সংস্কৃতির উপাদান সমূহ সংক্ষেপে আলোচনা করো
সংস্কৃতির উপাদান সমূহ সংক্ষেপে আলোচনা করো |
সংস্কৃতির উপাদান সমূহ সংক্ষেপে আলোচনা করো
- অথবা, সংস্কৃতির উপাদানগুলো ব্যাখ্যা কর।
উত্তর ৷ ভূমিকা : মানবজীবনের নিজস্ব স্বকীয়তার বিকাশের ক্ষেত্র হিসেবে সংস্কৃতির ভূমিকা অতুলনীয়। সংস্কৃতি মানুষ জন্মগতভাবে পায় না, এটাকে অর্জন করতে হয়।
মানুষ তার পারিপার্শ্বিক অবস্থা থেকে সংস্কৃতির শিক্ষা অর্জন করে থাকে। সমাজবিজ্ঞানী রস সংস্কৃতি সম্পর্কে বলেন, "Culture is the total acquired behaviour patterns transmitted by immitation or instruction."
সকল মানুষ সমাজবদ্ধভাবে বসবাস করে। এরিস্টটল বলেছেন, "Man is by nature a social or political being." অর্থাৎ, মানুষ স্বভাবতই সামাজিক অথবা রাজনৈতিক জীব।
সংস্কৃতি কোন একক উপাদানের সমন্বয়ে গড়ে উঠে না। এটা অনেকগুলো উপাদানকে একত্রিত করে গড়ে উঠে। একটা মানুষ তাঁর সংস্কৃতির মাধ্যমে পরিপূর্ণভাবে নিজেকে বিকশিত করার সুযোগ পায় ।
সংস্কৃতির উপাদানসমূহ : সংস্কৃতি কোন একক উপাদানের সমন্বয়ে গঠিত নয়। এটা বিভিন্ন উপাদানের সমন্বয়ে গড়ে উঠে। পৃথিবীতে অনেক বস্তু থাকলেও সকল বস্তুই সংস্কৃতির উপাদান হিসেবে গণ্য করা যায় না।
কেবল যেসব বস্তু মানুষের প্রয়োজন মিটায় ও মানুষের জীবনে সঠিক পথের সন্ধান পেতে সাহায্য করে কেবল সে বস্তুকেই সংস্কৃতির উপাদান হিসেবে গণ্য করা হয়।
তবে যেসব বস্তু মানুষের প্রয়োজন মিটায় না বা জনকল্যাণের পথ নির্দেশ করে না সেগুলো সংস্কৃতির উপাদান হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা যুক্তিসঙ্গত নয়।
মানুষ তার বহুবিধ ও বিভিন্ন অভাব পূরণের জন্য বিভিন্ন পথ অবলম্বন করে। আর এ উপায়সমূহ অর্থাৎ পৃথক পৃথক ব্যক্তির পৃথক পৃথক পন্থাগুলো সংস্কৃতির উপাদান হিসেবে গণ্য করা হয়।
তবে পৃথিবীর সকল দেশের সকল মানুষের সংস্কৃতি একই প্রকৃতির নয়। মানুষের আচার আচরণের ও পরিবেশগত পার্থক্যের কারণে সংস্কৃতির পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। তবে সার্ধিক দৃষ্টিকোণ থেকে সংস্কৃতির উপাদানসমূহ দু'টি ভাগে বিভক্ত করা যায় :
১. বাস্তব বা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য উপাদান (Material element) এবং
২. মানসিক বা অবস্তুগত উপাদান (Mantal or non-material element)।
নিম্নে উপরিউক্ত দু'টি উপাদানের পূর্ণাঙ্গ ব্যাখ্যা করা হল :
১. বাস্তব বা ইন্দ্ৰিয়গ্রাহ্য উপাদান (Material element) : সংস্কৃতির মাধ্যমে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বা রাষ্ট্রের নিজস্ব স্বকীয়তা ফুটে উঠে । সংস্কৃতি যখন বাস্তব রূপ লাভ করে কিংবা যখন সকলের নিকট প্রকাশিত হয় তখন সেটা বাস্তব বা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য উপাদান হিসেবে গণ্য হয়।
সংস্কৃতির বাস্তব উপাদানসমূহের মধ্য দিয়ে মানুষের মানসিক ধারণাসমূহ ও মূল্যবোধ এর পরিপূর্ণ চিত্র প্রকাশিত হয়। সংস্কৃতির এসব বস্তুগত বা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য উপাদানসমূহ অপ্রতীকী উপাদান হিসেবে অভিহিত হয় ।
বস্তুগত বা বাহ্যিক উপাদানের ক্ষেত্রে মানুষ তার বিচারবুদ্ধি ও জ্ঞান এবং কর্মকুশলতাকে খাটিয়ে বিবিধ বস্তু বা বাহ্যিক জিনিস উৎপাদন করে ।
এসব বস্তুর মধ্যে আবার কতকগুলোর মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির পরিপ্রেক্ষিতে বিশেষ মূল্যমান বা আদর্শ পরিলক্ষিত হয়।
আর এসব আদর্শমণ্ডিত বাহ্যিক বস্তুগুলো সংস্কৃতির দ্যোতক হিসেবে গণ্য করা হয়। উদাহরণস্বরূপ, ঘড়বাড়ি, স্কুল, কলেজ, মসজিদ, মাদ্রাসা, অফিস আদালত ইত্যাদি উপাদানসমূহ সংস্কৃতির বাহ্যিক উপাদানের পর্যায়ভুক্ত।
প্রত্যেক মানুষ তার নিজের ইচ্ছা ও কর্মপ্রচেষ্টার দ্বারা এ সমস্ত ভিন্ন ভিন্ন বস্তুগুলো তৈরি করেছে। এসব ঘরবাড়ি তথা ইমারতের ক্ষেত্রে একমাত্র চুনসুরকি, সিমেন্ট বালি বা ইট পাথরের সমাবেশই যথেষ্ট নয়, বরং পৃথক দৃষ্টিভঙ্গি বা মূল্যবোধ এর মাধ্যমে মানুষ এসব বস্তুগুলোর দ্বারা ভিন্ন ভিন্ন আদর্শের প্রকাশ ঘটায়।
তবে সময়ের আবর্তে এসব বাহ্যিক উপাদানের পরিবর্তন হয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, প্রাচীন সমাজব্যবস্থায় যেসব বাহ্যিক উপাদান সংস্কৃতিকে প্রভাবিত করেছে বর্তমানে সেসব বাহ্যিক উপাদানের অনেক পরিবর্তন সাধন হয়েছে।
বর্তমানে আধুনিক ইমারত তথা Multistored buildings সংস্কৃতির Patterns বা ধরন পরিবর্তন করতে বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছে।
আবার প্রাচীন কালের অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার স্থলে বর্তমানে আধুনিক ও উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা ও অবকাঠামো গড়ে উঠছে, যা সংস্কৃতির ক্ষেত্রে গতিশীলতা বৃদ্ধি করছে।
বর্তমানে স্যাটেলাইট ও ইন্টারনেটের বদৌলতে সহজেই এক দেশের সংস্কৃতি অন্য দেশে প্রবেশ করছে ।
২. মানসিক বা অবস্তুগত উপাদান (Mantal or non-material element) : মানুষের ব্যক্তিগত জীবনে যেসব উপাদান বাহ্যিক বা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয় অর্থাৎ যেসব উপাদান প্রকাশ পায় না সেগুলো মানসিক বা অবস্তুগত উপাদান হিসেবে গণ্য করা হয়।
এসব অবস্তুগত উপাদান মানুষের উপলব্ধি বা অনুধাবনের মাধ্যমে সৃষ্ট। এক্ষেত্রে ব্যক্তির নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি, আদর্শ বিশ্বাস, ধ্যানধারণা, মতাদর্শ, আনন্দ বেদনা, মূল্যবোধ, মানসিক চিন্তাশক্তি, অনুভূতি ইত্যাদি প্রকাশ পায়।
এসব উপাদানগুলোকে আবার প্রতীকী উপাদান হিসেবেও স্বীকার করা যায়। উদাহরণস্বরূপ জ্ঞান, বিশ্বাস, নাটক, সাহিত্য, শিল্পদর্শন, ভাষা, আচার-অনুষ্ঠান, নৃত্যকলা, সঙ্গীত, খেলাধুলা ইত্যাদি প্রতীকী উপাদান (Symbolic elements) ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতির পরিচায়ক।
এসব উপাদানের মাধ্যমে ভিন্ন ভিন্ন সমাজের ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতি ও লোকাচারের প্রকাশ পায় এবং এ লোকাচারের মাধ্যমে মূলত দেশীয় সংস্কৃতিক উপাদানগুলো সকলের জন্য উন্মুক্ত হয়ে উঠে।
আবার এসব উপাদানের মধ্য দিয়ে মানুষের মেধাপ্রতিভা, বুদ্ধিবৃদ্ধি ও আনন্দ বেদনা, আশা-আকাঙ্ক্ষা ইত্যাদি প্রকাশিত হয়। তবে বাহ্যিক উপাদানের মাধ্যমে অবস্তুগত উপাদানের ধ্যানধারণাগুলো পরিপূর্ণতা পায় ।
উপসংহার : উপরিউক্ত আলোচনা সাপেক্ষে বলা যায় যে, মানুষের সংস্কৃতি বিকাশে বাহ্যিক ও অবাহ্যিক উপাদান উভয়ই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
মূলত বাহ্যিক উপাদানের মাধ্যমে সংস্কৃতিগত উপাদানের যে পরিপূর্ণতা পাওয়া যায় এর শিকড় নিহিত থাকে ব্যক্তি বা রাষ্ট্রের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও চিন্তাচেতনায় যেগুলো অবাহ্যিক উপাদান হিসেবে পরিচিত। এজন্য সমাজবিজ্ঞানী জোনস (Jones) বলেছেন, "Culture is the sum of man's creations.