সমাজে ব্যক্তির মর্যাদা কিভাবে নির্ধারিত হয়
সমাজে ব্যক্তির মর্যাদা কিভাবে নির্ধারিত হয় |
সমাজে ব্যক্তির মর্যাদা কিভাবে নির্ধারিত হয়
- অথবা, মর্যাদা কাকে বলে? সমাজে ব্যক্তির মর্যাদা নিরূপণের বিষয়গুলো আলোচনা কর।
উত্তর : ভূমিকা : প্রত্যেক ব্যক্তির জীবনে মর্যাদা একটা অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। প্রত্যেকেই স্বীয় মর্যাদার ব্যাপারে অচেতন। মানুষ সামাজিক জীব হিসেবে সমাজের অন্যান্য ব্যক্তির সাথে আন্তরিকভাবে বসবাস করতে সদা তৎপর।
তবে সকলেই নিজের সামাজিক অবস্থান দৃঢ় করার জন্য সর্বদা তৎপর। সমাজে কেউ শিক্ষক, কেউ আইনজীবী, কেউ ব্যবসায়ী ইত্যাদি মর্যাদা ব্যক্তির পদবি বা গুরুত্ব অনুসারে বিভিন্ন রকমের হয়ে থাকে। তবে প্রত্যেক মর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তিরই নিজস্ব দায়িত্ব, কর্তব্য ও অধিকার রয়েছে।
মর্যাদা (Status) : সামাজিক জীবনে ব্যক্তির অবস্থানই হল মর্যাদা বা Status। অন্য কথায়, ব্যক্তির সামাজিক পরিচিতিই হল তার মর্যাদা, মর্যাদা প্রত্যেক ব্যক্তির ভূষণ ।
প্রামাণ্য সংজ্ঞা : মর্যাদাকে বিভিন্ন সমাজবিজ্ঞানী বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। নিম্নে মর্যাদা সম্পর্কিত সমাজবিজ্ঞানীদের বক্তব্য সন্নিবেশিত হল :
সমাজবিজ্ঞানী Ralph Linton বলেছেন, "Status is the place in a particular system, which a certain individual occupies at a particular time."
Duncan Mitchell 4, "Social status refers to the position occupied by person, family, or kinship group in a social system relative to others, this determines rights duties and other behaviours including the nature and extent of the relationships with the person of the other
statuses."সমাজবিজ্ঞানী ম্যাকাইভার (R. M. Maclver) বলেছেন, "সামাজিক অবস্থান হল মর্যাদার ভিত্তি। এ সামাজিক অবস্থান ব্যক্তিগত গুণাগুণ বা সামাজিক ভূমিকা ছাড়াই ব্যক্তিমানুষের পক্ষে প্রভাব-প্রতিপত্তি, শ্রদ্ধা-ভক্তি, মান-সম্মান প্রভৃতির সৃষ্টি করে থাকে।
সমাজবিজ্ঞানী Prof. Kingsley Davis এর মতানুসারে, “সামাজিক মর্যাদা হল এক বিশেষ সামাজিক অবস্থান। এ সামাজিক অবস্থানের পিছনে বর্তমান থাকে সমগ্র সমাজের স্বীকৃতি ও সমর্থন।
পরিকল্পিতভাবে বা ইচ্ছামতো সামাজিক মর্যাদা সৃষ্টি করা যায় না। লোকাচার ও লোকনীতির মাধ্যমে স্বতঃস্ফূর্তভাবে সামাজিক মর্যাদার সৃষ্টি হয়।
অতএব বলা যায়, সামাজিক মর্যাদা হল মানুষের সামাজিক অবস্থানের দ্যোতক। অর্থাৎ সমাজের সদস্য হিসেবে ব্যক্তির সামাজিক পরিচিতি বা অবস্থানই হল মাमা।
সমাজে ব্যক্তির মর্যাদা নির্ধারিত হওয়ার স্বরূপ সমাজে মানুষের মর্যাদা নির্ধারিত হওয়ার কতকগুলো দিক রয়েছে। মানুষের মর্যাদা নির্ধারিত হওয়ার বিভিন্ন দিক নিম্নে বর্ণনা করা হল :
প্রাথমিক দিক : মানবজীবনে মর্যাদা অত্যন্ত মূল্যবান বিষয়। মানুষ তার মর্যাদাকে করায়ত্ত করতে সর্বদা তৎপর। সমাজে অনেকেই বিষয় সম্পত্তিকে অগ্রাহ্য করে মর্যাদাকে গুরুত্ব দিয়ে থাকেন।
তবে মানুষ মর্যাদার অধিকারী হয় বিভিন্নভাবে। মানুষের মর্যাদা নির্ধারিত হয় তার বংশ, জন্য, সামাজিক বর্ণবিন্যাস, সামাজিক প্রথা, লিঙ্গ, বয়স, সামাজিক অবস্থান ও পরিচিতি এবং ব্যক্তিগত গুণাবলি ও কার্যকলাপের ভিত্তিতে।
মর্যাদা নির্বাচনের এ ভিত্তিগুলো অনুসারে সমাজে মানুষের মর্যাদাকে দু'ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এদের একটি হল-
১. আরোপিত মর্যাদা (Ascribed Status), অপরটি
২. অর্জিত মর্যাদা (Achieved Status)।
জন্মসূত্রে আরোপিত মর্যাদা : মানুষ জন্মগতভাবে সামাজিকভাবে মর্যাদাবান হতে চায়। এ মর্যাদা নির্ধারিত হয় মূলত সামাজিক প্রথা, বিধিবিধান অনুযায়ী, সামাজিক শ্রেণিবিন্যাস বা বর্ণবিন্যাস, বংশ বা পরিপ্রেক্ষিতে যে মর্যাদার অধিকারী হয়ে থাকে তাকে আরোপিত মর্যাদা বলা হয়।
এ মর্যাদা নির্ধারিত হয় মূলত সামাজিক প্রথা, বিধিবিধান অনুযায়ী, সামাজিক শ্রেণিবিন্যাস বা বর্ণবিন্যাস, বংশ বা পরিবার, লিঙ্গ এবং বয়সের দ্বারা।
যেমন- প্রাচীন হিন্দুসমাজ ছিল শ্রেণিবিন্যস্ত সমাজ। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র এ চারটি বর্ণে সমাজ বিভক্ত ছিল। তার মধ্যে ব্রাহ্মণদের সবচেয়ে মর্যাদাসম্পন্ন বা উচ্চবর্ণের মনে করা হতো।
অপরদিকে, শূদ্ররা ছিল সর্বাপেক্ষা নিম্নবর্ণের। তাদেরকে সামাজিকভাবে অবজ্ঞার চোখে দেখা হতো। সমাজে এদের মর্যাদা স্বীকার করা হতো না বললেই চলে।
কোন ব্যক্তি ব্রাহ্মণ বর্ণে জন্মগ্রহণ করলেই সে অতি উচ্চ মর্যাদার অধিকারী হতো। অন্যদিকে, শূদ্র বর্ণে জন্মগ্রহণ করলে সে মর্যাদা হতে বঞ্চিত হতো।
বংশগত মর্যাদা ; আবার কেউ যদি অভিজাত বা বিখ্যাত বংশ বা পরিবারে জন্মগ্রহণ করতো, তাহলে সে বিশেষ মর্যাদার অধিকারী হতো। অর্থাৎ সে উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন হতো।
কিন্তু তার জন্ম যদি সাধারণ বংশে বা অখ্যাত বংশে হতো, তাহলে সে উৎকৃষ্ট মর্যাদার অধিকারী হতে পারত না। সাধারণত বদ্ধ বা রক্ষণশীল সমাজেই আরোপিত মর্যাদা প্রথা প্রচলিত।
আরোপিত মর্যাদার ক্ষেত্রে লিঙ্গ এবং বয়সও উল্লেখযোগ্য প্রভাব বিস্তার করে। যেমন- সামাজিক ক্ষেত্রে সুযোগ সুবিধা, মান মর্যাদা, প্রভাব প্রতিপত্তি, গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন ইত্যাদি সব ক্ষেত্রেই নারীদের তুলনায় পুরুষদের প্রাধান্য পরিলক্ষিত হয়।
অনেক বাবা-মাও পুত্রসন্তানকে তাদের সম্পদ, অর্থনৈতিক আশ্রয় এবং বৃদ্ধকালীন অবলম্বন মনে করে এবং কন্যা সন্তানকে পরিবারের দায় মনে করে থাকে।
বিশেষ করে প্রাচীন সমাজে নারীদেরকে অত্যধিক অবমূল্যায়ন করা হতো। আবার বয়সের দ্বারাও মর্যাদা নির্ধারিত হয়।
সমাজে ছোটদের চেয়ে বয়সে বড়রা অধিক মর্যাদাসম্পন্ন বলে স্বীকৃতি পায়। এভাবে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ হতে সমাজে আরোপিত মর্যাদা নির্ধারিত হয়ে থাকে।
অর্জিত মর্যাদা : মর্যাদার আরেকটি দিক হল অর্জিত মর্যাদা। এ মর্যাদা মানুষের ব্যক্তিগত গুণাবলি এবং কীর্তিকলাপের মাধ্যমে যে মর্যাদা লাভ করে তাকে অর্জিত মর্যাদা হিসেবে গণ্য করা হয়।
এ মর্যাদা মানুষের ব্যক্তিগত উদ্যোগ, যোগ্যতা, দক্ষতা, কর্মপ্রচেষ্টা ও ক্ষমতা প্রতিভা-প্রবণতা, অন্তর্নিহিত সম্ভাবনা ইত্যাদির দ্বারা নির্ধারিত হয়ে থাকে।
আধুনিক সমাজে অর্জিত মর্যাদার প্রাধান্য অত্যধিক আকারে পরিলক্ষিত হয়। বর্তমান সমাজে মানুষের মর্যাদা কোন নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, অর্থাৎ বর্তমানে মর্যাদা স্থির বা দ্রুত নয়, এটা পরিবর্তনশীল।
মানুষকে তার নিজের যোগ্যতার মর্যাদার অধিকারী হবে এটাই স্বাভাবিক। তবে আধুনিক যুগে আরোপিত মর্যাদা বহুলাংশে হ্রাস পেয়েছে। বর্তমানে মানুষের মর্যাদার নির্ণায়ক তার জন্ম বা সামাজিক প্রথা নয় এক্ষেত্রে তার কর্মদক্ষতাই গুরুত্বপূর্ণ।
উপসংহার : উপরিউক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায়, মর্যাদা মানুষের জীবনের এক পরম অর্জন। এটি মানবজীবনের ভূষণও বটে। তবে মানুষ বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ হতে বিভিন্নভাবে সমাজে মর্যাদাবান হয়ে উঠে।
সমাজে মানুষের মর্যাদা একদিকে যেমন তার জন্ম ও সামাজিক প্রথা ও রীতিনীতির দ্বারা নির্ধারিত হয়, তেমনি অন্যদিকে ব্যক্তিগত গুণাবলি ও অন্তর্নিহিত সম্ভাবনার দ্বারাও নির্ধারিত হয়ে থাকে।