রাজনৈতিক সমাজতত্ত্বের সাথে দর্শনের সম্পর্ক আলোচনা কর
রাজনৈতিক সমাজতত্ত্বের সাথে দর্শনের সম্পর্ক আলোচনা কর |
রাজনৈতিক সমাজতত্ত্বের সাথে দর্শনের সম্পর্ক আলোচনা কর
- অথবা, রাজনৈতিক সমাজতত্ত্বের সাথে দর্শনের সম্পর্ক বিশ্লেষণ কর।
উত্তর৷৷ ভূমিকা : রাজনৈতিক সমাজতত্ত্ব ও দর্শনের মধ্যে সম্পর্ক বিশেষভাবে গভীর ও নিবিড়। দর্শন ছাড়া যেমন রাজনীতি চলতে পারে না, তেমনি দর্শনের প্রয়োগের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সমাজতত্ত্ব অপরিহার্য ।
রাজনৈতিক সমাজতত্ত্ব : যে কোন সামাজিক বিজ্ঞানের ন্যায় রাজনৈতিক সমাজতত্ত্বের সংজ্ঞা ও ধারণা তার আলোচনার পরিধির দ্বারাই নির্ধারিত হয়।
সাবেকি রাজনীতি ছিল সম্পূর্ণরূপে রাজনীতিকেন্দ্রিক। কিন্তু আধুনিক কালে বহুলাংশে সামাজিক স্বরূপ সম্পন্ন হয়ে পড়েছে। আধুনিক রাজনীতির বীজ বাস্তবে সমগ্র সমাজের বৃহত্তর ক্ষেত্রে পরিব্যাপ্ত।
রাজনৈতিক সমাজতত্ত্ব ও দর্শনের মধ্যে সম্পর্ক : রাজনৈতিক সমাজতত্ত্ব ও দর্শনশাস্ত্রের মধ্যে সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড় ও ঘনিষ্ঠ ।
নিম্নে রাজনৈতিক সমাজতত্ত্ব ও দর্শনের মধ্যে সম্পর্ক আলোচনা করা হল :
১. সামাজিক বিষয়ের ক্ষেত্রে : সমাজচিন্তার সূত্রপাত হয় প্রাচীন কালে। তবে রাজনৈতিক সমাজচিন্তার সূত্রপাত হয় মধ্যযুগ থেকে।
পরবর্তীতে আধুনিক যুগে এর পরিপূর্ণতা লাভ করেছে। মূলত দার্শনিক ধারণার ভিত্তিতেই সমাজচিন্তা ও রাজনৈতিক সমাজতত্ত্বের আলোচনা শুরু হয়।
প্রাচীন কালে বৃহত্তর দার্শনিক বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গির অংশ হিসেবে মানব ইতিহাসের ধারাকে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করা হতো। এভাবে সামাজিক বিষয়সমূহের আলোচনা করা হতো দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিপ্রেক্ষিতে ।
২. সমাজতত্ত্ব উদ্ভবের ক্ষেত্রে : প্রাচীন কাল থেকেই রাজনৈতিক সমাজতত্ত্ব ও দর্শনের মধ্যে সম্পর্কের সূচনা হয় এবং ক্রমশ তা অধিকতর গভীরতা লাভ করে।
প্রকৃত প্রস্তাবে সমাজতত্ত্ব ও রাজনৈতিক সমাজতত্ত্বের উদ্ভবের সূচনা নিহিত আছে ইতিহাস দর্শনের মধ্যে।
৩. সামাজিক মূল্যবোধের ক্ষেত্রে : অধ্যাপক বটোমোরের অভিমত অনুসারে সামাজিক বিজ্ঞানের কেন্দ্রীয় আলোচ্যবিষয় হল সমাজবদ্ধ মানুষ। এ আলোচনা মূল্যমান সাপেক্ষ এবং তাৎপর্যপূর্ণ।
সমাজতত্ত্বের উপজীব্য বিষয় হল সমাজস্থ ব্যক্তিবর্গের বহুবিধ ও আচার আচরণের সামগ্রিক আলোচনা, এর সামাজিক মূল্য একান্তভাবে অপরিহার্য তবে দর্শন শাস্ত্রে যে রকম মূল্যবোধ সম্পর্কে তত্ত্বগত আলোচনা থাকে রাজনৈতিক সমাজতত্ত্বে সেরূপ থাকে না।
৪. সামাজিক বাস্তবতার ক্ষেত্রে : বস্তুত সামাজিক মূল্যবোধ হল সামাজিক বাস্তব সত্য। এগুলোকে সমাজতত্ত্বে বা রাজনৈতিক সমাজতত্ত্বে সামাজিক ঘটনা বা সামাজিক তথ্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
প্রসঙ্গত উল্লেখ করা দরকার যে, নীতিশাস্ত্র হল সমাজের বিভিন্ন বিষয়ের ঔচিত্য অনৌচিত্য সংক্রান্ত আলোচনা। সুতরাং চূড়ান্ত বিচারে দর্শন বা নীতিশাস্ত্র সমাজতত্ত্ব বা রাজনৈতিক সমাজতত্ত্বেরই একটি বিশেষ অংশ হিসেবে প্রতিপন্ন হয় ।
৫. সামাজিক পরিবর্তনের ক্ষেত্রে : সমাজতত্ত্ব বা রাজনৈতিক সমাজতত্ত্বের অপরিহার্য বিবেচ্য বিষয় হিসেবে সামাজিক মূল্যবোধ, উদ্দেশ্য, আদর্শ ও আশা-আকাঙ্ক্ষার ভিত্তিতে সামাজিক বিভিন্ন ঘটনার আবর্তন হয়।
প্রকৃত প্রস্তাবে গুরুত্বপূর্ণ আদর্শগত ধারণা ও বিশ্বাস সামাজিক আচারব্যবহারকে প্রভাবিত করে এবং এভাবে সামাজিক পরিবর্তন সূচিত হয়। এক্ষেত্রে দর্শনকে উপেক্ষা করে রাজনৈতিক সমাজতত্ত্ব বেশি দূর অগ্রসর হতে পারে না।
৬. সামাজিক আদর্শের ক্ষেত্রে : সামাজিক মূল্য, উদ্দেশ্য ও আদর্শসমূহের গুরুত্ব ও তাৎপর্য ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ সমাজজীবনের সামগ্রিক পটভূমিতে করা দরকার এবং এক্ষেত্রে দর্শনশাস্ত্র ও নীতিশাস্ত্রের মূল্যবিচার ও মূল্যবোধ সম্পর্কিত ধারণা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে কাজ করে থাকে।
৭. সামাজিক তথ্য সরবরাহের ক্ষেত্রে : দর্শনশাস্ত্র ও নীতিশাস্ত্রের সার্বিক ধারণা ছাড়া সমাজের অন্তর্ভুক্ত ব্যক্তিবর্গের কার্যকলাপ, আচার আচরণ, আশা আকাঙ্ক্ষা প্রভৃতির যথাযথ বিচার বিশ্লেষণ অসম্ভব হিসেবে প্রতিপন্ন হয়।
এসব কারণের প্রেক্ষিতে সামাজিক মূল্যবোধ ও মানবিক মূল্যবোধসমূহকে সামাজিক তথ্য হিসেবেই গ্রহণ করতে হয়। এজন্য সমাজতত্ত্ববিদ ও দার্শনিকদের অপরিহার্যভাবে তার অনুশীলন ও আলোচনায় আত্মনিয়োগ করতে হয়।
৮. সামাজিক মূল্যবোধের ক্ষেত্রে : মানবসমাজ হল গতিশীল। এ সমাজের পিছনে সতত ক্রিয়াশীল থাকে মানুষের সামাজিক মূল্যবোধ ও আদর্শ। সমাজদর্শনের দায়িত্ব হল সমগ্র সমাজজীবনের পরিপ্রেক্ষিতে এ আদর্শ ও মূল্যবোধের মূল্যায়ন করা।
মানবসমাজের এ গতিশীলতার মাধ্যমে সূচিত হয় সামাজিক পরিবর্তনের এবং সবদিক থেকেই সামাজিক পরিবর্তনের অনুশীলন ও বিচার বিশ্লেষণ করাই হল সমাজতত্ত্বের দায়িত্ব। এক্ষেত্রে দার্শনিকদের অবদানকে অস্বীকার করা যায় না।
৯. সমাজ পরিবর্তনের গতিপ্রকৃতি : সামাজিক পরিবর্তনের গতিপ্রকৃতি আলোচনা ও অনুশীলনের প্রাক্কালে অনেক সময় বিভিন্ন দার্শনিক প্রশ্নের সম্মুখীন হন।
অনেক সময় আবার সমাজতাত্ত্বিক আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে সৃষ্টি হয় তত্ত্বগত দার্শনিক আলোচনার। অধ্যাপক বটোমোরের অভিমত অনুসারে দার্শনিক প্রশ্নের উত্থাপনের ক্ষেত্রে সমাজতত্ত্বের অবদান অত্যন্ত বেশি।
বটোমোরের অভিমত উদ্ধৃত করে ডুরখেইম বলেছেন, "I believe that political sociology, more than any other science has or contribution to make to the renewal of philosophical question."
১০. রাজনৈতিক আলোচনার ক্ষেত্রে : বস্তুত সমাজতত্ত্ব সকল মানবিক মূল্যবোধ, উদ্দেশ্য ও আদর্শকে বিসর্জন দিতে পারে না। কারণ সমাজতত্ত্ব কেবলমাত্র নীরস সামাজিক ঘটনা বা তথ্যসর্বস্ব আলোচনায় পর্যবসিত হতে পারে না।
দর্শনশাস্ত্রের সাথে গভীর সংযোগ সম্পর্কের ভিত্তিতেই সমাজতত্ত্বে আলোচনা বা রাজনৈতিক আলোচনা অর্থবহ হয়ে উঠে।
১১. সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতা : রাজনৈতিক সমাজতত্ত্ব সম্পূর্ণরূপে মূল্যমান নিরপেক্ষ এবং পুরোপুরি বস্তুনিষ্ঠ হতে পারে না। বস্তুত দর্শনশাস্ত্রের সাথে রাজনৈতিক সমাজতত্ত্বের সম্পর্ক বিশেষভাবে ঘনিষ্ঠ।
এ ঘনিষ্ঠতা থেকে প্রতিপন্ন হয় যে, সমাজতত্ত্বের পক্ষে দার্শনিক মূল্যবোধ, উদ্দেশ্য আদর্শ প্রভৃতিকে সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষা করা সম্ভব নয় ।
উপসংহার : উপরিউক্ত আলোচনা থেকে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, রাজনৈতিক সমাজতত্ত্ব ও দর্শনশাস্ত্রের মধ্যে সম্পর্ক অঙ্গাঙ্গিভাবে সংযুক্ত।
তা সত্ত্বেও এ দু'টি বিষয়কে একেবারে অভিন্ন প্রতিপন্ন করা উচিত নয়। বস্তুত রাজনৈতিক সমাজতত্ত্ব ও দর্শন এক নয়।
বাস্তবে ঘটনার ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ ও মূল্যবোধের অনুশীলন পাশাপাশি করা সম্ভব। তবে উভয় ধরনের আলোচনার মধ্যে স্বাতন্ত্র্য সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য।
তবে কিছু পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও রাজনৈতিক সমাজতত্ত্ব ও দর্শনের সম্পর্ক একেবারে উপেক্ষা করা যায় না। এ প্রসঙ্গে ভিয়ারকান্ত মন্তব্য করেন, "Political sociology is productive only when it has a philosophical basis."