সনাতন সমাজের ভাঙ্গন ও আধুনিক সমাজের গোড়াপত্তন কিভাবে হয়েছিল
সনাতন সমাজের ভাঙ্গন ও আধুনিক সমাজের গোড়াপত্তন কিভাবে হয়েছিল |
সনাতন সমাজের ভাঙ্গন ও আধুনিক সমাজের গোড়াপত্তন কিভাবে হয়েছিল
- অথবা, কিভাবে সনাতন সমাজের ভাঙ্গন ও আধুনিক সমাজের গোড়াপত্তন হয়েছিল? আলোচনা কর ।
- অথবা, কিভাবে আধুনিক সমাজের সূচনা হয়? আলোচনা কর।
উত্তর : ভূমিকা : প্রাচীন বা আদিম সমাজের সঠিক ইতিহাস সম্পর্কে মানুষ সন্দিহান। কেননা প্রাচীন সমাজের ইতিহাস সম্পর্কে এবং আধুনিক সমাজের গোড়াপত্তন সম্পর্কে মানুষের কাছে সঠিক ইতিহাস নেই বললেই চলে।
মহামতি দার্শনিক এরিস্টটল বলেছেন, "Man is by nature a social being" মানুষ প্রকৃতিগতভাবে সামাজিক জীব।
সামাজিক পরিবেশে বসবাস করতে গিয়ে মানুষকে বিভিন্ন নিত্যনতুন সমস্যার সাথে মোকাবিলা করতে হয় আধুনিক সমাজব্যবস্থায় মূলত বিভিন্ন নিত্যনতুন সমস্যার মোকাবিলার মাধ্যমে টিকে থাকতে হয়। মূলত আধুনিক সমাজব্যবস্থা হচ্ছে প্রযুক্তি নির্ভর এবং বিজ্ঞানভিত্তিক ।
আধুনিক সমাজ : আধুনিক সমাজ মূলত একটি বিজ্ঞানভিত্তিক বা প্রযুক্তি নির্ভর সমাজব্যবস্থা। আধুনিক সমাজকাঠামো সনাতন সমাজ থেকে অনেক জটিল।
আধুনিক সমাজের সংজ্ঞা প্রসঙ্গে অধ্যাপক লার্নার বলেন, "Urbanization, industrialization, secularization, democratization, education media participation is the main factors of modern society."
তিনি আরও উল্লেখ করেন, শিল্পায়ন, গণতান্ত্রিকীকরণ এবং ধর্মনিরপেক্ষকরণ এ তিনটি আধুনিক সমাজের অন্যতম বৈশিষ্ট্যের অন্তর্গত।
আধুনিক সমাজব্যবস্থায় ব্যক্তির সামাজিক ও রাজনৈতিক মানমর্যাদা ও অবস্থান নির্ধারিত হয় যোগ্যতার ভিত্তিতে। এরূপ সমাজব্যবস্থায় সামাজিক গতিশীলতা খুব বেশি থাকে।
যুক্তিগ্রাহ্য আইনভিত্তিক (Rational-legal authority) তথা কর্তৃত্বের শাসন আধুনিক সমাজের প্রধান বৈশিষ্ট্য।
সনাতন সমাজের ভাঙন : প্রতিটি সমাজ বা সংগঠন ভাঙনের পিছনে কোন না কোন কারণ দায়ী, সনাতন সমাজ ভাঙনের প্রেক্ষিতে কতকগুলো কারণ কাজ করেছে, তা নিম্নে আলোচিত হল :
১. ঔপনিবেশিক প্রভাব : সনাতন সমাজ ভাঙনের প্রেক্ষিতে ঔপনিবেশিক প্রভাব অনেকাংশে দায়ী ছিল। বিশেষ করে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ এর ফলে সনাতন সমাজব্যবস্থার অস্তিত্ব ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হতে থাকে।
তাছাড়া একটি সমাজব্যবস্থা জারি হওয়ার পর এমন কিছু আইন জারি করা হয় যার প্রভাবে এ সমাজব্যবস্থা ভেঙে পড়ে।
২. রেনেসাঁর প্রভাব : রেনেসাঁর প্রভাব সনাতন সমাজ ভাঙনের ক্ষেত্রে অন্যতম সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করেছে। রেনেসার প্রভাবের কারণে জনমনে নতুন ধারা সংযোজিত হয়েছে।
তারা পুরাতন রীতিনীতির বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে আধুনিকতার দিকে ঝুঁকে পড়ে। ফলশ্রুতিতে সনাতন সমাজে ভাঙন দেখা দেয়।
৩. প্রযুক্তির উন্নয়ন : ঔপনিবেশিক শাসনের গোড়াপত্তনের পর এখানে দিনের পর দিন প্রযুক্তির উন্নয়ন ঘটতে থাকে । আর উন্নত প্রযুক্তির স্রোতে সনাতন সমাজ ভেঙে পড়ে।
৪. শিক্ষার প্রসার : ঔপনিবেশিক শাসনের গোড়াপত্তনের ফলে শিক্ষার ব্যাপক প্রসার হতে থাকে। ফলে সনাতন বা অন্ধকারাচ্ছন্ন সমাজের পতন হতে থাকে এবং ক্রমান্বয়ে সমাজব্যবস্থা আধুনিক সমাজের দিকে ধাবিত হতে থাকে।
৫. রাজনীতিতে জনগণের অংশগ্রহণ : শিক্ষার প্রসারের সাথে সাথে মানুষ সক্রিয়ভাবে রাজনীতিতে অংশগ্রহণের সুযোগ পায়। এর ফলে সমাজে রাজনৈতিক উন্নয়ন ঘটে। আর সে সময়ে সনাতন সমাজব্যবস্থার অপমৃত্যু ঘটে।
৬. দক্ষ নেতৃত্ব : রাজনৈতিক উন্নয়নের সাথে সাথে সনাতন সমাজব্যবস্থায় দক্ষ রাজনীতিবিদ গড়ে উঠে। ফলে জনগণ আর সনাতন বা অন্ধ সমাজে বসবাস করতে চায় না। এমতাবস্থায় তাদের কর্মসূচির কারণে সনাতন সমাজব্যবস্থা ভেঙে পড়ে।
৭. শিল্পের প্রসার : শিল্পের প্রসারের ফলে জনগণের জীবনমানের উন্নয়ন ঘটতে থাকে। ফলে সনাতন সমাজের প্রতি মুখাপেক্ষী না হয়ে মানুষ আধুনিক সমাজের দিকে ধাবিত হয়।
আধুনিক সমাজের গোড়াপত্তন : মূলত সনাতন সমাজব্যবস্থার ভাঙনের প্রেক্ষিতেই আধুনিক সমাজের গোড়াপত্তন শুরু হয়।
নিম্নে আধুনিক সমাজের গোড়াপত্তনের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস আলোচনা করা হল :
১. মনোবলের প্রভাব : সনাতন সমাজ ভাঙনের প্রেক্ষিতে মনোবল একটা বড় ভূমিকা রাখে। সনাতন সমাজের মানুষ কম শিক্ষিত ছিল বিধায় সে সময়ে মানুষের মনোবলের ঘাটতি ছিল এবং মানুষ অধিকাংশ ক্ষেত্রে ছিল পশ্চাৎপদ। ফলে তারা আধুনিক সমাজব্যবস্থার সাথে পরিচিত হয় নি।
২. প্রযুক্তি বিকাশ : শিল্পায়ন ও শহরায়নের ফলে প্রযুক্তির বিকাশ হতে থাকে ফলে মানুষের মানসিকতার পরিবর্তন হতে থাকে। বর্তমানে আধুনিক সমাজব্যবস্থা প্রযুক্তি নির্ভর।
বিধায় সকলে নগরায়নের দিকে ধাবিত হচ্ছে এবং মানুষ আধুনিক সমাজব্যবস্থার প্রতি আকৃষ্ট হতে থাকে। এভাবে আধুনিক সমাজের গোড়াপত্তন হতে থাকে।
৩. শিক্ষার উন্নয়ন : আধুনিক সমাজব্যবস্থার ক্ষেত্রে শিক্ষা একটি কার্যকরী উপাদান হিসেবে বিবেচ্য। শিক্ষা ছাড়া আধুনিক সমাজব্যবস্থা কল্পনাতীত।
শিক্ষা মানুষকে সামাজিকীকরণের পথকে সুগম করে আর আধুনিক সমাজের সাথে সম্পৃক্ত করে। ফলশ্রুতিতে মানুষ আধুনিক সমাজব্যবস্থার সাথে সম্পৃক্ত হতে থাকে। আর এভাবেই আধুনিক সমাজের গোড়াপত্তন হয়।
৪. যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন : যোগাযোগ ব্যবস্থা আধুনিক সমাজের গোড়াপত্তনের ক্ষেত্রে একটা বড় ভূমিকা রাখে। মূলত আধুনিক সমাজব্যবস্থা যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের ফলেই সম্ভব হয়েছে।
প্রবাদে আছে যে, দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা যত উন্নত সে দেশ আধুনিক সমাজব্যবস্থার সাথে তত বেশি মানানসই।
বর্তমান আধুনিক সমাজব্যবস্থায় Sustainable development বা টেকসই উন্নয়ন ক্ষেত্রে যোগাযোগ ব্যবস্থা একটা বড় ইস্যু।
৫. শিল্পের বিকাশ : শিল্পের বিকাশের ফলে আধুনিক সমাজব্যবস্থার বিকাশ ঘটতে থাকে। ইংল্যান্ডে শিল্পবিপ্লবের ফলে মানুষ আধুনিক জীবনযাত্রার সাথে সম্পৃক্ত হতে পেরেছে।
শুধু তাই নয়, ইংল্যান্ডের শিল্পবিপ্লব গোটা বিশ্বের মানুষের কাছে ইংল্যান্ড তথা ব্রিটিশদের ভাবমূর্তি বৃদ্ধি পেয়েছে
৬. নগরায়নের বিকাশ : আধুনিক সমাজের গোড়াপত্তনের ক্ষেত্রে নগরায়ন একটা বড় ভূমিকা রাখে। বিশেষ করে চৈনিক সভ্যতা বিকাশ হয়েছে মূলত নগরায়নের ফলে।
তাছাড়া বর্তমান বিশ্বে দ্রুত নগরায়নের প্রেক্ষিতে বর্তমানে চীন সমগ্র বিশ্বে তাদের আধিপত্য বিস্তৃত করতে সক্ষম হয়েছে।
৭. ধর্মনিরপেক্ষতার প্রভাব : আজকের বিশ্বব্যাপী যে ধর্মনিরপেক্ষতার বিস্তৃতি ঘটছে তাতে করে সকলেই আজ অধিক সচেতন। কেননা ধর্মের বেড়াজালে আজ আর কেউ আবদ্ধ নয়।
আর ধর্মনিরপেক্ষতার কারণেই আজ মানুষ আধুনিক জীবনযাত্রার সাথে ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত হতে সক্ষম হয়েছে।
উপসংহার : উপরিউক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, বর্তমান আধুনিক সমাজব্যবস্থা গোড়াপত্তনের ক্ষেত্রে কোন একক কারণ দায়ী নয়।
কেননা সনাতন সমাজের ভাঙনের পরিপ্রেক্ষিতে আধুনিক সমাজব্যবস্থা কালক্রমে জনগণের কাছে পরিচিতি পেতে থাকে।
আর এভাবেই সকলে শিক্ষা বিস্তার, রাজনৈতিক সচেতন ও শিল্পের বিকাশের ফলে উন্নত সমাজব্যবস্থার সাথে সম্পৃক্ত হতে শুরু করে। আর এভাবেই আধুনিক সমাজের সূচনা হয় ।