় আয়ের সুসম বণ্টনের মাধ্যমে যেকোনো দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন সাধন করা সম্ভব। 

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিকল্পনার অন্যতম লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হলো জাতীয় আয়ের সুসম বণ্টনের মাধ্যমে জাতীয় উন্নয়ন সাধন করা । 

বর্তমান সরকার জাতীয় আয়ের বিরাট অংশ উন্নয়নমূলক কাজে ব্যয় করছে। ফলে দেশে সুসম উন্নয়ন হচ্ছে।

৪. অপচয় রোধ : যথাযথ পরিকল্পনাই পারে কোনো কাজে অপচয় রোধ করতে ও সঠিকভাবে কাজ সম্পাদন করতে। অপচয়ের কারণে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড ব্যাহত হয়। 

সম্পদের সঠিক ব্যবহার ও অপচয় রোধ করা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিকল্পনার অন্যতম লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য।

৫. শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়ন : শিক্ষা হলো কোনো জাতির উন্নতি সাধনের মূলমন্ত্র। বাংলাদেশ সরকার শিক্ষার উন্নয়ন ও প্রসারের জন্য বিভিন্ন কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। 

এজন্য শিক্ষা পরিকল্পনার অংশ হিসেবে পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা অবৈতনিক ঘোষণার পর বর্তমানে বিশেষ করে মেয়েদের জন্য উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাকেও অবৈতনিক ঘোষণা করেছে।

৬. কর্মসংস্থান সৃষ্টি : বেকার সমস্যা সমাধানের অন্যতম মাধ্যম হলো কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা। বেকার সমস্যা বাংলাদেশে প্রকট আকার ধারণ করেছে। 

দেশে মোট কর্মক্ষম জনশক্তির উল্লেখযোগ্য অংশ বেকার। এজন্য দেশের বেকার সমস্যা সমাধানের জন্য নতুন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিকল্পনার অন্যতম লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ।

৭. মৌলিক চাহিদা পূরণ : স্বাভাবিক জীবনযাপন করার জন্য মানুষের কিছু মৌলিক চাহিদা রয়েছে। এসব মৌলিক চাহিদা পূরণের ব্যবস্থা করে দেওয়া সরকারের দায়িত্ব। 

বাংলাদেশ দরিদ্র দেশ হওয়ার ফলে জনগণের এসব মৌলিক চাহিদা যথাযথভাবে পূরণ করতে পারছে না। সাধারণ মানুষের এসব চাহিদা পূরণ করার জন্য কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিকল্পনার অন্যতম উদ্দেশ্য।

৮. কৃষির উন্নয়ন : বাংলাদেশের মানুষের প্রধান পেশা হলো কৃষি। কৃষি কাজ করে এদেশের অধিকাংশ মানুষ জীবনধারণ করে। 

এজন্য কৃষির উন্নতি সাধন করার জন্য বিভিন্ন ধরনের পরিকল্পনা গ্রহণ করা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিকল্পনার অন্যতম উদ্দেশ্য। 

কৃষি উন্নয়নের জন্য বিনামূল্যে বীজ, সার ও বিভিন্ন কীটনাশকের ব্যবস্থা এবং সেচ ব্যবস্থার উন্নয়ন সাধনের জন্য বিভিন্ন কার্যকর পদক্ষেপ সরকার গ্রহণ করেছে।

৯. যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন : যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ব্যতীত দেশের সুসম উন্নয়ন বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়! গ্রাম ও শহরের ব্যবধান এনে দিতে পারে উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা। 

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিকল্পনার অন্যতম লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হলো যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন সাধন করা ।

১০. শিল্পোন্নয়ন : বর্তমান বিশ্বায়নের যুগে যেদেশ যত বেশি শিল্পে উন্নত সেদেশ তত বেশি উন্নত ও আধুনিক । বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিকল্পনার উদ্দেশ্য হলো শিল্পোন্নয়ন করা। এজন্য সরকার বিভিন্ন দেশ ও সংস্থাকে বিনিয়োগে উৎসাহিত করে আসছে।

১১. আয়ব্যয়ের সামঞ্জস্যবিধান : বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিকল্পনার অন্যতম লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হলো দেশীয় অর্থনীতিতে আয়ব্যয়ের সামঞ্জস্যবিধান করা। 

আয়ব্যয়ে সমতা না থাকলে জাতীয় অর্থনীতিতে ঘাটতি দেখা দেয়। এজন্য সরকার বর্তমানে আমদানির চেয়ে রপ্তানির দিকে বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করছে।

১২. সুসংগঠিত জাতি গঠন : স্বাধীনতার অব্যাহতির পর থেকে শুরু করে বেশ কয়েক বছর বাংলাদেশের রাজনীতি ছিল অস্থিতিশীল, যার ফলে অর্থনীতি ছিল পর্যুদস্ত। 

বর্তমানে সরকারের অর্থনৈতিক পরিকল্পনার উদ্দেশ্য হলো বিশ্ব মানচিত্রে সুসংগঠিত জাতি গঠন করা।

উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, দেশের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়নের জন্য পরিকল্পনার বিকল্প নেই। কারণ পরিকল্পনাবিহীন কোনো কাজই সঠিকভাবে সম্পাদন করা সম্ভব নয়। 

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিকল্পনার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হলো দেশের সার্বিক উন্নতি সাধন করে জনগণের চাহিদা পূরণ করতে আন্তর্জাতিক দরবারে নিজেদের একটি স্বাবলম্বী জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা । 

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url
আরও পড়ুনঃ
আরও পড়ুনঃ