সংস্কৃতির বিষয়বস্তু ও কার্যাবলি আলোচনা কর
সংস্কৃতির বিষয়বস্তু ও কার্যাবলি আলোচনা কর |
সংস্কৃতির বিষয়বস্তু ও কার্যাবলি আলোচনা কর
- অথবা, সংস্কৃতির বিষয়বস্তু ও কার্যাবলিসমূহ ব্যাখ্যা কর।
উত্তরঃ ভূমিকা : সামাজিক বিজ্ঞানের আলোচনায় সংস্কৃতি প্রত্যয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত হয়। রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞানের আলোচনায় সংস্কৃতি মানুষকে রাষ্ট্রের 'Political Culture' সাথে গঠনগত দিক নিয়ে আলোচনার যার উন্মুক্ত করে।
এক্ষেত্রের Robert Bierstedt তাঁর Social Order বইতে বলেছেন, "Culture is one of the most important concept in contemporary social science." সংস্কৃতি মানবসমাজকে আজ উন্নত পর্যায়ে নিয়ে এসেছে।
একমাত্র সংস্কৃতির মাধ্যমে মানুষ তার নিজস্ব স্বকীয়তা ফুটিয়ে তোলা। সেক্ষেত্রে রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে সংস্কৃতি একটা সহায়ক উপাদান হিসেবে কাজ করে।
সংস্কৃতির বিষয়বস্তু : পৃথিবীর প্রত্যেক সমাজেই কিছু নিজস্ব সংস্কৃতি পরিলক্ষিত হয়। তবে সকল রাষ্ট্রের সংস্কৃতির চরিত্র একই রকম নয়।
অনেক ক্ষেত্রে সংস্কৃতির কিছু বৈষম্য পরিলক্ষিত হয়। আবার সংস্কৃতির ঐক্যের দিকটিও খাটো করে দেখার অবকাশ নেই।
যেমন- মানুষ ভিন্ন ভিন্ন দেবতাকে পূজা বা আরাধনা করতে পারে কিন্তু এদের সবারই একটা নিজস্ব ধর্ম রয়েছে। তারা সকলে ভিন্ন ভিন্ন পেশার লোক হলেও সবাই জীবনধারণের নিমিত্তে কাজ করে।
এভাবে প্রত্যেক সমাজই কিছু Non-material বা অবস্তুগত বিষয়কে ধারণ করে থাকে এবং এর মাধ্যমে তার আপন স্বকীয়তা প্ৰকাশ পায় ।
আবার প্রত্যেক সমাজে কিছু বস্তুগত বিষয় রয়েছে। এসব বস্তুগত বিষয়গুলো আদি বা আধুনিক এবং সরল বা জটিল প্রকৃতির হতে পারে।
এ সংস্কৃতির বস্তুগত ও অবস্তুগত দিক দু'টির সমন্বয়ে 'The Content of Culture' গঠিত হয়। প্রত্যেক সমাজে তার সাংস্কৃতিক বিষয়বস্তুর ক্ষেত্রে এ দু'টি দিককে কেউ উপেক্ষা করতে পারে না।
অধিকাংশ সমাজবিজ্ঞানী সংস্কৃতিকে বস্তুগত ও অবস্তুগত দু'টি দৃষ্টিকোণ থেকে শ্রেণীবিন্যাস করেছেন। Robert Bierstedt বলেন, “সমাজের বস্তুগত সংস্কৃতি অধিকতর সংক্ষিপ্ত ও স্পষ্ট।
কিন্তু অবস্তুগত সংস্কৃতির ধরন অধিকতর বিমূর্ত ও কম স্পষ্ট।” এটাকে Residual Category হিসেবে বিবেচনা করা হয় ।
নিম্নে বস্তুগত সংস্কৃতি ও অবস্তুগত সংস্কৃতির বিভিন্ন দিক আলোচনা করা হল :
১. বস্তুগত সংস্কৃতি : বস্তুগত সংস্কৃতি মূলত মানুষ কর্তৃক স্পষ্ট দ্রব্য বা যে কোন ধরনের বস্তু। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, যন্ত্রাংশ, আসবাবপত্র, গাড়ি, দালানকোঠা, রাস্তাঘাট, কালভার্ট, সেতু প্রভৃতি।
এটি সমাজের পরিবর্তনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অনেক ক্ষেত্রে একে সভ্যতার একটি অংশ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
২. অবস্থাগত সংস্কৃতি : এখানে মানুষের মানবিক গুণাবলি বা অন্তস্থ বিষয়গুলো বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়। এক্ষেত্রে বলা হয় সংস্কৃতির ধরনটি মানুষের অন্তস্থ প্রকৃতির প্রতিফলনস্বরূপ।
এটা মূলত মানুষের সাধারণ বিষয়গুলোকে তুলে ধরে। যেমন- “মানুষের বিশ্বাস, ভাষণ, মূল্যবোধ, গুণাবলি, অভ্যাস, আচার আচরণ, দৃষ্টিভঙ্গি, পছন্দ, অপছন্দ ইত্যাদি বিষয়গুলোর মধ্যে প্রকাশ পায়।
বলা যায় আমরা প্রাত্যহিক জীবনে কি করছি এবং কি অনুভব করছি ও চিন্তা করছি এ সবই এ শ্রেণীর সংস্কৃতির অন্তর্ভুক্ত।
কার্যাবলি : মানুষ যে সমাজে বসবাস করে সে সমাজের সংস্কৃতির সাথে সে অভ্যন্ত হয়ে যায় ফলে বিভিন্ন সাংস্কৃতিকমূলক কর্মকাণ্ড করতে হয়।
সেজন্য বলা হয় "Man is a social and cultural being." অর্থাৎ মানুষ কেবল সামাজিক প্রাণীই নয় সাংস্কৃতিক প্রাণীও বটে।
নিম্নে সংস্কৃতির কার্যাবলিসমূহ উল্লেখ করা হল :
১. জ্ঞানের ক্ষেত্র হিসেবে : মানুষের বুদ্ধিবৃত্তিক, সামাজিক ও শারীরিক বিষয়গুলোর প্রতি সংস্কৃতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
পরিবেশের সাথে খাপখাওয়ানোর জন্য প্রয়োজনীয় কৌশল ও জ্ঞান সরবরাহের ক্ষেত্রে সংস্কৃতি একটা কার্যকর উপাদান।
২. সংস্কৃতি : বর্তমান অবস্থাকে তুলে ধরে সংস্কৃতি অতীত ও বর্তমান এর মধ্যে থেকে ভালোমন্দ দিকগুলো মানুষের সম্মুখে তুলে ধরে।
সে সাথে আমাদের খাবার, পোশাক পরিচ্ছন প্রভৃতি দিকগুলো সংস্কৃতি বর্তমান অবস্থার সাথে মানিয়ে চলতে সাহায্য করে।
৩. অতীত ও বর্তমানের সেতুবন্ধ : সংস্কৃতি অতীত ও বর্তমান সময়ের মধ্যে সেতুবন্ধ হিসেবে কাজ করে। সেক্ষেত্রে অতীত ও বর্তমান সময়ের ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিকসমূহের পূর্ণ বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে একটা গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র হিসেবে কাজ করে।
৪. মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি, মূল্যবোধ ও লক্ষ্যের ক্ষেত্রে : সংস্কৃতি মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি, মূল্যবোধ ও লক্ষ্যকে বাস্তব রূপদান করে। আমাদের মূল্যবোধ উচিত বা অনুচিত বিষয়গুলো পরিমাপের ক্ষেত্রে সমসাময়িক সংস্কৃতি আমাদের শিক্ষা দিয়ে থাকে। সেক্ষেত্রে আমাদের মূল্যবোধের সঠিক প্রকাশ ঘটে।
৫. জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণে : অনেক ক্ষেত্রে ব্যক্তির লক্ষ্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে সংস্কৃতি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র হিসেবে কাজ করে । একজন চিকিৎসক, রাজনীতিবিদ, প্রকৌশলি সকলেই তাদের ভিন্ন ভিন্ন লক্ষ্য নির্ধারণে নিজস্ব সংস্কৃতির ধারা বজায় রাখে ।
৬. মানুষের ব্যক্তিত্ব গঠনে : সংস্কৃতি ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব নির্ধারণে অন্যতম সহায়ক উপাদান হিসেবে কাজ করে। শিশু যেমন তার পরিবেশ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে বড় হয়, তেমনি প্রত্যেক ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব বিকাশে নিজস্ব পরিবেশ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে । সেক্ষেত্রে সংস্কৃতি তার পরিবেশের বিভিন্ন চিত্রগুলো মানুষের সামনে তুলে ধরে।
৭. নিজের ও অপরের আচরণ নির্ধারণে : সংস্কৃতি যেমন নিজের আচরণ নির্ধারণ করে, তেমনি সে সাথে অপরের আচরণ নির্ধারণে সহায়ক ভূমিকা রাখে।
প্রত্যেক ব্যক্তি তার নিজস্ব সংস্কৃতিকে বিকশিত করে তোলে। সেক্ষেত্রে তার আচরণের বহিঃপ্রকাশ ঘটে এবং নিজেকে অন্যের থেকে উন্নত পর্যায়ে নিতে সচেষ্ট হয়।
উপসংহার : উপরিউক্ত আলোচনা শেষে বলা যায় যে, পৃথিবীর বিভিন্ন জাতি বা রাষ্ট্রের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতি পরিলক্ষিত হলেও সকল সমাজের মৌলিক লক্ষ্য নির্দিষ্ট থাকে।
তবে মানুষের ব্যক্তিত্ব বিকাশে ও মানুষকে উন্নত পর্যায়ে পৌছাতে সংস্কৃতির ভূমিকাকে কেউ কখনও অস্বীকার করতে পারে না।
সুতরাং বলা যায়, সংস্কৃতির কার্যাবলি মানুষের জীবনে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এ প্রসঙ্গে ম্যালিনোস্কি বলেন, "Culture is the hardwork of man and the medium which he achieves him ends."