সুবাদার হিসেবে মুর্শিদকুলি খান সম্পর্কে আলোচনা কর
সুবাদার হিসেবে মুর্শিদকুলি খান সম্পর্কে আলোচনা কর |
সুবাদার হিসেবে মুর্শিদকুলি খান সম্পর্কে আলোচনা কর
- অথবা, সুবাদার হিসেবে মুর্শিদকুলি খানকে মূল্যায়ন কর ।
উত্তর : ভূমিকা : বাংলার ইতিহাসে মুর্শিদকুলি খান অন্যতম সর্বশ্রেষ্ঠ ও স্মরণীয় সুবেদার। অতি সামান্য অবস্থা হতে কঠোর অধ্যবসায়, চারিত্রিক দৃঢ়তা ও মানসিক উৎকর্ষের দরুণ তিনি একটি রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদে উন্নীত হন।
মুঘল বংশের অর্থনীতি যখন ভেঙে পড়ছিল তখন মুর্শিদকুলি খান বাংলার দেওয়ান ও সুবাদার হয়ে আসেন। তিনি ভেঙে পড়া অর্থনীতিকে চাঙ্গা করে তোলেন। তার সুবাদারির জীবনে তার রাজস্ব সংস্কারই বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ।
→ মুর্শিদকুলি খানের কর্মময় জীবন : ১৭১৭ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত ছিল মুর্শিদকুলি খানের কর্মময় জীবন। মুর্শিদকুলি খান দাক্ষিণাত্যের এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।
হাজি শফী ইস্পাহানী নামক শায়েস্তা খানের জনৈক দেওয়ান তাকে ক্রয় করে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করে তাঁর নামকরণ করেন মুহাম্মদ হাদী।
১৬৯৬ খ্রিষ্টাব্দে প্রভুর মৃত্যুর পর তিনি ভারতে প্রত্যাবর্তন করে বেরার প্রদেশের অধীনে চাকরি গ্রহণ করেন। তিনি সম্রাট আওরঙ্গজেবের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তাঁকে হায়দ্রাবাদের দেওয়ান এবং পরে ইয়েলকোন্দলের ফৌজদার নিযুক্ত করা হয় ১৬৯৮ খ্রিষ্টাব্দে।
এ সময় সম্রাট আওরঙ্গজেব তাঁকে কারতালব খান উপাধি প্রদান করেন। ১৭০১ খ্রিষ্টাব্দে মুকসুদাবাদের ফৌজদারীর দায়িত্বসহ তাঁকে আওরঙ্গজেব বাংলার দেওয়ান নিযুক্ত করেন।
তাঁর অসামান্য যোগ্যতায় মুগ্ধ হয়ে সম্রাট আওরঙ্গজেব স্বল্প সময়ের মধ্যেই তাঁকে উড়িষ্যার সুবাদার, বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার দেওয়ান এবং ৫টি জেলার ফৌজদারের পদে নিযুক্ত করেন।
ইতোমধ্যে তৎকালীন বাংলার সুবাদার আদিমুশশানের ৭০০০ দেহরক্ষীকে কর্মচ্যুত করা হলে মুর্শিদকুলি খানকে তিনি কৌশলে অপদস্ত করলে আওরঙ্গজেব তাকে রাজস্ব বিভাগ ঢাকা থেকে মুকসুদাবাদে স্থানান্তরের অনুমতি প্রদান করে।
বাংলার রাজস্ব বৃদ্ধির জন্য সম্রাট তাকে মুর্শিদকুলি খান উপাধিতে ভূষিত করেন। মুকসুদাবাদের নামও মুর্শিদাবাদ রাখার অনুমতি দেন। সম্রাট তার মনসবও বাড়িয়ে দেন। ১৭০৪ খ্রিষ্টাব্দে সেখানে একটি রাজকীয় টাকশাল ও স্থাপিত হয়।
আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর তাকে দাক্ষিণাত্যের ১৭১০ খ্রিষ্টাব্দে বাংলার ১৭১৪ খ্রিস্টাব্দে "জাফর খান” উপাধি প্রদানপূর্বক উড়িষ্যার এবং ১৭১৭ খ্রিষ্টাব্দের আগস্ট মাসে বাংলার পূর্ণ সুবাদার পদে নিযুক্ত করা হয়।
মুঘল সম্রাট ফররুখ শিয়ারের মৃত্যু (১৭২৭) পর্যন্ত তিনি উক্ত পদে বহাল ছিলেন। এ সময় তিনি সুদূরপ্রসারী রাজস্ব সংস্কার প্রবর্তন করে বাংলার ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে রয়েছেন।
সুবাদার হিসেবে বাংলার সামগ্রিক জীবনে তাঁর রাজস্ব ও শাসনব্যবস্থার প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। মুর্শিদকুলি খানের শাসন ব্যবস্থার উল্লেখযোগ্য দিক হলো তার রাজস্ব ব্যবস্থা।
→ মুর্শিদকুলি খানের রাজস্ব সংস্কার : মুর্শিদকুলি খান প্রথমে বাংলার দেওয়ান নিযুক্ত হন এবং পরবর্তীতে সুবাদারি লাভ করে রাজস্ব, শাসনব্যবস্থায় ব্যাপক সংস্কার সাধন করেন। তার সংস্কার- খুবই সফল হয়। তিনি রাজস্ব বৃদ্ধি ও আদায়ের জন্য ২ ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করেন।
(ক) তিনি কর্মচারীদের জায়গিরগুলোকে সরকারের খাস জমিতে পরিণত করেন এবং এদের জন্য উড়িষ্যা প্রদেশে জায়গির নির্দিষ্ট করে দেন।
(খ) রাজস্ব আদায়ের তার জমিদার থেকে কেড়ে নিয়ে ইজারাদারদের উপর ন্যস্ত করেন এবং বাংলায় ভূমি জরিপের ব্যবস্থা করে তার ভিত্তিতে প্রজাদের খাজনা নির্ধারণ করে দেন।
তাছাড়াও রাজস্ব আদায়ের নীতিতে তিনি যে পরিবর্তন আনেন তা নিম্নে আলোচনা করা হলো :
১. ইজারাদার নিয়োগ : তিনি সরকারি কর্মচারী ও জমিদারদের সব জমি জাতীয়করণের মাধ্যমে রাজস্ব আদায়ে বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে জনারদের উৎখাত করে রাজস্ব আদায়ের ভার ইজারাদারদের উপর ন্যস্ত করেন। ইজারাদাররা সংগৃহীত রাজস্বের একাংশ পেতেন।
২. রাজস্ব-কর্মচারী পরিবর্তন : রাজস্ব বিভাগে পূর্বে অধিকাংশ প্রভাবশালী মুসলিম কর্মচারী কর্মকর্তারা ছিল অধিক লোডী ফলে প্রায়ই রাজস্ব আদায় করে আত্মসাৎ করতো।
এজন্য মুর্শিদকুলি খান এসব দুর্নীতিপরায়ণ কর্মচারীদের বরখাস্ত করে হিন্দুদেরকেই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নিয়োগ দিতেন। তারাই বেশি প্রাধান্য পেত।
৩. চাকলা গঠন : রাজস্ব আদায়ের সুবিধার জন্য তিনি স বাংলাকে ১৩টি চাকলায় এবং ১৬৬০টি পরগণায় ভাগ করে প্রতি চাকলায় একজন আমিন নিযুক্ত করেন।
৪. মালজামিনি ব্যবস্থা : ভূমি জরিপের পর যে পরিমাণ রাজস্ব আনার করবেন বলে নির্ধারিত হয় ইজারাদারদের রাজ্য আদায়ের পূর্বেই সে পরিমাণ টাকার চুক্তিপত্রে সই করে নিতে হতো।
একই মাল-জামিনি ব্যবস্থা বলে। কিন্তু নির্ধারিত তারিখে রাজস্ব জমা দিতে না পারলে বিশেষ শাস্তির ব্যবস্থা ছিল।
৫. হিসাবরক্ষণ ও নিরীক্ষণ : তিনি রাজস্ব আদায়ের জন্য সার্বিক হিসাবরক্ষণ, সংরক্ষণ ও নিরীক্ষণের যথাযথ ব্যবস্থা করেন। এজন্য তিনি দুটি স্বাধীন পদ্ধতি অবলম্বন করেন।
গ্রাম পাটোয়ারীগণ এক দফা হিসেব রক্ষা করতেন। উভয়ের সমন্বিত হিসাবরক্ষণের ফলে তার রাজস্ব ক্রমান্বয়ে সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে উন্নীত হয়।
— জটিল পরিস্থিতির মোকাবিলায় কৃতিত্ব : মালজামিনি ব্যবস্থা প্রবর্তনের ফলে বরখাস্তকৃত রাজস্ব প্রতিনিধিরা মুর্শিদকুলি খানের বিরোধিতা করে সম্রাট আওরঙ্গজেবের কাছে তাঁর বিরুদ্ধে ইজারাদার কর্তৃক প্রজা হয়রানির অভিযোগ করে।
এ অভিযোগ শুনে আগুঙ্গজেব মুর্শিদকুলি খানের কাছে পত্র পাঠালে তিনি তার নব প্রবর্তিত রাজস্ব ব্যবস্থার সব বর্ণনা দিয়ে সম্রাটকে পত্র দেন এবং বলেছেন, কৃষকদের নিরাপত্তার সব ব্যবস্থা করা হয়েছে।
তাদের সুবিধার জন্য রাজস্ব আদায়ে কিস্তির ব্যবস্থাও করা হয়েছে। তাই এ ব্যবস্থায় সম্রাট খুশি হয়ে তাকে তিনটি প্রদেশের ক্ষমতাসম্পন্ন দিওয়ান নিয়োগ করেন।
শাহজাদা আজীমুদ্দিনের সম্পত্তির দিওয়ানরূপেও তাকে পূর্ণ ক্ষমতা দেওয়া হয়। পরবর্তীতে বাংলার সুবাদার হিসেবে নিয়োগ করা হয়।
যার মাধ্যমে তিনি স্বাধীন নবাবি বংশ প্রতিষ্ঠা করে। বাংলার সামগ্রিক জীবনে তার সুবাদারি, রাজস্ব ও শাসনব্যবস্থার প্রভাব নিম্নরূপে-
১. অর্থনৈতিক সংস্কারে ব্যয়সংকোচন নীতি : অর্থনৈতিক সংস্কারের মাধ্যমে তিনি প্রতিরক্ষা খাতেও রাজস্ব আদায় খরচ কমিয়ে রাজকোষের আয় বৃদ্ধি করেন।
২. বেআইনি কর বিলোপ : তিনি বাংলার জমিদারদের রাজস্ব দপ্তরের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণে এনে সবরকম বেআইনি কর রহিত করেন।
৩. প্রজাশোষণের অবসান : তার সংস্কারের ফলে প্রজারা পূর্বের সুবাদারি ও দেওয়ানি এ দ্বৈত শাসনের শোষণ থেকে জনগণকে মুক্ত করেন।
৪. রাজস্ব উন্নতি ও সরকারি আয় বৃদ্ধি : তার প্রবর্তিত সংস্কারের ফলে রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে পূর্বে যেখানে ঘাটতি হতো মালজামিনি ব্যবস্থা প্রচলনের পর সে ঘটতি দূর হয়েও দেড় লক্ষ টাকা উদ্বৃত্ত থাকে।
তিনি জমিদার ও ইজারাদারদের উপর একটা নতুন কর চাপান যার নাম আবওয়াব-ই-খাসনাবিল”। যেটা হতে ২,৫০,৮৭৫ টাকা আয় হতো। যাহোক প্রতিবছর কেন্দ্রে তিনি ১ কোটি ৩০ লক্ষ টাকা পাঠাতে সমর্থ হন।
৫. প্রজাদের অবস্থার উন্নতি : পূর্বে প্রজা তথা কৃষকদের # অত্যাচারী কর আদায়কারীর মর্জির উপর নির্ভর করতে হতো। কিন্তু তার ব্যবস্থার উন্নতিতে প্রজাদের নিকট হতে অতিরিক্ত কোন কর আদায় করা হতো না। ফলে প্রজাদের উৎপীড়ন হ্রাস পায়।
৬. নির্দিষ্ট রাজস্ব : ভূমি রাজস্ব আয় বাবদ তিনি প্রায় দেড় কোটি টাকা নির্ধারণ করে দিতেন এবং তা নির্দিষ্ট হারে আদায় হতো। বাণিজ্য শুল্ক হতেও অনেক টাকা হতো।
৭. সাবেক জমিদারি ধ্বংস : তিনি আমিন বাইজারাদারদের নামে এক নতুন শ্রেণির উৎপত্তি ঘটান। সংস্কারের মাধ্যমে পুরাতন জমিদার বিশেষ করে মুঘলমান জমিদারদের সংখ্যা কমিয়ে দেন।
৮. নতুন শ্রেণির উদ্ভব : মুঘলমানদের পরিবর্তে তিনি বাঙালি হিন্দুদেরকে বিভিন্ন সরকারি পদে নিয়োগ ও জমিদারি অর্পণ করেন। ফলে একটি হিন্দু নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণি গড়ে ওঠে।
৯. কৃষি উন্নতি : তার সংস্কারের ফলে একদিকে কৃষকরা যেমন আগের, শোষণ পীড়ন রক্ষা পায়, অপরদিকে কৃষকদের স্বার্থ সংরক্ষিত হওয়ার প্রয়োজন অনুসারে সরকার থেকে. কৃষকদের ঋণদানের নীতি গৃহীত হয়। ফলে কৃষির যথেষ্ট উন্নতি সাধিত হয়।
১০. উদার শাসননীতি : তাঁর শাসনামলে দেশে শান্তি শৃঙ্খলা বিরাজ করে ফলে প্রজাদের কর দেয়ার ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। তিনি হিন্দুদের বিভিন্ন পদে বসিয়ে মুঘলমানদের একচেটিয়া প্রশাসনিক আধিপত্য থেকে জনগণকে মুক্ত করে এক উদার শাসননীতির প্রবর্তন করেন। তার মুদ্রানীতিতে তেমন কোন সাফল্য আনতে পারেননি।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, বাংলার রাজনৈতিক আকাশ যখন মেঘাচ্ছন্ন এবং অর্থনৈতিক অবস্থা যখন দুর্দশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল।
ঠিক সে দুর্যোগপূর্ণ মুহূর্তে বাংলার দেওয়ান ও সুবাদার হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করে মুর্শিদকুলি খান স্বীয় ব্যক্তির বিচক্ষণতা, অভিজ্ঞতা ও বুদ্ধিমত্তা দ্বারা বাংলায় সুশাসন প্রতিষ্ঠা করে এবং বিশেষ করে রাজস্ব সংস্কার প্রবর্তন করে ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে রয়েছেন।