সংস্কার ও বিপ্লবের মধ্যে পার্থক্য লেখ । সংস্কার ও বিপ্লবের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় কর
সংস্কার ও বিপ্লবের মধ্যে পার্থক্য লেখ । সংস্কার ও বিপ্লবের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় কর |
সংস্কার ও বিপ্লবের মধ্যে পার্থক্য লেখ । সংস্কার ও বিপ্লবের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় কর
- অথবা, বিপ্লব বলতে কী বুঝ? সংস্কার ও বিপ্লবের মধ্যে পার্থক্য লিখ ।
উত্তর : ভূমিকা : সংস্কার ও বিপ্লব দু'টি প্রত্যয় যদিও ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা হয়, তবে এ দু'টি আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার উন্নয়নের ক্ষেত্রে এবং সামাজিক পরিবর্তনশীলতা আনয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
সমাজ প্রতিনিয়তই পরিবর্তনশীল। আর এ পরিবর্তন কখনও দ্রুত আবার কখনও ধীরগতিতে সম্পন্ন হচ্ছে। তবে একথা সত্য যে, বিপ্লব ও সংস্কারের মধ্য দিয়েই সমাজব্যবস্থা সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে।
বিপ্লব (Revolution) : বিপ্লব অর্থ পরিবর্তন, গতানুগতিকতা থেকে আধুনিক উন্নত পর্যায়ে সংস্করণ। অর্থাৎ গতানুগতিক সমাজব্যবস্থার পরিবর্তন করে আধুনিক সমাজব্যবস্থার জন্ম দেয়ার নাম বিপ্লব।
সাধারণভাবে বিপ্লব বলতে সহিংস পথে একদল অপর দল শাসকের পরিবর্তনকে বুঝায়। আধুনিক অর্থে বিপ্লব হল এমন একটি দিক যেখানে সমাজব্যবস্থার সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক সকল পর্যায়ে পরিবর্তন আসবে।
প্রামাণ্য সংজ্ঞা : নিম্নে কয়েকজন মনীষীর বিপ্লব সম্পর্কিত মতবাদ দেয়া হল :
কার্ল মার্কস (Karl Marx) বলেছেন, “সমাজ বিকাশের কোন এক পর্যায়ে উৎপাদনী শক্তিগুলো উৎপাদন সম্পর্কের সাথে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়।
যে সম্পর্কের মাঝে এতদিন তারা বিকশিত হচ্ছিল সেটাই এক সময় সেকেলে হয়ে পড়ে, আর তখনই তা রূপ নেয় সমাজ বিপ্লবের।"
মাও সেতুং এর কথায়, “বিদ্যমান বুর্জোয়া সমাজব্যবস্থার উচ্ছেদ করে এক শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা করার অর্থই হচ্ছে বিপ্লব।”
এরিস্টটল (Aristotle) এর মতে, "Any change of the government and constitution is called revolution." লেনিন (Lenin) বলেছেন, “বিপ্লব হচ্ছে সমাজব্যবস্থার গুণগত পরিবর্তন।
তিনি আরও বলেছেন, বিপ্লব হল একটি গণঅভ্যূত্থান, যে গণঅভ্যূত্থানের মাধ্যমে পুরাতন সমাজকে ভেঙে নতুন সমাজ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব।”
ফ্রেডারিক এঙ্গেলস এর মতে, “বিপ্লব হচ্ছে এমন এক হাতিয়ার যার সাহায্যে সামাজিক আন্দোলন সরল পথ ধরে এগিয়ে চলে।”
উপরিউক্ত আলোচনা থেকে আমরা বলতে পারি যে, বাংলাদেশের বর্তমান সামাজিক ও রাজনৈতিক কাঠামো সমাজে বিদ্যমান অবস্থার জন্য দায়ী।
বর্তমানে প্রচলিত কাঠামোর মধ্যে বসেই সুবিধাভোগী গোষ্ঠীগুলো তাদের স্বার্থরক্ষা করছে। । কাঠামোর এরূপ অবস্থা থেকে উত্তরণের একমাত্র উপায় হল বিদ্যমান সামাজিক কাঠামো ভেঙে দেয়া এবং নতুন নেতৃত্ব প্রচলিত করা। এজন্য সংস্কার নয় বিপ্লবই একমাত্র উপযুক্ত পথ।
সংস্কার ও বিপ্লবের মধ্যে পার্থক্য (Difference between reformation and revolution) : সংস্কার ও বিপ্লবের মধ্যে বিভিন্ন দিক দিয়ে পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়।
তুলনামূলক আলোচনার সাহায্যে উভয়ের মধ্যে পার্থক্য সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরা সম্ভব। তাই সংস্কার ও বিপ্লবের তুলনামূলক আলোচনা নিম্নে দেয়া হল :
১. বিপ্লবের ফলে অর্থনৈতিক মূল্যবোধ ও মানব চেতনার ক্ষেত্রে দ্রুত পরিবর্তন সাধিত হয়, যা সংস্কারে হয় না। বিপ্লবীরা ভালোমন্দ যে কোন উপায়ে সামাজিক পরিবর্তন আনয়নে আগ্রহী। এ পরিবর্তন আনয়নের জন্য
2. অনেক দুঃখদুর্দশা ও ত্যাগ স্বীকার করতে হয়। কিন্তু সংস্কারবাদীদের পরিবর্তন ধীর ও শান্তিপূর্ণ।
৩. বিপ্লবের লক্ষ্য সমাজের আমূল পরিবর্তন, কিন্তু সংস্কার বিদ্যমান সমাজের পরিবর্তনের মাধ্যমে সমাজের স্থায়িত্ব ও সংস্কারের জন্য সংকট।
৪. বিপ্লব রাজনীতিতে অনমনীয়তা বৃদ্ধি করে। অপরপক্ষে, সংস্কার রাজনীতিতে নমনীয়তা বৃদ্ধি করে।
৫. রাজনৈতিক মূল্যবোধের ক্ষেত্রে বিপ্লব দ্রুত পরিবর্তন আনয়ন করে। কিন্তু সংস্কারে এরূপ কোন পরিবর্তন আশা করা যায় না।
৬. সংস্কারকে সফলতার সাথে এগিয়ে নিতে হলে তাকে অবশ্যই সুনিপুণ রাজনীতিবিদ হতে হয়। অপরদিকে, বিপ্লবীদেরকে রাজনীতিবিদ না হয়ে বরং বিপ্লবী আদর্শের প্রতি অধিক তৎপর হতে হয়।
৭. বিপ্লবে বিপ্লবীদেরকে কেবল প্রতিক্রিয়াশীলদের বিরুদ্ধে লড়তে হয়। কিন্তু সংস্কারের ক্ষেত্রে রক্ষণশীল ও বিপ্লবীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হয়।
৮. সংস্কারের ক্ষেত্রে সমস্যা সমাধান করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা নির্বাচন করতে হয়। অপরপক্ষে, বিপ্লব সমাজের সার্বিক পরিবর্তন সাধন করে।
বিপ্লবের ফলে রক্তক্ষয় হয় কিন্তু সংস্কারের ফলে তা হয় না। বিপ্লব জনজীবনে অর্থনৈতিক বিপর্যয় ডেকে আনে, সংস্কারে সেরূপ অবস্থার সৃষ্টি হয় না ।
১০. বিপ্লব অতি অল্প সময়ের মধ্যে সংঘটিত হয় বলে বিপ্লবের পরে অর্থনৈতিক বিপর্যয় দেখা দিতে পারে। পক্ষান্তরে, সংস্কার খুব ধীরগতিতে হয় বলে অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের সম্ভাবনা খুব কম থাকে ।
১১. সংস্কারের ক্ষেত্রে সমাজের যে কোন নিয়মের আংশিক পরিবর্তন বা প্রচলিত সবগুলো নিয়মের মধ্যে অল্পসংখ্যকই পরিবর্তন করতে হয়।
তাই সংস্কারকে পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য পরিকল্পিতভাবে অগ্রসর হতে হয়। কিন্তু বিপ্লবের মাধ্যমে যেহেতু সমাজের আমূল পরিবর্তন হয় সেজন্য বিপ্লবীকে এরূপ ধীরগতিতে অগ্রসর হতে হয় না ।
১২. বিভিন্ন ফ্রন্টে সাধারণত সমাধির শক্তিগুলোকে কাজে লাগানোর ব্যাপারে বিপ্লবীর চেয়ে অধিকতর ক্ষমতা সংস্কারকের থাকতে হয়।
কিন্তু তাই যথেষ্ট নয়, বরং সামাজিক পরিবর্তন নিয়ন্ত্রণ করার ব্যাপারে তাকে অধিকতর বুদ্ধিমত্তা ও কার্যকারিতার পরিচয় দিতে হয় ।
১৩. বিপ্লবের মাধ্যমে সামাজিক পরিবর্তন সাধিত হয়। কিন্তু সংস্কার সমাজের আংশিক পরিবর্তন সাধন করে। যেমন— দেখা যায় যে, বিপ্লবের মাধ্যমে রুশ ও চীন দেশের রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে অভাবনীয় পরিবর্তন সাধিত হয়েছে।
অপরপক্ষে, সংস্কারের দ্বারা একটা আংশিক পরিবর্তন সূচিত হয়। যেমন- শিক্ষা সংস্কার, ভূমি সংস্কার, প্রশাসনিক সংস্কার ইত্যাদি।
উপসংহার : উপরিউক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, বিপ্লব সাধারণত সরকার ও রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করে। বিপ্লবের ফলে রাজনৈতিক উন্নয়ন ঘটে, এতে কোন সন্দেহ নেই।
তবে কোন কোন বিপ্লব দেশের জন্য চরম বিপর্যয় ডেকে আনে। কিন্তু সংস্কার ধীরগতিতে সাধিত হয়। জনগণ এর সাথে তাল মিলিয়ে চলতে পারে এবং রাষ্ট্রকে উন্নয়নের পথে এগিয়ে নেয়।