উন্নয়নশীল দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে এলিটের ভূমিকা বিশ্লেষণ কর
উন্নয়নশীল দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে এলিটের ভূমিকা বিশ্লেষণ কর |
উন্নয়নশীল দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে এলিটের ভূমিকা বিশ্লেষণ কর
- অথবা, উন্নয়নশীল দেশের ক্ষেত্রে এলিটের ভূমিকা পর্যালোচনা কর।
উত্তরা৷ ভূমিকা : বর্তমান রাজনৈতিক ব্যবস্থায় এলিট (Elite) একটি বহুল আলোচিত বিষয়। যে কোন সমাজের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে এলিটের অস্তিত্ব পরিলক্ষিত হয়।
উন্নয়নশীল দেশে এলিটের ভূমিকা : বর্তমান সময়ে উন্নয়নশীল দেশগুলোর সমস্যা ও সম্ভাবনা এবং ভবিষ্যৎ সম্পর্কিত আলোচনায় এলিটদের ভূমিকা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।
অধ্যাপক C. W. Mills তাঁর 'The Power Elite' গ্রন্থে বলেন, “উন্নয়নশীল দেশগুলোতে প্রতিনিয়তই বিভিন্ন প্রকার পরিবর্তন ও রূপান্তর সাধিত হচ্ছে।
আর এক্ষেত্রে সাধারণ জনগণ নয়, বরং এলিট শ্রেণিই নেতৃত্ব ও পরিচালনার দায়িত্ব লাভ করে। কেননা এলিট শ্রেণিভুক্ত ব্যক্তিবর্গই অধিক জ্ঞানী ও দক্ষ” ।
নিম্নে উন্নয়নশীল দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে এলিটের ভূমিকা পর্যালোচনা করা হল :
১. সমাজ রূপান্তরে : বর্তমান বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোতে প্রতিনিয়ত পরিবর্তন ও রূপান্তর ঘটছে। এ রূপান্তরের ফলে সামাজিক সম্পর্ক পরিবর্তিত হচ্ছে। পুরানো ধ্যানধারণা ও অভ্যাসের ক্ষেত্রে সূচিত হচ্ছে পরিবর্তন।
অতীত ঐতিহ্য ক্রমান্বয়ে বিলুপ্ত হচ্ছে, পুরানো নেতৃত্বে দেখা দিচ্ছে ভাটা এবং অতীত ও বর্তমানের মধ্যে তীব্র সংকট সৃষ্টি হচ্ছে। এসব রূপান্তরের উদ্যোক্তা, উদ্দীপক ও পরিচালক হচ্ছে সমাজের এলিট শ্রেণি ।
২. রাজনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে : বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশের রাজনৈতিক উন্নয়নে এলিট শ্রেণির ভূমিকা অনস্বীকার্য। সরকারের সফলতা নির্ভর করে দক্ষ রাজনৈতিক নেতৃত্বের উপর। কেননা দক্ষ রাজনৈতিক নেতৃত্ব ছাড়া রাষ্ট্রীয় উন্নয়ন সম্ভব নয়।
এক্ষেত্রে এলিট শ্রেণি বুদ্ধিবৃত্তি, দক্ষতা, বিচক্ষণতা ও প্রজ্ঞার মাধ্যমে সরকার গঠন, সরকারের পরিকল্পনা প্রণয়ন, জনমত গঠন প্রভৃতি কার্য সম্পাদনের মাধ্যমে এলিট শ্রেণি রাজনৈতিক উন্নয়নে সহায়তা করে থাকে ।
৩. অর্থনৈতিক উন্নয়নে : উন্নয়নশীল দেশগুলোতে উচ্চতর সরকারি কর্মকর্তা বা এলিটগণ অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে থাকেন।
অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এলিটগণকে জনগণের নতুন নতুন দাবিদাওয়া, সনাতন জীবনধারা অনুসারী শক্তিসমূহের বিরোধিতাজনতি সমস্যাদি মোকাবিলা করতে হয়।
এসব পরিস্থিতিতে সর্বপ্রথম যা প্রয়োজন তা হল সঠিক নেতৃত্বের কার্যকর কর্মপ্রচেষ্টায় উৎসাহ উদ্দীপনা এবং ঘটনাপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণকারী নেতৃত্বের যা এলিট শ্রেণি থেকে আসে
৪. সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানাদি গড়ে তোলা : উন্নয়নশীল দেশগুলোর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিত ব্যক্তিবর্গ, সেনাবাহিনীর সদস্যবৃন্দ যারা মধ্যবিত্ত শ্রেণি হতে প্রবেশ করেছে এবং আমলাগণ যারা নতুন রাষ্ট্রের কর্ণধারের দায়িত্বপ্রাপ্ত।
এসব শ্রেণি উন্নয়নশীল দেশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। এ ধরনের এলিটগণের কাজ হল নতুন নতুন সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা এবং রাষ্ট্রকে উন্নয়নের পথে ধাবিত করা।
৫. শিল্পের উন্নয়নে : উন্নয়নশীল দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের মূল শক্তি শিল্পায়নের মধ্যে নিহিত। সাম্প্রতিক কালে শিল্পোন্নয়ন প্রক্রিয়া সম্পর্কে অধ্যয়ন করে দেখা গেছে, পাঁচ প্রকারের এলিটান উন্নয়নশীল দেশের শিল্পের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এরা হল রাজবংশীয় এলিট, মধ্যবিত্ত, শ্রেণি বিপ্লবী বুদ্ধিজীবী, ঔপনিবেশিক প্রশাসক এবং জাতীয়তাবাদী নেতাগণ।
৩. স্বাধীনতা অর্জনে এলিটের ভূমিকা : উন্নয়নশীল দেশসমূহের স্বাধীনতা অর্জনে এলিটনের ভূমিকা অপরিসীম। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে যে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের প্রসার ঘটে তা পরবর্তীতে স্বাধীনতা অর্জনে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
আর এ জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের প্রসার তথা স্বাধীনতা অর্জনে এলিট শ্রেণি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।
৭. রাজনৈতিক জীবন গড়ে তোলা : উন্নয়নশীল দেশের রাজনৈতিক জীবন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে এলিট শ্রেণি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আমলাগণ রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে জনগণকে রাজনৈতিক জীবন সম্পর্কে বুঝতে সাহায্য করে।
পরবর্তীতে অনেকাংশে আমলা বা এলিটগণ রাজনৈতিক নেতৃত্ব প্রদানে কার্যকরী ভূমিকা প্রদান করে থাকে।
৮. দায়িত্বশীল সরকার গঠনে : উন্নয়নশীল দেশের রাজনীতিতে একমাত্র এলিট শ্রেণি ব্যতীত অধিকাংশ জনগণই রাজনৈতিক ব্যবস্থা সম্পর্কে উদাসীন। রাজনীতি সম্বন্ধে তাদের বিশেষ কোন জ্ঞান নেই।
সেজন্য তারা দায়িত্বশীল সরকার প্রতিষ্ঠা ও কার্যকরী করার ক্ষেত্রে অনুপযুক্ত। এক্ষেত্রে এলিট শ্রেণি দায়িত্বশীল সরকার গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
৯. আধুনিকীকরণের ক্ষেত্রে : উন্নয়নশীল দেশকে আধুনিকীকরণে এলিট শ্রেণি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করছে। মানুষের আচার আচরণ ও কৃষ্টির ক্ষেত্রে আধুনিক ধ্যানধারণার সার্বিক দিক বিশ্লেষণ করেন এলিট শ্রেণি।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মানুষের জীবনে এনে দিয়েছে অভূতপূর্ব পরিবর্তন। এ পরিবর্তনের ধারাকে প্রবর্তনের মূলে এলিট শ্রেণি সর্বদা সতর্ক ও তৎপর।
তারা আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত, সেজন্য সমাজকে আধুনিকীকরণের দিকে ধাবিত করানোর ক্ষেত্রে তাদের ভূমিকা অপরিহার্য।
১০. গণতন্ত্র বিকাশের ক্ষেত্রে : গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এলিটগণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। বিশেষ করে উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের জন্য সঠিক গণতান্ত্রিক পরিবেশ বজায় রাখার মূল দায়িত্ব পালন করেন সমাজের এলিট শ্রেণি । একটা জাতিকে একত্রিত করার মানসে নতুন নতুন সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন।
১১. আন্তর্জাতিক সম্পর্ক প্রসারের ক্ষেত্রে : বর্তমানে জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রগুলো তাদের রাষ্ট্রীয় কার্যক্রম, যোগাযোগ, সম্পর্ক ইত্যাদি ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের জাতীয় সীমা অতিক্রম করে আন্তর্জাতিকতার দিকে ধাবিত হচ্ছে।
মানবসভ্যতার অগ্রগতিতে বিশেষ করে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে এলিট শ্রেণি বিভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শ দিয়ে উন্নয়নশীল দেশগুলোর সম্পর্ক উন্নয়নে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করে থাকেন।
১২. শিক্ষার প্রসার : বর্তমানে বিভিন্ন উন্নয়নশীল রাষ্ট্রে যে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার ঘটেছে সেটা সম্ভব হয়েছে একমাত্র এলিট শ্রেণির জন্যে।
এলিট শ্রেণি উন্নত দেশসমূহ থেকে বিভিন্ন ধরনের কলাকৌশল, বিশেষ করে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, ব্যবস্থাপনা, উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক দর্শন সম্পর্কে উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের জনগণকে সচেতন করে তোলেন।
১৩. সংস্কৃতির বিকাশ : বর্তমানে উন্নয়নশীল রাষ্ট্রগুলোতে যে পাশ্চাত্য সংস্কৃতির বিকাশ সাধিত হয়েছে সেটা সম্ভব হয় উন্নত রাষ্ট্রের এবং উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের এলিট শ্রেণির কল্যাণে।
উন্নত দেশের এলিটগণ উন্নয়নশীল দেশের সাথে বিভিন্ন সময়ে সংস্কৃতিগত বিনিময় করে থাকেন। এতে করে উন্নয়নশীল রাষ্ট্রে পাশ্চাত্য সংস্কৃতির দ্রুত বিকাশ ঘটছে। যার প্রমাণ মেলে বর্তমান ঢালিউড ও বলিউড নামক চলচ্চিত্র শিল্পকেন্দ্রগুলোতে।
উপসংহার : উপরিউক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের আর্থসামাজিক তথা সার্বিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে এলিট শ্রেণির অবদান নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ।
এ বিষয়ে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই। তাছাড়া রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত উন্নয়নে এলিট শ্রেণি বিভিন্নভাবে সহায়তা করে থাকে।
বর্তমান উন্নয়নশীল অধিকাংশ রাষ্ট্রের যে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক বিকাশ সাধিত হয়েছে সেটা সম্ভব হয়েছে এলিট শ্রেণির কল্যাণে।
সেজন্য রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর দৃষ্টিতে বলা যায় যে, "The role of the elite in the developing country is extremly important because it formulates the politics and takes the decisions."