রাজনৈতিক সমাজতত্ত্বের উপযোগিতা কী আলোচনা কর
রাজনৈতিক সমাজতত্ত্বের উপযোগিতা কী আলোচনা কর |
রাজনৈতিক সমাজতত্ত্বের উপযোগিতা কী আলোচনা কর
- অথবা, রাজনৈতিক সমাজতত্ত্বের প্রয়োজনীয়তা কী? আলোচনা কর।
উত্তর : ভূমিকা : গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের স্থায়িত্ব বজায় রাখার জন্য রাজনৈতিক সমাজতত্ত্ব সর্বদা অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক সমাজের স্থিতাবস্থা আনয়নে রাজনৈতিক সমাজতত্ত্ব সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করে।
সামাজিক পরিবর্তনের ক্ষেত্রেও রাজনৈতিক সমাজতত্ত্ব সহায়তা করে থাকে। অধ্যাপক অমল কুমার মুখোপাধ্যায় এ সম্পর্কে বলেন, "Political sociology thus embraces only this kind of non-politics that its association with the state and its formal institutions and looks upon society as the place of birth."
রাজনৈতিক সমাজতত্ত্ব : যে কোন সামাজিক বিজ্ঞানের ন্যায় রাজনৈতিক সমাজতত্ত্বের সংজ্ঞা ও ধারণা তার আলোচনার পরিধির দ্বারাই নির্ধারিত হয়। সাবেকি রাজনীতি ছিল সম্পূর্ণরূপে রাজনীতিকেন্দ্রিক।
কিন্তু আধুনিক কালে বহুলাংশে সামাজিক স্বরূপ সম্পন্ন হয়ে পড়েছে। আধুনিক রাজনীতির বীজ বাস্তবে সমগ্র সমাজের বৃহত্তর ক্ষেত্রে পরিব্যাপ্ত।
রাজনৈতিক সমাজতত্ত্বের উপযোগিতা : বর্তমান বিশ্বায়ন এবং গতিশীল রাজনৈতিক ব্যবস্থায় সামাজিক বিজ্ঞানের অন্যতম শাখা হিসেবে রাজনৈতিক সমাজতত্ত্বের উপযোগিতাকে অস্বীকার করা যায় না। নিম্নে রাজনৈতিক সমাজতত্ত্বের উপযোগিতা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হল :
১. বর্তমান সমাজকাঠামোতে : রাজনৈতিক সমাজতত্ত্বের আলোচনার ক্ষেত্রের পরিপ্রেক্ষিতে এ আধুনিক ও নবীন সামাজিক বিজ্ঞানটির উপযোগিতা সহজেই উপলব্ধি করা যায়।
আধুনিক কালের সমাজব্যবস্থায় রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানসমূহ সম্পর্কে পৃথকভাবে আলোচনা করা সম্ভব নয়। এ বিষয়ে কোন দ্বিমতের অবকাশ নেই।
কেবলমাত্র রাজনৈতিক সমাজতত্ত্বের মাধ্যমে বর্তমান সামাজিক ও রাজনৈতিক সমাজতত্ত্ব সম্পর্কে বিস্তারিত বিচার বিশ্লেষণ করা সম্ভবপর হয়।
২. রাজনৈতিক কাঠামোর পরিচয়ের ক্ষেত্রে : সাম্প্রতিক সময়ে সামাজিক ও রাজনৈতিক সংগঠনসমূহের সামগ্রিক পরিচয় পেতে রাজনৈতিক সমাজতত্ত্বের অধ্যয়ন একান্ত অপরিহার্য। সবধরনের রাজনৈতিক ব্যবস্থার ক্ষেত্রে এ কথা সাধারণভাবে সত্য ।
৩. গণতন্ত্র ও সমাজতত্ত্বের ক্ষেত্রে : আধুনিক রাজনৈতিক সমাজতত্ত্বের ধারণাসমূহ গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় যেমন, গুরুত্বপূর্ণ তেমনিভাবে সমাজতান্ত্রিক, একনায়কতান্ত্রিক, স্বৈরতান্ত্রিক ও কমিউনিস্ট ব্যবস্থার ক্ষেত্রে বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক।
বর্তমান উন্নত ও উন্নয়নশীল সকল রাষ্ট্রেই রাজনৈতিক সমাজতত্ত্বের চর্চা গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে প্রতিপন্ন হয়। সেজন্য সকল প্রকার রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সমাজতত্ত্ব সমানভাবে গুরুত্ববহ।
৪. নতুন পদ্ধতির বিশ্লেষণে : রাজনৈতিক সমাজতত্ত্বের গবেষণার এ অভিজ্ঞতাবাদী পদ্ধতির দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে প্রাচ্যের বহু আধুনিক চিন্তাবিদ সামাজিক বিজ্ঞানের গবেষণায় তাত্ত্বিক তথা পদ্ধতিমূলক এক নতুন ক্ষেত্রের সৃষ্টি করেছেন।
এ শ্রেণির সামাজিক বিজ্ঞানীরা সুনির্দিষ্ট ক্ষেত্রে অনুসন্ধানের মাধ্যমে প্রাপ্ত পরিসংখ্যান ও তথ্যাদির ভিত্তিতে তুলনামূলক রাজনৈতিক অভিজ্ঞতাবাদী আলোচনা করে থাকেন। তাঁরা এভাবে রাজনৈতিক বিষয়ে সাধারণ সূত্র সৃষ্টি করেন।
৫. রাজনৈতিক ব্যবস্থার ক্ষেত্রে : বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যক্তির ধারণার পরিপ্রেক্ষিতে রাজনৈতিক বিষয়ে যে সাধারণ তত্ত্ব গড়ে উঠে তার উপর ভিত্তি করে রাজনৈতিক ব্যবস্থা সম্পর্কে সাধারণ তত্ত্ব গড়ে উঠে।
রাজনৈতিক ব্যবস্থাদি সম্পর্কে আলোচনার গভীরতা ও বাস্তবতা রাজনৈতিক শক্তিসমূহের অবস্থান সম্পর্কে অবহিত হতে সহায়তা করে থাকে।
৬. সাংস্কৃতিক উন্নয়নে : সামাজিক শ্রেণি, সাংস্কৃতিক কাঠামো, আর্থসামাজিক পরিবর্তন, দেশের রাজনৈতিক এলিট, আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি প্রভৃতি কোন সূত্র থেকে সমকালীন রাজনৈতিক শক্তি উৎসারিত ও ক্রিয়াশীল হয়, সে বিষয়ে জ্ঞান ও ধারণা রাজনৈতিক সমাজতত্ত্বের সরবরাহ করে।
এদিক থেকে রাজনৈতিক সমাজতত্ত্ব বাস্তব গুরুত্ব ও তাৎপর্য বিরোধ বিতর্কের ঊর্ধ্বে। Prof. Ali Ashraf and L. N. Sharma তাঁদের Political Sociology' শীর্ষক গ্রন্থে বলেন, "Political sociology involves an ongoing search for a more comprehensive scope, as well as more realistic, precise and theory conscious analysis."
৭. রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পরিধির ক্ষেত্রে : রাজনৈতিক সমাজতত্ত্ব রাজনীতির অর্থের পরিধি প্রসারিত করেছে। তার ফলে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনার ক্ষেত্রে পরিধি অধিকতর সম্প্রসারিত হয়েছে।
রাজনৈতিক সমাজতত্ত্ব এ ধারণাকে প্রতিষ্ঠিত করেছে যে রাজনৈতিক পরিবর্তনীয়সমূহ সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তনসমূহকে প্রভাবিত করে এবং তাদের দ্বারা প্রভাবিত হয়।
৮. নতুন ক্ষেত্র উন্মোচনে : রাজনৈতিক সমাজতত্ত্ব গবেষণার নতুন নতুন ক্ষেত্র উন্মুক্ত করেছে এবং বিষয়বস্তু ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের নতুন নতুন পন্থা নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা চালিয়েছে।
এ প্রসঙ্গে আচরণবাদের কথা উল্লেখ করা যায়। আচরণবাদে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় ব্যক্তিবর্গের আচার আচরণ ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের উপর জোর দেয়া হয়।
৯. ক্রিয়াবাদী মতবাদের ক্ষেত্রে : রাজনৈতিক সমাজতত্ত্ব ক্রিয়াবাদী মতবাদ (Functional theory) এর উপর গুরুত্ব আরোপ করে এবং সমাজে গোষ্ঠীসমূহের ক্রিয়াকলাপ ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের উপর বিশেষ নজর দেয়। এক্ষেত্রে রাজনৈতিক সমাজতত্ত্বের অধ্যয়নের গুরুত্ব রয়েছে।
১০. শাসন পরিচালনায় : রাষ্ট্র, শাসনব্যবস্থা, প্রতিনিধিত্ব, নাগরিকদের অধিকার ও কর্তব্য প্রভৃতি রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সাবেকি ধারণার সাহায্যে রাজনৈতিক দল, চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী এবং গণসংযোগের মাধ্যমসমূহের ভূমিকা ও ক্রিয়াকলাপ সম্পর্কে সম্যকভাবে অবহিত হওয়া যায় না।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সাবেকি ধারণাসমূহের সীমাবদ্ধতা দূরীকরণে রাজনৈতিক সমাজতত্ত্বের ভূমিকা অনস্বীকার্য ।
১১. সিদ্ধান্ত গ্রহণ ক্ষেত্রে : সামাজিক গোষ্ঠী, ক্ষমতা, কর্তৃত্ব, দ্বন্দ্ব সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রভৃতি প্রতিটি কেন্দ্রীয় বিষয় সম্পর্কে রাজনৈতিক সমাজতত্ত্বে তাত্ত্বিক ধারণা পাওয়া যায়।
তাছাড়া সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা কার্যপ্রক্রিয়া উন্নয়ন, যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রভৃতি বিমূর্ত বিষয়েও রাজনৈতিক সমাজতত্ত্ব ব্যাপক ও অর্থবহ ধারণা প্রদান করে থাকে ।
উপসংহার : বাস্তব রাজনীতির অনেক বিষয় রাজনৈতিক সমাজতত্ত্বের আলোচনায় সমৃদ্ধি লাভ করেছে। প্রত্যেক রাষ্ট্রের নাগরিকদের ভোট প্রদান থেকে শুরু করে তাঁর সার্বিক কর্মকাণ্ডে রাজনৈতিক সমাজতত্ত্বের প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া প্রতিফলিত হয়ে থাকে ।
বর্তমানে সমাজ ও রাজনীতিকে বাদ দিয়ে কোন নাগরিক তাঁর জীবন অতিবাহিত করতে পারে না। সেক্ষেত্রে রাজনৈতিক সমাজতত্ত্বে তাঁর জীবনে পরিপূর্ণতা দান করে থাকে ।