সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য গুলো কি কি । সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য আলোচনা কর
সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য গুলো কি কি । সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য আলোচনা কর |
সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য গুলো কি কি । সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য আলোচনা কর
উত্তর : ভূমিকা : সৃষ্টির আদিকাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত অর্থাৎ আদিম যুগ থেকে আধুনিক যুগ পর্যন্ত মানুষ তার নিজস্ব সংস্কৃতির মধ্যে বেড়ে উঠেছে।
সেজন্য রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞানে সংস্কৃতির ধারণাটি অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা হয়। সংস্কৃতি মানবসমাজকে আজ উন্নত পর্যায়ে নিয়ে এসেছে।
একমাত্র সংস্কৃতির মাধ্যমে মানুষ তাঁর নিজস্ব স্বকীয়তা ফুটিয়ে তুলতে পারে। সংস্কৃতি সম্পর্কে অধ্যাপক ম্যালিনোস্কি তাঁর 'Scientific Theory of Culture' গ্রন্থে বলেছেন, "Culture is the hardwork of man and the medium through which he achieves him ends. " অর্থাৎ মানুষের বড় অর্জনই সংস্কৃতি যা প্রাণী হিসেবে উৎকৃষ্টতা অর্জন করেছে।
সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য : সংস্কৃতির উপরিউক্ত সংজ্ঞাগুলো বিশ্লেষণ করলে সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে কিছুটা ধারণা পাওয়া যায়। তবে সংস্কৃতি সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা লাভ করতে হলে নিম্নোক্ত বৈশিষ্ট্যগুলো আলোচনা করা আবশ্যক :
১. সংস্কৃতি মানুষের বাহ্যিক ধারণা নয় : সংস্কৃতি মানুষের অবস্তুগত ধারণা থেকে উদ্ভূত। মানুষের বাইরের খোলস বা চাকচিক্য থেকে সংস্কৃতিকে বিশ্লেষণ করা যায় না। সংস্কৃতিকে বুঝতে হলে মানুষের গভীরে প্রবেশ করতে হয়।
২. সংস্কৃতি শিক্ষণীয় বিষয় : সংস্কৃতি কোন জৈবিক ধারণা নয় যে এটা বংশপরম্পরায় বর্তাবে, বরং শিক্ষার মাধ্যমে সংস্কৃতিকে অর্জন করতে হয়। সংস্কৃতি হল মানুষের সাথে আচরণ করার প্রক্রিয়া বিশেষ, যা সর্বদা শিক্ষার মাধ্যমে অর্জন করে।
যেমন— কাউকে ধন্যবাদ জানানো বা কাপড় পরিধান করা, প্লেটে খাবার গ্রহণ, পূজাপার্বণ বা নামাজ পড়ার মত বিষয় যা সাংস্কৃতিক পরিবেশের মাধ্যমে সকলে তা আয়ত্ত করে ।
৩. সংস্কৃতি একটি সামাজিক ধারণা : সংস্কৃতি মূলত সমাজেরই একটা উপাদান। কোন ব্যক্তিবিশেষ সংস্কৃতিকে তৈরি করতে পারে না।
সামাজিক সম্পর্কের মাধ্যমেই সংস্কৃতি বিকশিত হয়, যা সমাজের সদস্যদের অংশগ্রহণের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়। একটি মানবিক পরিবেশেই সংস্কৃতির সাহায্যে মানুষ বিভিন্ন মানবীয় গুণাবলি অর্জন করে ।
৪. সংস্কৃতি পরিবর্তনশীল : সংস্কৃতি একটা পরিবর্তনশীল প্রক্রিয়া। এটা প্রতিনিয়ত মানুষের প্রয়োজনে পরিবর্তিত হয়। এর অন্য ব্যাখ্যা হল বস্তুগত সংস্কৃতি সর্বদা পরিবর্তিত হয়।
৫. সংস্কৃতি অংশীদারিত্বমূলক : মানুষের পরস্পর অংশগ্রহণের মাধ্যমে সংস্কৃতি গড়ে উঠে। এটা কোন ব্যক্তির একার পক্ষে গড়ে তোলা সম্ভব নয়।
সমাজের প্রত্যেক সদস্যদের অংশগ্রহণের মাধ্যমে সংস্কৃতি বিকশিত হয়। উদাহরণস্বরূপ, প্রথা, ঐতিহ্য, বিশ্বাস, ধারণা ও নৈতিকতা প্রভৃতি বিষয়গুলো সমাজ বা গোষ্ঠীর অংশীদারিত্বের মাধ্যমে গড়ে উঠে।
৬. সংস্কৃতি বিনিময়যোগ্য : সংস্কৃতি এমন একটি ধারণা যা এক প্রজন্য থেকে অন্য প্রজন্মে হস্তান্তর করা যায়। মাতাপিতা তাদের সন্তানদেরকে যে শিক্ষা দেয় এবং পরবর্তীতে তারা আবার তাদের পরবর্তী প্রজন্মকে তাদের পূর্বসূরিদের কাছে পাওয়া শিক্ষা উত্তরসূরিদের মধ্যে প্রবাহিত করে। ফলে সংস্কৃতি এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্যে বিনিময় হস্তান্তর হয়।
৭. ভাষা সংস্কৃতির বাহন : সংস্কৃতি বংশের মাধ্যমে নয়, বরং তা ভাষার মাধ্যমে একে অপরের মধ্যে প্রবাহিত বা বিনিময় হয়। ফলে সংস্কৃতির প্রধান বাহন হিসেবে ভাষাকে বিবেচনা করা হয়।
৮. সংস্কৃতি চলমান : সংস্কৃতি একটি চলমান প্রক্রিয়া বিশেষ। এ চলমান প্রক্রিয়া ক্রমবর্ধমান ধারাবাহিকতায় চলছে। সংস্কৃতি অতীত ও বর্তমানের মাঝে সেতুবন্ধ হিসেবে ভবিষ্যৎকে আরও উন্নত পর্যায়ে নিতে সর্বদা সক্রিয় থাকে। Robert Bierstedt বলেন, “সংস্কৃতি হল মানবগোষ্ঠীর মস্তিষ্ক”।
৯. মানুষই সংস্কৃতির স্বতাধিকারী : সংস্কৃতি প্রত্যয়টি একমাত্র মানুষের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য কেননা মানুষই তার সংস্কৃতিকে ধারণ করে রাখতে পারে। সেজন্যই MacIver and Page বলেন, “সংস্কৃতি মানুষ ও জীবজন্তুর মধ্যে পার্থক্য পরিমাপ করে।”
১০. সংস্কৃতি হল সঙ্গতিপূর্ণ ও সুসংহত : সংস্কৃতি সর্বদা প্রচলিত সমাজব্যবস্থার সাথে নিজের স্বকীয়তা বজায় রেখে সর্বদা নিজেকে সঙ্গতিপূর্ণ রাখে ও সুসংহত করে। যেমন— সমাজের মূল্যবোধ ব্যবস্থা নৈতিকতা, ধর্ম, প্রথা, ঐতিহ্য ও বিশ্বাস ইত্যাদির সাথে সম্পর্কযুক্ত।
১১. সংস্কৃতির পরিমাপযোগ্যতা নেই : সংস্কৃতি একটা ব্যাপক প্রক্রিয়া। এটার কখনও নির্দিষ্ট পরিমাপ করা যায় না। উদাহরণস্বরূপ, শিল্প, সাহিত্য, ভাস্কর্য ইত্যাদির বস্তুগত দিকের চেয়ে সংস্কৃতির মূল্য তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি।
১২. সংস্কৃতির ভিন্নতা : সংস্কৃতির ভিন্নতা একটা অনন্য বৈশিষ্ট্য। কেননা প্রত্যেক সমাজে একই ধরনের সংস্কৃতি পরিলক্ষিত হয় না। এক সমাজের সাথে অন্য সমাজের সংস্কৃতির বিভিন্ন ধরনের অমিল থাকে।
যেমন- বাঙালি সংস্কৃতির সাথে পাশ্চাত্য সংস্কৃতির রীতিনীতি, প্রথা, ঐতিহ্য, বিশ্বাস প্রভৃতি থেকে পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়।
১৩. সংস্কৃতি হল একটা অতি জৈবিক প্রক্রিয়া : সংস্কৃতিকে অনেক সময় অতি জৈবিক প্রক্রিয়া হিসেবে অভিহিত করা হয়। Herbert Spencer বলেছেন, সংস্কৃতি জৈবও না, অজৈবও না বরং এ দু'টির ঊর্ধ্বে।
Superorganic বা অভি জৈব শব্দটি বাহ্যিক বস্তু বা বাহ্যিক আচরণের সাথে সামাজিকতাকে যুক্ত করে। যেমন— জাতীয় পতাকার সামাজিক অর্থ এক টুকরো রঙিন কাপড় নয়। পতাকা একটা জাতির সার্বভৌমত্বের প্রতীক হিসেবে গণ্য ।
উপসংহার : উপরিউক্ত আলোচনা থেকে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, সংস্কৃতি মানুষের বাহ্যিক আচার আচরণকে বিশ্লেষণ করে এবং মানুষকে অন্য প্রাণী থেকে পৃথক করতে সাহায্য করে।
প্রত্যেক মানুষ তথা জাতির নিজস্ব সংস্কৃতির মাধ্যমে তার স্বকীয়তা ভাস্বর হয়ে উঠে। মানুষকে উন্নত পর্যায়ে নিতে গতিশীল করতে সংস্কৃতিই তাকে বলিষ্ঠভাবে উৎসাহ যোগায়।
কেননা কোন মানুষই বা জাতিই তার নিজস্ব সংস্কৃতিকে বিসর্জন দিতে রাজি নয়। এজন্য সমাজবিজ্ঞানী রস বলেন, "Culture is the total acquired behaviour patterns transmitted by imitation or instruction."