সংস্কৃতির পরিবর্তনশীলতার কারণসমূহ আলোচনা কর

সংস্কৃতির পরিবর্তনশীলতার কারণসমূহ আলোচনা কর
সংস্কৃতির পরিবর্তনশীলতার কারণসমূহ আলোচনা কর


সংস্কৃতির পরিবর্তনশীলতার কারণসমূহ আলোচনা কর

  • অথবা, কিভাবে সংস্কৃতির ব্যাপ্তি ঘটে? ব্যাখ্যা কর।

উত্তর ৷ ভূমিকা : মানবজীবনের নিজস্ব স্বকীয়তা বিকাশের ক্ষেত্র হিসেবে সংস্কৃতি অন্যতম সহায়ক উপাদান । সংস্কৃতি জন্মগতভাবে মানুষ লাভ করে না। 

এটাকে অর্জন করতে হয়। মানুষ তার পরিবেশ ও লোকাচার তথা তার সার্বিক পারিপার্শ্বিক অবস্থা থেকে সংস্কৃতির শিক্ষা অর্জন করে থাকে। 

এ সম্পর্কে সমাজবিজ্ঞানী রস বলেন, "Culture is the total acquired behaviour patterns transmitted by immitation or instruction.” তবে সামাজিক পরিবেশ হল সংস্কৃতি বিকাশের অন্যতম মাধ্যম। 

মানুষের নিজস্ব সংস্কৃতি বিকাশের ক্ষেত্রে লোকাচার (Folkways) ও অবশ্য পালনীয় লোকরীতি (Mores) বিশেষ ভূমিকা রাখে।

সংস্কৃতির ব্যাপ্তি : সংস্কৃতির ব্যাপ্তি সম্পর্কিত আলোচনায় যাওয়ার পূর্বে সংস্কৃতির অর্জন সম্পর্কে জানা আবশ্যক। কেননা সংস্কৃতি সহজাত প্রক্রিয়া নয়, এটি একটা অর্জিত বিষয়। 

আবার জাতি, সমাজ ও রাষ্ট্রভেদে সংস্কৃতির ব্যাপ্তি বা পরিবর্তন ঘটে। এর মূল কারণ সৃষ্টির শুরু থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত যতগুলো সমাজব্যবস্থা গড়ে উঠেছে সব ক্ষেত্রেই সমাজব্যবস্থার মধ্যে ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়। 

উদাহরণস্বরূপ, প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সংস্কৃতিতে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়। পাশ্চাত্যে মদ খাওয়া, সমাজ কর্তৃক স্বীকৃত, আবার কোন দেশে এটা পুরোপুরি নিষিদ্ধ। সেক্ষেত্রে সমাজব্যবস্থা ভিন্নতা অনুসারে সংস্কৃতির ব্যাপ্তি ঘটে।

ব্যুৎপত্তিগত অর্থ : সংস্কৃতির ব্যাপ্তির ইংরেজি প্রতিশব্দ Cultural diffusion. Diffusion শব্দটি ইংরেজি Diffuse হতে নেয়া হয়েছে, যার অর্থ চারদিকে ছড়িয়ে পড়া। 

অতএব সাধারণ অর্থে, সংস্কৃতির ব্যাপ্তি বা Cultural diffusion হচ্ছে কোন সংস্কৃতি বা উপাদানের প্রসারণ ঘটা বা ছড়িয়ে পড়া। 

এর অর্থ হল সংস্কৃতির উপাদান যদি তার উৎপত্তিস্থল থেকে অন্য সমাজ, জাতি ও রাষ্ট্রের মধ্যে প্রসারণ ঘটে বা তার জনপ্রিয়তা পায় তখন তাকে সংস্কৃতির ব্যাপ্তি বলে। 

উদাহরণস্বরূপ, পাশ্চাত্য সংস্কৃতির কোট, টাই, খাদ্যাভ্যাস, ভাষা (ইংরেজি), বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি আমাদের উপমহাদেশের সমাজ ও সংস্কৃতিতে প্রবেশ করেছে। 

এখানে পাশ্চাত্য (Western) সংস্কৃতির সম্প্রসারণ ঘটেছে। বর্তমান সময়ে সকল সমাজে Western culture এর জোয়ার পরিলক্ষিত হচ্ছে।

সংজ্ঞা : সংস্কৃতির ব্যাপ্তির ক্ষেত্রে Kroeber তাঁর 'Anthropology' গ্রন্থে যে উদ্ধৃতি করেছেন সেটাই সর্বজনস্বীকৃত। উক্ত গ্রন্থে তিনি বলেন, “নতুন সংস্কৃতি ভৌগোলিকভাবে এবং কাল পরম্পরায় নির্দিষ্ট পরিসরে একটি সম্পর্কের ভিত্তিতে স্থানান্তরিত হয় এবং সম্প্রসারিত হয়। 

কোন অঞ্চলে সংস্কৃতির এ সম্প্রসারণকে সংস্কৃতির ব্যাপ্তি বলে।” (New culture is transmitted geographically as well as chronologically in space as well as time by contagion as well as by relation. The spread in area is generally called diffusion).

কোন সমাজের সংস্কৃতির সম্প্রসারণের মাধ্যমে যখন নতুন কোন অঞ্চলে প্রবেশ করে তখন উক্ত সমাজে সেটা নতুন সংস্কৃতি (New culture) হিসেবে পরিচিতি পায়। 

নতুন সংস্কৃতির এ সম্প্রসারণের ফলে সমজাতীয় সংস্কৃতির পরিসমাপ্তি ঘটতে পারে। যেমন- কম্পিউটারের উদ্ভাবন ও সম্প্রসারণর ফলে টাইপ রাইটারের পরিসমাপ্তি ঘটেছে। 

মূলত বলা যায়, সংস্কৃতির পরিবর্তন ঘটে অসম মানের সংস্কৃতির মধ্যে। অর্থাৎ সমমানের কিংবা শক্তিশালী একজাতীয় সংস্কৃতির মধ্যে সংস্কৃতির ব্যাপ্তি বা সম্প্রসারণ সম্ভব নয়। সাধারণত যেসব সংস্কৃতি দুর্বল ও নিম্নমুখী সেখানে সংস্কৃতির উন্নত বিস্তার ঘটে।

সংস্কৃতির ব্যাপ্তি কিভাবে ঘটে : সংস্কৃতি ও মানুষের মধ্যে একটা ঘনিষ্ঠ যোগসূত্র রয়েছে। মানুষ যেমন প্রতিনিয়ত গতিশীল তেমনি সংস্কৃতিও মানুষের মত গতিশীল। 

মানুষ জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত বিরামহীনভাবে উন্নত জীবনের জন্য পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছুটে চলে। আর মানুষের এ গতিশীলতার মাধ্যমে সংস্কৃতির ব্যাপ্তি বা সম্প্রসারণ ঘটে। 

এক্ষেত্রে সংস্কৃতির পরিবর্তনের প্রধান বাহক মানুষ যারা মূলত পর্যটক, পরিব্রাজক, ব্যবসায়ী, সৈনিক, মিশনারিজ, স্থানান্তরিত জনগোষ্ঠী, শ্রমিক, গবেষক প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ। 

উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, আমেরিকার একজন গবেষক দীর্ঘদিন আমেরিকাতে গবেষণা করে যখন বাংলাদেশে আসেন তখন তাঁর মাধ্যমে আমেরিকার সংস্কৃতি বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করে। 

আবার অনেক ক্ষেত্রে অধিক সংখ্যক মানুষ স্থানান্তরিত হলে সংস্কৃতির সম্প্রসারণ ঘটে। আবার বর্তমান আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির যুগে ঘরে বসেই সমস্ত বিশ্বের সংস্কৃতিকে আয়ত্ত করতে পারি। 

সেজন্য সংস্কৃতি এখন দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে।সংস্কৃতির ব্যাপ্তি বা সম্প্রসারণের কারণ : সৃষ্টির শুরু থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত মানুষের প্রয়োজনে, সময়ের প্রয়োজনে এবং সমাজ ও বাস্তবতার ভিত্তিতে সংস্কৃতির ব্যাপ্তি বা সম্প্রসারণ । 

এক্ষেত্রে বিভিন্ন সমাজব্যবস্থায় বিভিন্ন কারণে সংস্কৃতির সম্প্রসারণ বা ব্যাপ্তি ঘটে থাকে। নিম্নে সংস্কৃতির ব্যাপ্তি বা পরিবর্তনের কিছু উপযুক্ত কারণ উল্লেখ করা হল : 

১ . মানুষের গতিশীল কর্মকাণ্ড।

২. সমাজব্যবস্থার পার্থক্য ও মানসিকতার ভিন্নতা।

৩. দুর্বল সংস্কৃতির উপর শক্তিশালী সংস্কৃতির আধিপত্য।

৪. পুরানো সংস্কৃতির বিপরীতে নতুন সংস্কৃতির আবেদন ও গ্রহণযোগ্যতা। 

৫. পরিবহন ও উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা ।

৬. তথ্য প্রযুক্তিগত বিকাশ ।

৭. গণমাধ্যমের উন্নতি ।

৮. মুক্তবাজার অর্থনীতি (Free market economy) এর বিস্তার। 

৯. বিভিন্ন সমাজের সংঘটিত বিপ্লব ও আর্থসামাজিক পরিবর্তন। 

১০. ঔপনিবেশিক শাসনের প্রভাব।

১১. বিভিন্ন সাংস্কৃতিক চুক্তি ও তার বাস্তবায়ন ।

১২. মানুষের উন্নত মানসিকতা ।

উপসংহার : উপরিউক্ত আলোচনা থেকে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, সংস্কৃতির ব্যাপ্তি বা পরিবর্তন ও সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে যুগে যুগে মানুষের ভূমিকাগুলোই অধিক গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছে। 

তাছাড়া সময়ের প্রয়োজনে ও উন্নত ও গতিশীল বিশ্বের প্রেক্ষিতে দুর্বল সংস্কৃতিগুলো শক্তিশালী সংস্কৃতির অন্তরালে হারিয়ে যাচ্ছে। 

তবে বর্তমান আধুনিক তথ্য প্রযুক্তির যুগে সংস্কৃতির পরিবর্তনের ক্ষেত্রে পাশ্চাত্য সংস্কৃতিরই অধিক সম্প্রসারণ ঘটেছে এবং পৃথিবীর অধিকাংশ রাষ্ট্র এখন পাশ্চাত্য সংস্কৃতির অনুকরণ করছে। 

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url
আরও পড়ুনঃ
আরও পড়ুনঃ