সভ্যতা নদী সম্পদেরই অবদানেরই ফল উক্তিটি বিশ্লেষণ কর
সভ্যতা নদী সম্পদেরই অবদানেরই ফল উক্তিটি বিশ্লেষণ কর |
সভ্যতা নদী সম্পদেরই অবদানেরই ফল উক্তিটি বিশ্লেষণ কর
উত্তর : ভূমিকা : সভ্যতা বলতে সংস্কৃতির এমন অংশকে বুঝায়, যা একটি বিশেষ পর্যায়ে উন্নীত হয়ে সমাজকে নিরাপত্তা প্রদান করার শক্তি অর্জন করে।
প্রাচীনকালে যেসব সভ্যতার উদ্ভব ও বিকাশ হয়েছিল যেসব সভ্যতা কোন না কোন নদীকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল।
ঐতিহাসিকগণের তথ্যমতে, মানবজীবনকে সুখী ও সমৃদ্ধিশালী করার জন্য মানুষের সামাজিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয় জীবনধারার উন্নয়ন ঘটাতে গিয়ে সভ্যতার সৃষ্টি করেছেন ।
‘সভ্যতা নদী সম্পদের অবদানেরই ফল' উক্তিটির যথার্থতা : সভ্যতার উদ্ভব ও বিকাশে নদী ও সম্পদের ভূমিকা ছিল অপরিসীম। নিম্নে বিখ্যাত কয়েকটি সভ্যতার উৎপত্তি পর্যালোচনাপূর্বক উক্তিটির যথার্থতা আলোচনা করা হলো :
১. মিশরীয় সভ্যতা : মিশরীয় সভ্যতার উৎপত্তির পিছনে নীলনদের অবদান ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বিখ্যাত ঐতিহাসিক হেরোডোটাস মিশরকে ‘নীলনদের দান' বলে অভিহিত করেছেন।
নীলনদের পানি সঞ্চিত হয়ে সংলগ্ন এলাকা কৃষিযোগ্য ভূমিতে পরিণত হয়েছিল এবং পলি সঞ্চিত হয়ে উন্নতমানের ভূমি তৈরি হয়েছিল।
কৃষিকাজের সুবিধার্থে দূর দূরান্ত থেকে লোক এসে নীলনদের পাশে বসবাস শুরু করে। এভাবেই মিশরীয় সভ্যতার উত্থান ঘটে ।
২. মেসোপটেমিয়া সভ্যতা : টাইগ্রিস (দজলা) ও ইউফ্রেটিস (ফোরাত) নদীর জলধারাকে কেন্দ্র করে মেসোপটেমীয় সভ্যতার উন্মেষ ঘটেছিল । নদী সংলগ্ন এলাকাগুলো প্লাবিত হয়ে প্রচুর পরিমাণে পলি জমত এবং প্রচুর কৃষিপণ্য উৎপাদিত হতো।
গবাদি পশু পালনের ক্ষেত্রে এসব এলাকা ছিল খুবই উপযোগী। ফলে ধীরে ধীরে নদী সংলগ্ন এলাকায় মানুষের আগমন বাড়তে থাকে। এরই ধারাবাহিকতায় মেসোপটেমীয় সভ্যতার উদ্ভব ঘটেছিল।
৩. সিন্ধু সভ্যতা : সিন্ধু নদীকে কেন্দ্র করে সিন্ধু সভ্যতার বিকাশ ঘটেছিল। নদী বিধৌত অঞ্চলগুলোতে প্লাবনের ফলে প্রচুর পরিমাণে পলিমাটি জমত। ফলে প্রচুর পরিমাণে কৃষিপণ্য ও অন্যান্য ফসল জন্মাত।
এছাড়া নদী তীরবর্তী উর্বর ভূমির অনুকূলে এবং পরিবহনগত সুযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে সিন্ধু সভ্যতার আবির্ভাব হয়েছিল ।
৪. পারস্য সভ্যতা : আরব মরুভূমির দক্ষিণাঞ্চলীয় তৃণভূমি, দানিয়ুব নদীর পূর্বাঞ্চলে, কৃষ্ণ সাগরের উত্তর- দক্ষিণাঞ্চলকে কেন্দ্র করে পারস্য সভ্যতার উন্মেষ ঘটেছিল।
এসব অঞ্চলে বিস্তৃত তৃণভূমি থাকায় যাযাবর শ্রেণি কৃষিকাজ এবং পশুপালনের সুবিধার্থে বসতি স্থাপন করে।
তাছাড়া এলাকাগুলো পর্বতের পাদদেশে হওয়ায় সোনা, রুপা, লোহা, তামা, সিসা ইত্যাদিতে পরিপূর্ণ ছিল যা সভ্যতার বিকাশকে ত্বরান্বিত করেছিল।
৫. গ্রিক সভ্যতা : গ্রিক সভ্যতা আর্ডিয়াটিক সাগর, ভূমধ্যসাগর, ইজিয়ান সাগর বিধৌত অঞ্চলে গড়ে উঠেছিল। এশিয়া মাইনরের নৈকট্য এবং ইজিয়ান সাগরের বুকে অসংখ্য দ্বীপমালার অস্তিত্ব গ্রিকদের কৃষিকাজ, সমুদ্রযাত্রা, পশুপালন ও ব্যসসা বাণিজ্যে প্রেরণা যুগিয়েছিল।
তাছাড়া এসব অঞ্চলে বিভিন্ন প্রাকৃতিক সম্পদ যেমন- লোহা, সোনা, রুপা, কাদামাটি, মার্বেল পাথর, চুনাপাথরের অস্তিত্ব সভ্যতার বিকাশকে সহজ করেছিল ।
৬. চৈনিক সভ্যতা : চীনের হোয়াংহো ও ইয়াংসিকিয়াং তীরবর্তী অঞ্চল এবং দক্ষিণ চীনের ভূখণ্ডকে কেন্দ্র করে চৈনিক সভ্যতার বিকাশ ঘটেছিল।
নদী তীরবর্তী এসব অঞ্চলের উর্বরতা এবং পরিমিত বৃষ্টিপাত কৃষিকাজ ও ব্যবসা বাণিজ্যের অনুকূলে থাকায় এ সভ্যতার দ্রুত বিকাশ ঘটেছিল।
তাছাড়া দক্ষিণ চীনের বিভিন্ন অঞ্চলে সোনা, তামা, রুপা, সীসা, টিন ও চুনাপাথর প্রভৃতি খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ ছিল যা সভ্যতার বিকাশকে ত্বরান্বিত করেছিল ।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, উপর্যুক্ত আলোচনা থেকে এটা স্পষ্ট সভ্যতার উৎপত্তি ও বিকাশের ক্ষেত্রে নদী এবং নদী তীরবর্তী অঞ্চলের খনিজ সম্পদের প্রভাবশালী ভূমিকা ছিল।
প্রাচীনকালে মানুষের জীবন কঠিন ও দুর্বিসহ থাকায় যাযাবর মানুষ সুযোগ সুবিধার সন্ধান করতো। নদী তীরবর্তী অঞ্চলে বিভিন্ন সুযোগ সুবিধার আধিক্যের দরুন অনেক সভ্যতার উন্মেষ ঘটেছিল ।