সুবাদার মীর জুমলার বাংলা ও আসাম অভিযানের বিস্তারিত আলোচনা কর
সুবাদার মীর জুমলার বাংলা ও আসাম অভিযানের বিস্তারিত আলোচনা কর |
সুবাদার মীর জুমলার বাংলা ও আসাম অভিযানের বিস্তারিত আলোচনা কর
- অথবা, সুবাদার মীর জুমলার বাংলা ও আসাম অভিযানের বর্ণনা দাও ।
উত্তর : ভূমিকা : আওরঙ্গজেবের সেনাপতি মীর জুমলার বাংলা অভিযান ছিল বাংলার ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। সম্রাট শাহজাহানের পুত্রদের মধ্যে ভ্রাতৃবিরোধকালে তিনি আওরঙ্গজেবের পক্ষ অবলম্বন করেন।
তারই সাহায্যে আওরঙ্গজেব সুজার বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করে জয়লাভ করেন। মীর জুমলার বাংলা অভিযানের সফলতার জন্য আওরঙ্গজের তাকে “খান-ই-খানান” এবং “সিপাহসালার” উপাধিতে ভূষিত করে বাংলার সুবাদার নিযুক্ত করেন।
→ মীর জুমলার বাংলা অভিযান : মীর জুমলার বাংলা অভিযানের বর্ণনা নিম্নে দেওয়া হলো :
(ক) বাংলা অভিযানের কারণ : সম্রাট শাহজাহান তার দ্বিতীয়পুত্র সুজাকে ১৬৩৯ সালে বাংলার সুবাদার করে পাঠান। তিনি ২০ বছর বাংলার শাসনকর্তা ছিলেন।
১৬৫৭ সালে সম্রাট শাহজাহান অসুস্থ হয়ে পড়লে তার চারপুত্রের মধ্যে সাংঘাতিক ভ্রাতৃবিরোধ শুরু হয়। এ সময়ই বাংলার সুবাদার শাহসুজা ১৬৫৭ সালে নিজেকে রাজমহলে সম্রাট বলে ঘোষণা করেন।
তিনি বিহারও নিজের আয়ত্তে আনেন। সুজা ঢাকা হতে রাজধানী রাজমহলে নিয়ে যান। উত্তরাধিকা আপ্তে। করে দিল্লির সিংহাসনে আরোহণ করেন।
এরপর তিনি সু সাথে সমঝোতা করতে চেষ্টা করেন। কিন্তু সুজা তার প্রস্তাবে রাজি হয়নি। ফলে পরিস্থিতিতে পড়ে সম্রাট আওরঙ্গজেব মীর জুমলাকে দমন করার জন্য বাংলা অভিযানে প্রেরণ করে।
(খ) মীর জুমলার বাংলা অভিযানের ঘটনা :
১. খায়ার যুদ্ধ : সুজা দিল্লির সিংহাসন লাভের জন্য আওরঙ্গজেবের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ হন। ১৬৫৯ সালে খাওয়ার যুদ্ধে আওরঙ্গজেবের জ্যেষ্ঠ পুত্র মুহাম্মদ এবং বিশ্বস্ত সেনাপতি মীর জুমলা সুজাকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করেন।
২. মীর জুমলার রাজমহল অধিকার : খাজুয়ার যুদ্ধের পর মীর জুমলা সুজাকে অনুসরণ করে তেলিয়াপড়ে পৌঁছেন। মীর জুমলা ঝাড়খণ্ডের মধ্য দিয়ে গঙ্গা নদীর পশ্চিম তীরে অবস্থিত বেলঘাটায় উপস্থিত হন এবং ১৬৫৯ সালে রাজমহল অধিকার করেন।
৩. সুজাকে অবরুদ্ধ : বর্ষা মৌসুমে মীর জুমলা স্থানীয় জমিদারের সাহায্যে নৌবহর প্রস্তুত করেন। বিহারের পাউদ খানের নৌ-বহরের সাহায্যে মীর জুমলা রাজমহল হতে গঙ্গা নদী পার হয়ে সামদাহ নামক স্থানে পৌঁছেন এবং ১৬৬০ সালে সুজাকে ঘিরে ফেলেন।
৪. সুজার পলায়ন : মীর জুমলা ও দাউদ খানের সৈন্যবাহিনী দ্বারা আক্রান্ত হয়ে সুজা ভাঙা হতে জাহাঙ্গীরনগর পলায়ন করেন। মীর জুমলা তাকে অনুসরণ করলে স্থানীয় জমিদাররা সুজার পক্ষ ত্যাগ করে।
উপায়ন্তর না দেখে শাহ সুজা দীর্ঘদিন যুদ্ধ করে শেষ পর্যন্ত আওরঙ্গজেবের সেনাপতি মীর জুমলার হাতে পরাজিত হয়ে ১৬৬০ সালে বাংলা ছেড়ে আরাকানে আশ্রয় নেন।
সেখানে তিনি আরাকানীদের হাতে নিহত হন। ফলে ১৬৬০ সালে মীর জুমলা- জাহাঙ্গীরনগর দখল করেন।
→ মীর জুমলার আসাম অভিযান : নিয়ে বাংলার সুবাদার মীর জুমলার আসাম অভিষার বর্ণনা দেওয়া হলো :
(ক) আসাম অভিযানের কারণ : ১৬৬১ সালে কুচবিহার অধিকারের পর মীর জুমলা তার সৈন্যদল ও নৌবাহিনী নিয়ে আসাম অভিযানে যাত্রা করেন। কামরূপ পুনরুদ্ধার ও আসাম জয় করে অহোমরাজের শাস্তির ব্যবস্থা করা তার অভিযানের উদ্দেশ্য ছিল।
(খ) আসাম অভিযান : জল ও স্থল পথে মুঘল বাহিনী কামরূপ প্রবেশ করে। একটি বড় নৌযুদ্ধে অহোমদের নৌশক্তি বিধ্বস্ত হয়ে যায়। ফলে ৩০০ রণতরী মুঘলদের হস্তগত হয়।
কামরূপে পুনরায় মুঘল শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। মীর জুমলা তার অগ্রগতি অব্যাহত রাখেন। অতঃপর তিনি ১৬৬২ সালের ১৭ মার্চ আসামের রাজধানী বরগ্রাম অধিকার করেন।
আসামের রাজা জয়ধ্বজ বার্ষিক কর প্রদানের শর্তে সন্ধি স্বাক্ষর করে। মীর জুমলা ৮২টি হস্তী, তিন লক্ষ টাকা, তিনশ চল্লিশ মণ গোলাবারুদ ছাড়াও বহু মূল্যবান সামগ্রী হস্তগত করেন।
এতদ্ব্যতীত অহোমরাজ যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ হিসেবে ২০,০০০ তোলা সোনা, ১,২০,০০০ ভোলা রূপা ও অন্যান্য মূল্যবান সম্পদ এবং রাজ্যের একাংশ ছেড়ে দেন। তবে মীর জুমলার মৃত্যুর পর আসামে পুনরায় মুঘল শাসন লোপ পায় ৷
উপংসহার : মীর জুমলার আসাম বিজয় মুঘল তথা বাংলার ইতিাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে তিনি আসাম বিজয় সম্পন্ন করেন।
তিনি ছিলেন অত্যন্ত বুদ্ধিমান, বিচক্ষণ, মনের দিক থেকে অস্বাভাবিক শান্ত, নির্ভীক এবং সাহসী। রাজদরবারে কূটকৌশলে এবং যুদ্ধের ময়দানে রণচাতুর্যে তিনি অত্যন্ত বিচক্ষণ ছিলেন।