রাজনৈতিক সমাজতত্ত্ব ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মধ্যে সম্পর্ক বিশ্লেষণ কর
রাজনৈতিক সমাজতত্ত্ব ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মধ্যে সম্পর্ক বিশ্লেষণ কর |
রাজনৈতিক সমাজতত্ত্ব ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মধ্যে সম্পর্ক বিশ্লেষণ কর
- অথবা, রাজনৈতিক সমাজতত্ত্ব ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মধ্যে পার্থক্য বিশ্লেষণ কর ।
উত্তরঃ ভূমিকা : সমাজতত্ত্ব ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচ্য বিষয়বস্তুর মধ্যে সাদৃশ্য ও সংযোগ সম্পর্ক সবসময় গুরুত্বপূর্ণ। যে কারণে অনেক সমাজবিজ্ঞানী রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে সমাজতত্ত্বের একটি অন্যতম ক্ষেত্র বা শাখা হিসেবে ব্যবহার করার পক্ষপাতী।
মূলত রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞানের মধ্যে সংযোগ সম্পর্কের ভিত্তিতে সৃষ্টি হয়েছে রাজনৈতিক সমাজতত্ত্ব। এ কারণে অনেকের অভিমত অনুসারে রাজনৈতিক সমাজতত্ত্ব ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র করা সম্ভব নয়।
Prof. T. B. Bottomore, "It is impossible, in my view to establish any significant theoretical distinction between political sociology and political science."
রাজনৈতিক সমাজতত্ত্ব ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মধ্যে সম্পর্ক : রাষ্ট্রবিজ্ঞান যেমন সামাজিক বিজ্ঞানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শাখা তেমনি রাজনৈতিক সমাজতত্ত্ব সামাজিক বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ের মধ্যে অন্যতম। উভয়ের মধ্যে সংযোগ সম্পর্ক রয়েছে।
নিম্নে ধারাবাহিকভাবে উভয়ের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক বিশ্লেষণ করা হল :
১. ঐতিহাসিক বিচারে : ঐতিহাসিক দিক থেকে বিচার করলে সাবেকি রাষ্ট্রবিজ্ঞান বলতে প্রধানত রাষ্ট্রকেন্দ্রিক আলোচনাকে বুঝায়। সনাতন রাষ্ট্রবিজ্ঞানে সমাজের আলোচনা তেমন একটা ছিল না বললেই চলে।
কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পরিস্থিতির ব্যাপক পরিবর্তন সূচিত হয়। এ সময়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা রাজনৈতিক বাস্তবতায় অভিজ্ঞতাবাদী আলোচনার ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে উঠেন। এভাবে আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা সমাজতাত্ত্বিক বিষয়াদির ব্যাপারে আকৃষ্ট হয়ে উঠেন।
২. সামাজিক পরিবর্তনে : সামাজিক পরিবর্তন ব্যাখ্যা এবং রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানসমূহের উপর সামাজিক পরিবর্তনের প্রভাব প্রতিক্রিয়া পর্যালোচনার উদ্দেশ্যে আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা সমাজতত্ত্বের পরিধিতে প্রবেশ করেন।
অর্থাৎ সামাজিক পরিপ্রেক্ষিতকে বাদ দিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক প্রশ্নের পর্যালোচনা সম্ভব নয়, এ বিষয়ে সম্যক উপলব্ধি স্পষ্টত প্রতিপন্ন হয়।
৩. সভ্যতার পরিবর্তন ক্ষেত্রে : বিংশ শতাব্দীর ত্রিশের দশক থেকে সাবেক রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আইনানুগ ও প্রাতিষ্ঠানিক আলোচনার সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা অবহিত হয়ে উঠেন।
ইউরোপীয় এবং বিশেষত মার্কিন চিন্তাবিদরা রাজনৈতিক আলোচনায় সমাজতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির অবতারণা করেন।
বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় থেকে পশ্চিমা সমাজবিজ্ঞানীরা আন্তঃসামাজিক বিজ্ঞানকেন্দ্রিক আলোচনার সূত্রপাত করেন।
৪. দু'টি স্বতন্ত্র বিজ্ঞান : রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞানের আলোচনার শুরুতেই সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা দরকার যে, রাজনৈতিক সমাজতত্ত্ব রাষ্ট্রবিজ্ঞান নয়।
এ দু'টি সামাজিক বিজ্ঞান স্বতন্ত্র, অভিন্ন নয়, তারা ভিন্ন। রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও সমাজতত্ত্বের মধ্যে সংযোগ বা সম্পর্কের ভিত্তিতে সৃষ্টি হয়েছে রাজনৈতিক সমাজতত্ত্ব। তা সত্ত্বেও এ দু'টি সামাজিক বিজ্ঞান রাজনৈতিক সমাজতত্ত্বের স্বাতন্ত্র্য্য সুস্পষ্ট।
অধ্যাপক অমল কুমার মুখোপাধ্যায় তাঁর 'Political Sociology' শীর্ষক গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন, "To put the matter very simply, political sociology is a child from the marriage between sociology and political science and as in human issues, cannot be solely characterised by its parental qualities alone".
৫. সমাজবদ্ধ মানুষের ক্ষেত্রে : সমাজবদ্ধ মানুষের বহু ও বিভিন্ন কাজকর্ম এবং বহু বিচিত্র সম্পর্কের অনেককিছুই রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনা ক্ষেত্রের অন্তর্ভুক্ত নয়।
রাষ্ট্রবিজ্ঞান যে সমস্ত বিষয় অনুসন্ধান চালায় তার উল্লেখযোগ্য হল রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার সংগঠন ও উন্নয়ন। রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানসমূহের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার প্রয়োগ, রাষ্ট্রীয় কার্যাবলির মাধ্যমে সমাজস্থ ব্যক্তিবর্গের জীবনধারায় হস্তক্ষেপ প্রভৃতি। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও সমাজতত্ত্বের বিষয়বস্তুগত পার্থক্য দেখা যায়।
৬. পরিধির ক্ষেত্রে : রাষ্ট্রীয় পরিধির অন্তর্ভুক্ত বিষয়াদিই রাষ্ট্রবিজ্ঞানে রাজনৈতিক বিষয় হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে এবং রাষ্ট্র ও সমাজের মধ্যে পার্থক্যের পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও সমাজতত্ত্বের মধ্যে পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনা ক্ষেত্রের বহির্ভূত বিষয়াদি নিয়ে সমাজতত্ত্বের আলোচনা ক্ষেত্রের পরিধি প্রসারিত।
৭. কেন্দ্রীয় বিষয়াবলির ক্ষেত্রে : সমাজতত্ত্বের কেন্দ্রীয় বিষয় হল মানবসমাজ। বহু ও বিভিন্ন ধরনের সামাজিক সম্পর্কের প্রকৃতি, প্রয়োগ ও মিথষ্ক্রিয়া সামাজিক প্রতিষ্ঠানসমূহের উদ্ভব, বিকাশ ও কার্যাবলি, সামাজিক ক্ষমতা ও সামাজিক প্রগতির বর্ণনা ও মূল্যায়ন প্রভৃতি বিষয়ে সমাজতত্ত্বের আলোচনা প্রসারিত।
প্রকৃত প্রস্তাবে সমগ্র সমাজ সম্পর্কিত আলোচনাই হল সমাজতত্ত্বের মূল বিষয়। অপরদিকে, রাষ্ট্রবিজ্ঞানে থাকে কেবল রাজনৈতিক সমাজ বা রাষ্ট্র ও সরকার সম্পর্কিত আলোচনা।
৮. মানবগোষ্ঠীর ক্ষেত্রে : সবরকম সামাজিক সম্পর্কই সমাজতত্ত্বের আলোচনার অন্তর্ভুক্ত। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে শুধুমাত্র সংগঠিত মানবগোষ্ঠী সম্পর্কিত আলোচনায় আগ্রহ দেখান হয়।
অপরদিকে, সমাজতত্ত্বে সংগঠিত অসংগঠিত নির্বিশেষে সকল মানবগোষ্ঠী সম্পর্কে আলোচনা থাকে। স্বভাবতই রাষ্ট্রবিজ্ঞান আলোচনা ক্ষেত্রের পরিধি থেকে সমাজতত্ত্বের আলোচনা ক্ষেত্রের পরিধি অধিকতর ব্যাপক।
৯. রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও রাজনৈতিক সমাজতত্ত্ব : রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও রাজনৈতিক সমাজতত্ত্বের ভিতরকার সম্পর্ক বিশ্লেষণ করলে রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও রাজনৈতিক সমাজতত্ত্বের মধ্যে পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়।
দৃষ্টিভঙ্গি ও প্রকৃতির পরিপ্রেক্ষিতে উভয়ের মধ্যে পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। রাষ্ট্র ও সমাজের মধ্যে পার্থক্যের পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও রাজনৈতিক সমাজতত্ত্বের মধ্যে পার্থক্য প্রতিপন্ন হয় ।
১০. রাজনৈতিক ও সামাজিক বিষয়াদি : রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ব্যাখ্যামূলক পরিবর্তনীয় বিষয় হিসেবে রাজনৈতিক বিষয়াদির উপর গুরুত্ব আরোপ করে।
কিন্তু রাজনৈতিক সমাজতত্ত্ব ব্যাখ্যামূলক পরিবর্তনীয় হিসেবে সামাজিক বিষয়াদির উপর গুরুত্ব আরোপ করে।
রাজনৈতিক সমাজতত্ত্বের অন্যতম বিশ্লেষক S. M. Lipset এবং R. Bendix এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন।
তাঁরা বলেছেন, "Political science starts with the state and examines how it affects society, while political sociology starts with society and examines how it affects the state."
উপসংহার : রাজনৈতিক সমাজতত্ত্বের কেন্দ্রীয় বিষয় হল সমাজ। স্বভাবতই সমগ্র সমাজজীবনই হল রাজনৈতিক সমাজতত্ত্বের আলোচনার অন্তর্ভুক্ত।
এ কারণে রাষ্ট্রবিজ্ঞান আলোচনা ক্ষেত্রের তুলনায় রাজনৈতিক সমাজতত্ত্বের আলোচনা ক্ষেত্রের পরিধি অধিক প্রসারিত। রাজনৈতিক সমাজতত্ত্ব রাজনৈতিক ও সামাজিক বিষয়াদির মধ্যে সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করে।
এ প্রসঙ্গে অমল কুমার মুখোপাধ্যায় বলেছেন, "Political sociology is a discipline that tries to understand political phenomena by necessarily relating them to their social determinations".