রাজনৈতিক সমাজতত্ত্বের উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ আলোচনা কর
রাজনৈতিক সমাজতত্ত্বের উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ আলোচনা কর |
রাজনৈতিক সমাজতত্ত্বের উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ আলোচনা কর
- অথবা, রাজনৈতিক সমাজতত্ত্বের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ আলোচনা কর।
উত্তরঃ ভূমিকা : সামাজিক বিজ্ঞানের বিভাগসমূহের মধ্যে রাজনৈতিক সমাজতত্ত্বের আবির্ভাব মূলত আধুনিক কালে। রাজনৈতিক সমাজতত্ত্ব উদ্ভব আধুনিক সময়ে হলেও এর বিকাশ এখনও বর্তমান।
বর্তমান বিশ্বের গতিশীল রাজনীতিতে রাজনৈতিক সমাজতত্ত্বে নতুন নতুন ধারা সংযোজিত হচ্ছে, যার ফলে আধুনিক বিশ্বের জ্ঞানপিপাসু মানুষের কাছে রাজনৈতিক সমাজতত্ত্বের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
অধ্যাপক আশরফ ও শর্মা বলেছেন, "Political process is a way processing and controlling social conflict so as to achieve goal order."
রাজনৈতিক সমাজতত্ত্ব : যে কোন সামাজিক বিজ্ঞানের ন্যায় রাজনৈতিক সমাজতত্ত্বের সংজ্ঞা ও ধারণা তার আলোচনার পরিধির দ্বারাই নির্ধারিত হয়। সাবেকি রাজনীতি ছিল সম্পূর্ণরূপে রাজনীতিকেন্দ্রিক।
কিন্তু আধুনিক কালে বহুলাংশে সামাজিক স্বরূপ সম্পন্ন হয়ে পড়েছে। আধুনিক রাজনীতির বীজ বাস্তবে সমগ্র সমাজের বৃহত্তর ক্ষেত্রে পরিব্যাপ্ত।
রাজনৈতিক সমাজতত্ত্বের উদ্ভব ও বিকাশ : রাজনৈতিক সমাজতত্ত্বের উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ সম্পর্কে নিম্নে বিস্তারিত আলোচনা হল ।
১. নবীন সামাজিক বিজ্ঞান : রাজনৈতিক সমাজতত্ত্ব বস্তুত একটি আন্তঃসামাজিক বিজ্ঞানমূলক শাস্ত্র। এ ধরনের আরও অনেক সামাজিক বিজ্ঞান রয়েছে যেমন- সমাজদর্শন, সামাজিক মনস্তত্ত্ব, শিক্ষামূলক মনস্তত্ত্ব, কৃষি অর্থনীতি প্রভৃতি।
রাজনৈতিক সমাজতত্ত্ব একটি নতুন বিষয়ও বটেই। এ বিষয়টি এখনও যথেষ্ট বিকশিত নয়। সেজন্য রাজনৈতিক সমাজতত্ত্বকে একটি বিকাশমান আধুনিক সামাজিক বিজ্ঞান বলে অভিহিত করা হয়।
২. শিল্পবিপ্লবের প্রভাব ও পরিণতি : বিভিন্ন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী প্লেটো, এরিস্টটল রাষ্ট্র ও সমাজের মধ্যে পার্থক্য করেন নি। এ দুই গ্রিক পণ্ডিত সরকারের সামাজিক ভিত্তির উপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করেছেন।
মধ্যযুগে চার্চ ও রাষ্ট্রের মধ্যে পার্থক্য করা হয়েছে। তবে এ সময়ে ঈশ্বরের প্রতি রাষ্ট্রের আনুগত্যের বিষয়টির উপর জোর দেয়া হয়েছে। সামাজিক বিজ্ঞানসমূহের উপর শিল্পবিপ্লবের প্রভাব প্রতিক্রিয়ার উপর বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।
শিল্পবিপ্লবের পরিণতি হিসেবে ভূস্বামী সম্প্রদায়ের প্রাধান্যমূলক সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থা, চার্চের কর্তৃত্বের বিস্তৃতি, রাজনৈতিক ক্ষমতার পুঞ্জীভবন প্রভৃতি বিষয়সমূহের অবসান অনিবার্য হয়ে পড়ে।
৩. বিভিন্ন রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতবাদ : হবস ও হেগেল রাষ্ট্র সম্পর্কে চরম মতবাদের প্রবক্তা হিসেবে পরিচিত। তবে জন লক, রুশো ও অ্যাডাম স্মিথ সমাজ ও রাষ্ট্রের মধ্যে পার্থক্যমূলক আলোচনা করেছেন।
অবশ্য লকই হলেন এক্ষেত্রে সকল রাষ্ট্রীয় মতবাদের পথিকৃৎ। উদারনৈতিক বুর্জোয়া তাত্ত্বিকেরা সরকারের এক্তিয়ারের সীমাবদ্ধতার উপর গুরুত্বারোপ করেছেন।
এ সময়ে শিল্পবিপ্লবের পরিণতি হিসেবে কতকগুলো বিষয়ের অবসান অনিবার্য হয়ে পড়ে। এসব বিষয়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ভূস্বামী সম্প্রদায়ের প্রাধান্যমূলক সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থা, চার্চের কর্তৃত্বের বিস্তৃতি, রাজনীতিক ক্ষমতার পুঞ্জীভবন প্রভৃতি।
৪. বিভিন্ন সামাজিক শক্তির প্রভাব : শিল্পবিপ্লবের পর বিভিন্ন সামাজিক শক্তি ও সমস্যা মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। তার ফলে সুনির্দিষ্ট সামাজিক বিষয়াদি সম্পর্কে আলোচনার প্রয়োজনীয়তা বিশেষভাবে প্রতিপন্ন হয়।
এ ধরনের প্রচেষ্টার পরিপ্রেক্ষিতে একটি গবেষণামূলক ও অভিজ্ঞতালব্ধ স্বতন্ত্র সামাজিক বিজ্ঞান হিসেবে সমাজতত্ত্বের উদ্ভব ও বিকাশ ঘটে।
রাজনৈতিক সমাজতত্ত্বের উদ্ভব প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে অধ্যাপক মুখোপাধ্যায় তাঁর Political Sociology'
শীর্ষক গ্রন্থে বলেছেন, Both lipset and Runciman have fixed the timing of the birth of political sociology at about the middle of 19th century when under the impact of industrial revolution."
৫. কার্ল মার্কসের অবদান : রাজনৈতিক সমাজতত্ত্বের সুসংগঠিত আবির্ভাবের পিছনে দু'জন জার্মান চিন্তাবিদের অবদান বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
একজন হলেন জার্মান দার্শনিক Karl Marx এবং অন্যজন হলেন জার্মান সমাজতত্ত্ববিদ Max Weber। কার্ল মার্কস প্রথম রাজনৈতিক সমাজতত্ত্বের আলোচনার সূত্রপাত করেন।
হেগেলীয় রাষ্ট্রদর্শনের সমালোচনা, ইতিহাসের মার্কসীয় বস্তুবাদী ব্যাখ্যা, মার্কসের শ্রেণী সম্পর্কিত মতবাদ প্রভৃতির মাধ্যমে রাজনৈতিক সমাজতত্ত্বের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের সূত্রপাত ঘটে।
অধ্যাপক বিশ্বাস (D. Biswas) তাঁর Political Sociology' শীর্ষক গ্রন্থে বলেন, "Gitter is also of the opinion that political sociology started with writing Karl Marx."
৬. ম্যাক্স ওয়েবারের অবদান : রাজনৈতিক সমাজতত্ত্বের উদ্ভব ও বিকাশের ধারায় জার্মান সমাজতত্ত্ববিদ ম্যাক্স ওয়েবারের অবদান অনস্বীকার্য।
ওয়েবার বিভিন্ন মার্কসীয় ধারণার সমালোচনা করেছেন এবং রাজনৈতিক সমাজতত্ত্বের সমৃদ্ধিকে সুনিশ্চিত করেছেন।
মার্কসীয় দর্শনে অর্থনৈতিক উপাদানের উপর সর্বাধিক গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। ওয়েবার বিভিন্ন অর্থনৈতিক ধারণা ও ভাবকে তাৎপর্যপূর্ণ সমাজতাত্ত্বিক উপাদান হিসেবে বিবেচনা করেছেন।
৭. ক্ষমতার ধারণা : Max Weber এর মতানুসারে ক্ষমতার সাথে রাজনীতির ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ বা সম্পর্ক রয়েছে। রাজনীতির ধারণা ওয়েবারের হাতে নতুনরূপে ধারণ করেছে।
তাঁর মতানুসারে রাজনীতি হল ক্ষমতা অধিকারের উদ্যোগ বা ক্ষমতা বণ্টনের ব্যবস্থাকে প্রভাবিত করার উদ্যোগ বিশেষ।
এ উদ্যোগ বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে রাষ্ট্রের ভিতরে বিভিন্ন গোষ্ঠী বা ব্যক্তিবর্গের মধ্যে পরিলক্ষিত হয়। তিনি বলেছেন, "Politics means striving to share power or striving to influence the distribution of power."
৮. বৈধতার ধারণা : আবার ম্যাক্স ওয়েবার সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে রাষ্ট্রের সংজ্ঞা প্রদান করেছেন। রাষ্ট্র তিনি একটি মানবিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিপন্ন করেছেন।
নির্দিষ্ট ভৌগোলিক সীমার মধ্যে এ প্রতিষ্ঠান হল দৈহিক বলপ্রয়োগের একচেটিয়া ও বৈধ অধিকারযুক্ত। ওয়েবার এজন্য রাজনৈতিক সমাজতত্ত্বে বৈধতার ধারণাটির প্রবক্তা হিসেবে পরিচিত, যা রাজনৈতিক সমাজতত্ত্বের বিকাশে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে।
৯. ঐতিহাসিক বস্তুবাদ : ঐতিহাসিক বস্তুবাদ সম্পর্কিত মার্কসীয় দর্শনের উদারনীতির পরিমার্জনের ক্ষেত্রেও ওয়েবারের অবদান অনস্বীকার্য।
ঐতিহাসিক বস্তুবাদ রাজনৈতিক সমাজতত্ত্বের বিকাশের ক্ষেত্রে একটা গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে বিবেচ্য। অধ্যাপক শর্মা ও অধ্যাপক আশরফ বলেন,
"After Karl Marx, the most significant contribution to political sociology was made by German sociologists Max Weber, who made power the focal point of social analysis."
১০. এলিটতত্ত্ব : রাজনৈতিক সমাজতত্ত্বের বিকাশের ক্ষেত্রে এলিটতত্ত্বের গুরুত্ব ও তাৎপর্য অনস্বীকার্য। নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে রাজনৈতিক দল ও স্বার্থগোষ্ঠীর ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে এলিটতত্ত্বের অপরিসীম অবদান অনস্বীকার্য।
এ এলিটতত্ত্ব রাজনৈতিক সমাজতত্ত্বের পরিধিকে প্রসারিত করেছে। এ এলিটতত্ত্বের বিকাশের ক্ষেত্রে প্যারেটো (Vilfredo Pareto), মসকা (Gaetano Mosca) এর অবদান অনস্বীকার্য। তাঁদের অভিমত অনুসারে এলিট শ্রেণির অস্তিত্ব বিশ্বজনীন।
১১. প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে মার্কিন সমাজবিজ্ঞানী : প্রথম মহাযুদ্ধের পর দীর্ঘদিন রাজনৈতিক সমাজতত্ত্বের আলোচনার ধারা মার্কিন চিন্তাবিদদের উদ্যোগের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল।
এ পর্যায়ে রাজনৈতিক সমাজতত্ত্বের বিকাশের ব্যাপারে যে সমস্ত চিন্তাবিদের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য তাঁরা হলেন আর্থার বেন্টলে, চার্লস মেরিয়াম, হ্যানস গারথ, মার্টিন লিপসেট প্রমুখ।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক ব্যবস্থায় সংস্কারের উদ্দেশ্যে প্রগতিমূলক আন্দোলন। সংগঠিত হতে থাকে।
এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী, সামাজিক সংগঠন, রাজনৈতিক সংস্কৃতি, রাজনৈতিক সামাজিকীকরণ প্রভৃতি।
১২. দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর অবস্থা : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটে। এ সময়ে এশিয়া, আফ্রিকা ও দক্ষিণ আমেরিকায় বহু স্বাধীন জাতি আত্মপ্রকাশ করে।
এসব দেশের রাষ্ট্র ব্যবস্থায় বহু ও বিভিন্ন ধরনের সামাজিক সংগঠন, সাংস্কৃতিক ব্যবস্থা, রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান প্রভৃতি পরিলক্ষিত হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে অভাবনীয় অগ্রগতি ঘটে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সাবেকি আইনানুগ ও প্রাতিষ্ঠানিক দৃষ্টিভঙ্গির সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মধ্যে পরিলক্ষিত হয়।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, সামাজিক বিজ্ঞান মাত্রই গতিশীল । রাজনৈতিক সমাজতত্ত্বের ক্ষেত্রে একথা অধিকতর প্রযোজ্য। এ আধুনিক সামাজিক বিজ্ঞানটি হল একটি দ্রুত বিকাশমান বিষয়।
রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞানীদের গবেষণার ক্ষেত্রটি ক্রমশ তার শাখাপ্রশাখা বিস্তার করছে। এ প্রক্রিয়া অবিরাম গতিতে চলছে।
নতুন নতুন দৃষ্টিভঙ্গির আলোচনার প্রেক্ষিতে সামাজিক বিজ্ঞানের আলোচনার ক্ষেত্রটি বিকশিত হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক মুখোপাধ্যায় বলেন,
"It was realised that these novel research finding were neither pure politics nor pure sociology and therefore they were eventually placed under the new rubric called political sociology."