সমাজের লোকাচার ও অবশ্য পালনীয় লোকরীতি কী ব্যাখ্যা কর
সমাজের লোকাচার ও অবশ্য পালনীয় লোকরীতি কী ব্যাখ্যা কর |
সমাজের লোকাচার ও অবশ্য পালনীয় লোকরীতি কী ব্যাখ্যা কর
- অথবা, একটি সমাজের নৈতিক মূল্যবোধের আলোকে সংস্কৃতির বিন্যাস ব্যাখ্যা কর।
উত্তর : ভূমিকা : মানবজীবনের নিজস্ব স্বকীয়তা বিকাশের ক্ষেত্র হিসেবে সংস্কৃতি অন্যতম সহায়ক উপাদান। সংস্কৃতি জন্মগতভাবে মানুষ লাভ করে না।
এটাকে অর্জন করতে হয়। মানুষ তার পরিবেশ ও লোকাচার তথা তার সার্বিক পারিপার্শ্বিক অবস্থা থেকে সংস্কৃতির শিক্ষা অর্জন করে থাকে।
এ সম্পর্কে সমাজবিজ্ঞানী রস বলেন, "Culture is the total acquired behaviour patterns transmitted by immitation or instruction." তবে সামাজিক পরিবেশ হল সংস্কৃতি বিকাশের অন্যতম মাধ্যম।
মানুষের নিজস্ব সংস্কৃতি বিকাশের ক্ষেত্রে লোকাচার (Folkways) ও অবশ্য পালনীয় লোকরীতি (Mores) বিশেষ ভূমিকা রাখে ।
সমাজে নৈতিক মূল্যবোধের আলোকে সংস্কৃতি বিন্যাস : সমাজবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে নৈতিক মূল্যবোধ একটা বহুল আলোচিত শব্দ। নৈতিক মূল্যবোধের ইংরেজি প্রতিশব্দ 'Normative value' নৈতিক মূল্যবোধ বা 'Normative value ' শব্দটি Normative ও value যোগে গঠিত।
Normative শব্দটির Noun হচ্ছে 'Norm'। এখানে Norm সম্পর্কে সমাজবিজ্ঞানী David Popenoe তাঁর 'Sociology' প্রবন্ধে বলেন, "The term norm is used by sociologist to mean any rule or standard that defines what people should or should out do think or feel in any given social situation."
অর্থাৎ সমাজবিজ্ঞানিগণ নৈতিক আদর্শকে এমন কিছু নিয়মের মধ্যে ফেলেছেন যা জনগণের চিন্তাচেতনা, অনুভূতিকে বিশ্লেষণ করে যা সামাজিক অবস্থার সাথে সম্পর্কিত।
আবার 'Value' সম্পর্কে David Popenoe তাঁর 'Sociology' গ্রন্থে বলেন, "A value is an idea about what is good, right wise or beneficial. For example when asked why do you attend religious service? A respondent may answer. Because every good honest citizen should."
তবে নৈতিক মূল্যবোধ বা Normative value কে বুঝতে হলে, সমাজের সংস্কৃতিকে বিন্যাস করতে হলে বিশিষ্ট সমাজবিজ্ঞানী W. Graham Sumner এর অভিমত প্রণিধানযোগ্য।
তিনি সমাজের সংস্কৃতিকে বিন্যস্ত করতে গিয়ে Normative value কে তাঁর 'Folkways' গ্রন্থে দু'টি ভাগে বিভক্ত করেছে। যথা
i. সাধারণ পালনীয় রীতিনীতি (Folkways or social customs) এবং
ii. অবশ্য পালনীয় কর্তব্য (Mores or laws)।
উক্ত গ্রন্থে Sumner Folkways 3 Mores সম্পর্কে বলেন যে, “লোকাচার সমাজের স্বাভাবিক প্রক্রিয়া বা গতিধারায় জন্মলাভ করে।" নিম্নে Folkways ও Mores সম্পর্কে বিস্তারিত বিশ্লেষণ করা হল :-
i. Folkways : সমাজবিজ্ঞানী ম্যাকাইভার Folkways সম্পর্কে বলেন, "Folkways are the recognized or accepted ways of behaving in society." অর্থাৎ ব্যবহার ও আচরণের স্বীকৃতি এবং গৃহীত পন্থাপদ্ধতি হচ্ছে লোকাচার ।
মানুষ স্বভাবতই প্রথা মেনে চলে এবং অনুষ্ঠান প্রতিষ্ঠানের নিয়মরীতি অনুসারে ব্যবহার আচরণ করে। বিশিষ্ট সমাজবিজ্ঞানিগণ Folkways সম্পর্কে যে ধারণা দেন তাতে দেখা যায়, যা সমাজ কর্তৃক সৃষ্ট নানা আচরণ, প্রথা, ব্যবহার প্রণালী, জীবনধারা প্রভৃতি প্রত্যয়গুলো লোকাচারের অন্তর্ভুক্ত।
সমাজবিজ্ঞানী W. Graham Sumner তাঁর "Sociology', "Folkways are customary ways of behaving and acting which wise automatically with in a group to meet the problem of living.
They are the customs conventions and usages which have been passed drawn from previous generations and to which new elements are added as need arises."
তিনি এর বিস্তারিত ব্যাখ্যায় বলেন, মানুষ Folkways এর মাধ্যমে নিজেকে তার পরিবেশের সাথে খাপখাইয়ে নেয় কিন্তু মানবেতর প্রাণী ও উদ্ভিদ একমাত্র বিবর্তনের মাধ্যমে নতুন পরিবেশের সাথে নিজেকে মানিয়ে নেয়।
মূলত মানুষের সামাজিক পরিবেশের অন্য নাম হচ্ছে সংস্কৃতি। প্রত্যেক মানুষের সামাজিক জীবনে এমন কতকগুলো রীতিনীতি আছে, যা সাধারণভাবে মানুষের প্রাত্যহিক বা দৈনন্দিন কার্যক্রমকে নিয়ন্ত্রণ করে।
তবে আদিম সমাজে Folkways এর প্রভাব অত্যন্ত বেশি, সেখানে মানুষ সামাজিক প্রথাকে অন্ধ বা অজ্ঞভাবে মেনে চলত, কিন্তু আধুনিক সভ্যসমাজে মানুষ তার বিচার বিবেচনার সাথে সাধারণত Folkways গুলো পালন করে।
সকল জীবনের ক্ষেত্রে Folkways' এর প্রভাব পরিলক্ষিত হয় এবং সকল দেশেই নিজস্ব কিছু Folkways পালন করা হয়।
উদাহরণ হিসেবে আমেরিকাতে করমর্দন করা, দিনে তিনবার খাওয়া, রাস্তার বামদিকে গাড়ি চালানো, দৈনিক আটঘণ্টা কাজ করা ইত্যাদি Folkways এর মধ্যে অন্যতম।
তেমনিভাবে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে Folkways এর মধ্যে পরস্পর সালাম বিনিময় করা, স্বামী-স্ত্রীর সুনির্দিষ্ট কার্য ও দায়িত্ব অর্থাৎ স্বামী গৃহের কর্তা, যা প্রধান ভরণপোষণকারী ও স্ত্রী তার উপর নির্ভরশীল। সুতরাং Folkways গুলো প্রত্যেক সমাজের সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ চিত্রকে তুলে ধরে।
ii. Mores : অধ্যাপক ম্যাকাইভারের মতে, Mores হচ্ছে Regulators of behaviour অর্থাৎ Mores হচ্ছে ব্যবহার নিয়ন্ত্রক এর একটি অংশবিশেষ।
লোকাচার বা লোকনীতি যখন কেবলমাত্র ব্যবহারবিধি না মনে করে ব্যবহার নিয়ন্ত্রক হিসেবে মনে করা হয়। তখন সেটাকে Mores যা অবশ্য পালনীয় লোকরীতি হিসেবে গণ্য করা হয়।
সমাজবিজ্ঞানী Sumner বলেন, “The mores are the popular habits and traditions when they include a judgement that they are conductive to social welfare and when they extra co-excion on the individual to conform to them although they are not co-ordinated by any authority."
তিনি এ সম্পর্কে আরও বলেন, কোন Folkways মেনে না চললে কোন ব্যক্তিকে সামাজিক শাস্তি ভোগ করতে হয় না। কিন্তু Mores বা অবশ্য পালনীয় রীতি অমান্য করলে তাকে অবশ্যই শাস্তি পেতে হবে।
এটা মূলত উক্ত সমাজের সাংস্কৃতিক অনুশাসনের পর্যায়ভুক্ত। যেমন- পাশ্চাত্য সমাজে বিবাহ, গণতন্ত্র, যৌথ দরকষাকষি অবশ্য পালনীয় রীতির অন্তর্ভুক্ত।
এরূপভাবে অবশ্য পালনীয় রীতিনীতিগুলো যখন ধর্মের বা সমাজের স্বীকৃতি লাভ করে তখন এর কার্যকরী শক্তি অধিকভাবে বৃদ্ধি পায়।
উদাহরণস্বরূপ, মুসলিম সমাজে যেমন- মদ, জুয়া, শূকরের গোশত, সুদ ইত্যাদি ধর্মীয় বিধিনিষেধের কারণে অবশ্য পালনীয় বিষয় বা Mores রীতিতে রূপান্তরিত হয়েছে।
উদাহরণস্বরূপ, পরিমিত মদ খাওয়া যেমন লোকরীতি (Folkways), অন্যদিকে মাত্রাতিরিক্ত মদ না খাওয়াই Mores হিসেবে স্বীকৃত। বস্তুতপক্ষে Folkways ও Mores এর মৌলিক পার্থক্য হচ্ছে মাত্ৰাগত ।
উপসংহার : উপরিউক্ত আলোচনা শেষে বলা যায় যে, লোকাচার (Folkways) ও অবশ্য পালনীয় লোকরীতি মূলত সমাজব্যবস্থার নিজস্ব সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্যের চিত্র তুলে ধরে। কোন সমাজে যেগুলো Folkways অন্য সমাজে সেগুলো 'Mores' হিসেবে স্বীকৃত।
তবে সমাজের সংস্কৃতি ও নৈতিকতাকে টিকিয়ে রাখতে হলে লোকাচার ও অবশ্য পালনীয় কর্তব্য এ দু'টির মধ্যে সমন্বয় থাকা প্রয়োজন, তবে একটা উন্নত সংস্কৃতি গড়ে উঠতে পারে।