ভিলফ্রেডো প্যারেটোর রাজনৈতিক মতবাদ মূল্যায়ন কর
ভিলফ্রেডো প্যারেটোর রাজনৈতিক মতবাদ মূল্যায়ন কর |
ভিলফ্রেডো প্যারেটোর রাজনৈতিক মতবাদ মূল্যায়ন কর
- অথবা, রাজনৈতিক সমাজতত্ত্বে প্যারেটোর অবদান মূল্যায়ন কর।
উত্তর : ভূমিকা : আধুনিক সমাজবিজ্ঞানকে গতিশীল করতে যেসব সমাজবিজ্ঞানী তাদের কর্মের মাধ্যমে পৃথিবীতে আসীন হয়ে আছেন তাঁর মধ্যে ভিলফ্রেডো প্যারেটো অন্যতম।
তাঁর এলিট সম্পর্কিত মতবাদ থেকে ধারণা করা হয় যে, বেঁচে না থাকলেও তিনি মুসোলিনির ফ্যাসিবাদেরও সমর্থক ছিলেন। ভিলফ্রেডো প্যারেটোই প্রথম সমাজবিজ্ঞানের আলোচনায় এলিট (Elite) শব্দটি ব্যবহার করেন।
প্যারেটো তাঁর 'The Rise and Fall of Elite' শীর্ষক গ্রন্থে বলেছেন, "The elites from the upper classes and usually also the richest." তাঁর এলিট সম্পর্কিত মতবাদ বর্তমানে বিশ্বের প্রত্যেকটি দেশ রাজনৈতিক ক্রিয়াকাণ্ডে প্রয়োগ করেছে।
প্যারেটোর পরিচয় : ভিলফ্রেডো প্যারেটো (Vilfredo Pareto) ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দে ইতালির এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি একাধারে সমাজবিজ্ঞানী, রাজনৈতিক বিজ্ঞানী ও অর্থনীতিবিদ হিসেবে সুপরিচিত ছিলেন।
তাঁর সুবিখ্যাত দু'টি গ্রন্থ "The Mind and Society' এবং 'The Social System'। এ দু'টি গ্রন্থে তিনি এলিট সম্পর্কে তাঁর মতবাদ বিস্তারিতভাবে বিশ্লেষণ করেছেন।
প্যারেটোর রাজনৈতিক মতবাদ : ভিলফ্রেডো প্যারেটো প্রকৃতপক্ষে একজন সমাজবিজ্ঞানী ছিলেন । তারপরও রাষ্ট্রদর্শনে তাঁর অবদান মোটেই খাটো করে দেখার অবকাশ নেই। তাঁর উল্লেখযোগ্য অবদানসমূহ নিম্নে আলোচিত হল :
১. গণতন্ত্র একটা অবাস্তব শাসনব্যবস্থা : প্যারেটো তার সামগ্রিক দর্শন আলোচনায় 'Residues and derivation' এবং Elite ও 'Elite circulation theory' সম্পর্কে যে তত্ত্ব ও মতবাদ প্রচার করেছেন সেগুলো যথেষ্ট মূল্যবান, যা তৎকালীন ও বর্তমান রাষ্ট্রদর্শনকে সমৃদ্ধ করার জন্য সহায়তা করেছে।
তবে 'Elite theory' ও 'Residents and derivation' এ দু'টি মতবাদের মাধ্যমে তিনি প্রমাণ করেন যে, গণতন্ত্র একটা অবাস্তব ও অসম্ভব শাসনব্যবস্থা। বস্তুতপক্ষে তিনি গণতন্ত্রকে ‘ছদ্মবেশধারী ধনিকতন্ত্র' নামে অভিহিত করেছেন ।
২. যুক্তি পরীক্ষণ পদ্ধতি সম্পর্কিত মতবাদ : প্যারেটো তাঁর সামগ্রিক রাষ্ট্রদর্শন বিশ্লেষণের জন্য যে পদ্ধতি অবলম্বন করেছেন তাকে বলা হয় যুক্তি পরীক্ষণ পদ্ধতি। প্যারেটো মানুষের কর্মকাণ্ডকে যৌক্তিক ও অযৌক্তিক হিসেবে বিভক্ত করেছেন।
তিনি বলেন মানুষ প্রথমে অযৌক্তিকভাবে একটা কাজ শুরু করে, পরে সেটাকে যৌক্তিক বলে প্রমাণ করার চেষ্টা করে।প্যারেটো তাঁর Residents and derivation তত্ত্বে এ মূলনীতি বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেছেন।
৩. মানুষের যোগ্যতার মাপকাঠি : প্যারেটোর রাষ্ট্রদর্শনের মূল কথা হল, মানুষ মাত্রই অযুক্তিবাদী এবং সকল মানুষই যোগ্যতা ও প্রতিভার দিক দিয়ে অসমান। বলা যায়, প্যারেটোর, তত্ত্ব দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েই মুসোলিনি তাঁর ফ্যাসিস রাষ্ট্রদর্শনের গোড়াপত্তন করেন।
৪. এলিট শ্রেণি : প্যারেটোর এলিট তত্ত্বের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে, সকল সমাজেই দু'টি প্রধান শ্রেণি বিরাজ করে। তাঁর মতে, সমাজের যে গ্রুপটি সবচেয়ে বেশি যোগ্যতার অধিকারী সেটিই হচ্ছে এলিট শ্রেণি।
তাঁরা হচ্ছে সমাজের শাসক এলিট (Rulling elite)। বিপরীতে অপর এক এলিট শ্রেণি রয়েছে যাকে বিরোধী এলিট (Counter elite) হিসেবে অভিহিত করা হয়।
এলিট শ্রেণির আবর্তন তত্ত্ব : প্যারেটো মনে করেন যে, একটি সমাজ বা সম্প্রদায় এলিটদের একটি ক্ষুদ্র গোষ্ঠীৰ দ্বারা শাসিত হয়ে থাকে। তবে এক শ্রেণির এলিট কখনও সমাজে স্থায়ীভাবে শাসনকার্যে বহাল থাকতে পারে না।
এভাবে দেখা যায় যে, এক সময়ের শাসনকারী এলিট অন্য সময়ের অশাসনকারী এলিটে পরিণত হয়। এলিট শ্রেণির এরূপ পরিবর্তনকে প্যারেটো এলিট শ্রেণির আবর্তন তত্ত্ব (Elite circulation theory) বলে অভিহিত করেছেন।
অভিজাত শ্রেণির সমাধিক্ষেত্র তাঁর মতানুসারে এলিট শ্রেণির আবর্তন স্বাভাবিক নিয়মে হওয়ার কথা, কিন্তু অনেক সময় তা হয় না।
শাসন করার যোগ্যতা হারিয়ে ফেললেও ক্ষমতাসীন এলিট শ্রেণি ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে থাকতে চায়। এক্ষেত্রে বলপ্রয়োগের অনেক সময় অসম্ভাবী হয়ে দাঁড়ায়।
তবে যত রকম চেষ্টাই করুক, ক্ষমতাসীন শ্রেণি পরিবর্তনের এ ধারাকে কোন ক্রমেই রোধ করতে পারে না। তাঁদের এক সময় ক্ষমতার আসন ত্যাগ করতে হয়।
জীবনের বিনিময়ে হলেও অনেক সময় তা রক্ষা করতে হয়। এজন্য প্যারেটো বলেন, “ইতিহাস হল অভিজাত শ্রেণির সমাধিক্ষেত্র। (History is the graveyard of aristocracy) |
আদর্শ শাসনব্যবস্থা : প্যারেটো তাঁর সামগ্রিক রাষ্ট্রদর্শনে আদর্শ শাসনব্যবস্থা সম্পর্কে একটা রূপরেখা তুলে ধরেছেন। প্যারেটোর এলিট আবর্তন তত্ত্বে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, কেবলমাত্র প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির Residues (রেসিডিউস) প্রবল হলে কোন এলিট চিরকাল স্থায়ীভাবে ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারে না। যদি কোন এলিট শ্রেণির মধ্যে উভয় প্রকার Residues সমন্বয় সাধিত হয় তাহলে সেটিই হবে আদর্শ শাসনব্যবস্থা।
এলিট শ্রেণির মেয়াদকাল : স্থায়িত্বের ভিত্তিত্তে প্যারেটো এলিট গোষ্ঠীকে তিন শ্রেণিতে বিভক্ত করেছেন। যথা :
১. সনাতন এলিট;
২. উদার গণতান্ত্রিক এলিট এবং
৩. ফ্যাসিস্টনার্জী এলিট।
প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির স্থায়িত্বের তুলনায় তৃতীয় শ্রেণির স্থায়িত্বকাল অধিক ফলপ্রসূ হয়। প্যারেটো তৃতীয় শ্রেণির এলিট অর্থাৎ ফ্যাসিস্টনাজী এলিটদের অধিক মাত্রায় সমর্থন করেছেন। এজন্য তাঁকে 'ফ্যাসিবাদের কার্ল মার্কস' বলে আখ্যায়িত করা হয়।
বিংশ শতাব্দীর ম্যাকিয়াভেলি : ম্যাকিয়াভেলি তার প্রিন্স বা শাসককে যে শৃগালের মত ধূর্ত এবং সিংহের ন্যায় শক্তিশালী হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তা প্যারেটো কথার অনুরূপ।
তিনি তাঁর শাসকের মধ্যে প্রথম শ্রেণির রেসিডিউস এবং দ্বিতীয় শ্রেণির রেসিডিউস এর মধ্যে সমন্বয় সাধনের উপদেশ দিয়েছেন।
এজন্য অধ্যাপক হ্যালোয়েল প্যারেটোর The Mind and Society' কে ম্যাকিয়াভেলির 'The Prince' এর নতুন সংস্করণ এবং প্যারেটোকে "বিংশ শতাব্দীর ম্যাকিয়াভেলি" বলে অভিহিত করেছেন।
উপসংহার : মূলত সামাজিক ও রাজনৈতিক বিষয়ে জ্ঞানানুসন্ধানের ক্ষেত্রে প্যারেটো কেবলমাত্র নিজের অভিজ্ঞতা ও প্রত্যক্ষণের উপর নির্ভর করার পক্ষপাতী ছিলেন। প্যারেটোর রাষ্ট্রদর্শনের মূলকথা বা মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে উন্নয়ন, দ্বন্দ্ব বা সংঘাত নয়।
তাঁর এলিট সম্পর্কিত মতবাদ এর জন্য তিনি বর্তমান ও অতীত সময়ে বিশেষভাবে সুখ্যাতি অর্জন করেছেন। এজন্য তাকে বলা হয় "Machiavelli of the twentinth century" (বিংশ শতাব্দীর ম্যাকিয়াভেলি)।