রাজনৈতিক সমাজতত্ত্বের পরিধি আলোচনা কর
রাজনৈতিক সমাজতত্ত্বের পরিধি আলোচনা কর |
রাজনৈতিক সমাজতত্ত্বের পরিধি আলোচনা কর
- অথবা, রাজনীতিক সমাজতত্ত্বের বিষয়বস্তু আলোচনা কর।
উত্তর : ভূমিকা : বস্তুত আন্তঃসামাজিক বিজ্ঞানকেন্দ্রিক আলোচনার সূত্র ধরেই রাজনীতিক সমাজতত্ত্বের আবির্ভাব ঘটে।
সমাজবিজ্ঞানীদের উদ্যোগ আয়োজনের পরিণতিতে রাজনীতির সমাজতত্ত্ব কালক্রমে রাজনীতিক সমাজতত্ত্বে রূপান্তরিত হয়। রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞান হলো ক্ষমতার সামাজিক ভিত্তি সম্পর্কিত আলোচ্য বিষয়।
রাজনীতিক সমাজতত্ত্ব : যে কোন সামাজিক বিজ্ঞানের ন্যায় রাজনীতিক সমাজতত্ত্বের সংজ্ঞা ও ধারণা তার আলোচনার পরিধির দ্বারাই নির্ধারিত হয়।
সাবেকি রাজনীতি ছিল সম্পূর্ণরূপে রাজনীতিকেন্দ্রিক। কিন্তু আধুনিক কালে বহুলাংশে সামাজিক স্বরূপ সম্পন্ন হয়ে পড়েছে। আধুনিক রাজনীতির বীজ বাস্তবে সমগ্র সমাজের বৃহত্তর ক্ষেত্রে পরিব্যাপ্ত।
রাজনীতিক সমাজতত্ত্বের বিষয়বস্তু : রাজনীতিক সমাজতত্ত্ব সমাজবিজ্ঞানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শাখা হিসেবে এর নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা করে।
নিম্নে এ বিষয়গুলো আলোচিত হল :
১. অরাজনীতিক রাজনীতি : রাজনীতির ক্ষেত্র সাম্প্রতিক সময়ে বিশেষভাবে সম্প্রসারিত হয়েছে। রাজনীতি আজ রাষ্ট্রীয় পরিধির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। রাষ্ট্রীয় গণ্ডির সীমাবদ্ধতা থেকে আধুনিক রাজনীতি অনেকাংশে মুক্ত।
এক অর্থে বলতে গেলে রাজনীতিক সমাজতত্ত্ব হল অরাজনীতিক রাজনীতি, রাজনীতিক সমাজতত্ত্ব রাজনীতি ও সমাজতত্ত্বের পরিবর্তনীয় উপাদানসমূহের মধ্যে প্রতিচ্ছেদগুলোকে নির্দিষ্ট করে এবং ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে।
২. ক্ষমতার আলোচনা : রাজনীতিক সমাজতত্ত্বের কেন্দ্রীয় বিষয় হল ক্ষমতা (Power)। এ ক্ষমতার একটি সামাজিক পটভূমি বর্তমান। রাজনীতিক সমাজতত্ত্বে ক্ষমতার আলোচনা করা হয় এ সামাজিক পটভূমিতে।
রাজনীতিক সমাজতত্ত্বের মুখ্য বিবেচ্যবিষয় হল সামাজিক ক্ষেত্রে সর্বব্যাপী ক্ষমতার ব্যাপ্তি। রাজনীতিক সমাজতত্ত্বে 'ক্ষমতা' বলতে এক ধরনের সামর্থ্যকে বুঝায়।
এ সামর্থ্যের ভিত্তিতে এক বা একাধিক ব্যক্তি বা সামাজিক গোষ্ঠী কোন বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট অন্যান্য ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর বিরোধিতার মুখেও নিজের বা নিজেদের অভিমত বা দাবিকে প্রতিষ্ঠা করে।
৩. ক্ষমতার সম্পর্কে নির্ভরতা : ক্ষমতার সামাজিক পটভূমির পরিপ্রেক্ষিতে রাজনীতিক সমাজবিজ্ঞানীরা ক্ষমতার দু'টি বৈশিষ্ট্যের উপর গুরুত্বারোপ করেছেন একটা হল ক্ষমতা সম্পর্ক সংক্রান্ত বিষয় এবং ক্ষমতা পরিমাপযোগ্য বিষয়।
ক্ষমতা সাধারণত অন্য ব্যক্তি, ব্যক্তিবর্গ বা সামাজিক গোষ্ঠীর উপর প্রয়োগ করা হয়ে থাকে। এ দু'ধরনের ক্ষমতার সম্পর্কের মধ্যে রাজনীতিক সমাজতত্ত্বে কেবলমাত্র মাত্রাগত তারতম্যের উপর গুরুত্বারোপ করা হয় ।
৪. ক্ষমতার পরিমাপযোগ্যতা : রাজনীতিক সমাজতত্ত্ববিদগণ ক্ষমতার পরিমাপযোগ্যতার কথাও বলেছেন। এ পরিমাপযোগ্যতাই আবার ক্ষেত্রবিশেষে ক্ষমতার উপর নিয়ন্ত্রণ কায়েমের উৎস হিসেবে কাজ করে থাকে।
ক্ষমতাবানের ক্ষমতার পরিমাপ করা গেলে, বিশেষ কোন ক্ষেত্রে ক্ষমতাবানের মাত্রাতিরিক্ত ক্ষমতার প্রয়োগও পরিমাপ করা যাবে। এ ভীতির জন্য ক্ষমতাবান ব্যক্তিবর্গ মাত্রাতিরিক্ত ক্ষমতা প্রয়োগ থেকে বিরত থাকেন।
৫. ক্ষমতার বৈধকরণ : রাজনীতিক সমাজবিজ্ঞানীরা ক্ষমতার বৈধকরণ বিষয়েও বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। ক্ষমতার বৈধকরণ বলতে ক্ষমতাকে কর্তৃত্বে পরিণত করাকে বুঝায়।
এভাবে ক্ষমতাকে বৈধ করতে পারলে ক্ষমতার উপর অধিকারকে অব্যাহত রাখা সম্ভব হয়। স্বভাবতই বৈধকরণের বিষয়টি ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণের চাবিকাঠি হিসেবে গণ্য করা হয়।
৬. ক্ষমতার কটন ও এলিট তত্ত্ব : রাজনীতিক সমাজতত্ত্বে ক্ষমতার বণ্টন ও এলিট তত্ত্ব প্রসঙ্গে আলোচনা করা হয়। সমাজে ক্ষমতাবান হওয়ার একটি কার্যকর উপায় হল সম্পদের অধিকার অর্জন।
সমাজের সীমাবদ্ধ সম্পদ মুষ্টিমেয় এলিট শ্রেণির হাতেই কেন্দ্রীভূত থাকে, এর থেকেই সৃষ্টি ক্ষমতার এলিট তত্ত্ব।
৭. রাজনীতিক সংস্কৃতি : রাজনীতিক সমাজতত্ত্বে রাজনীতিক সংস্কৃতি (Political culture) নিয়েও আলোচনা করা হয়। কারণ রাজনীতিক সমাজবিজ্ঞানীরা ক্ষমতার বৈধকরণের বিষয়টিকে বৃহত্তর দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার বিশ্লেষণ করে থাকেন।
রাজনীতিক সংস্কৃতি ও রাজনীতিক কাঠামোর মধ্যে সামঞ্জস্যের উপর মতৈক্য নির্ভরশীল। রাজনৈতিক সংস্কৃতি সমসত্ত্বতা মতৈক্যকে সুদৃঢ় করে। ফলে প্রচলিত রাজনৈতিক ব্যবস্থা স্থিতিশীলতা লাভ করে।
৮. রাজনীতিক সামাজিকীকরণ : রাজনীতিক সমাজবিজ্ঞানীরা রাজনীতিক সামাজিকীকরণের উপরও বিশেষ গুরুত্বারোপ করেছেন।
রাজনীতিক সামাজিকীকরণ বলতে একটি বিশেষ প্রক্রিয়াকে বুঝায়। এ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সমকালীন রাজনীতিক সংস্কৃতি পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে প্রবিষ্ট হয়।
৯. গণ অংশগ্রহণ : রাজনীতিক সমাজতত্ত্বে সরকারি কাজকর্মে জনগণের অংশগ্রহণ সম্পর্কেও গুরুত্বারোপ করা হয়। রাজনীতিক বিষয়ে গণ অংশগ্রহণের মাত্রাগত তারতম্যের উপর বিদ্যমান রাজনীতিক ব্যবস্থার স্থিতিশীলতা বহুলাংশে নির্ভরশীল।
গণ অংশগ্রহণের মাত্রা বা পর্যায় সামাজিক রাজনীতিক মনস্তাত্ত্বিক প্রভৃতি পরিবর্তনীয়ের দ্বারা নির্ধারিত হয়ে থাকে। স্বভাবতই দেশ, কাল নির্বিশেষে সকল রাজনৈতিক ব্যবস্থায় গণ অংশগ্রহণের মাত্রা ও স্তর সমান হয় না।
১০. সমাজব্যবস্থা ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা : সমাজস্থ ব্যক্তিবর্গ রাজনীতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশেষভাবে আচরণ তা ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের ব্যাপারে রাজনীতিক সমাজবিজ্ঞানীরা বিশেষভাবে আগ্রহী।
স্বভাবতই এ শ্রেণির সমাজবিজ্ঞানীদের সমাজ ও রাজনীতির পারস্পরিক সম্পর্ক প্রসঙ্গে আলোচনা করতে হয়।
অধ্যাপক D. K Biswas বলেন, "Political sociology can be defined as a study of political behaviour within a sociological framework."
১১. রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান : রাজনীতিক সমাজতত্ত্বে রাজনৈতিক দল ও স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী বা চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী সম্পর্কেও আলোচনা করা হয়।
কারণ সমাজব্যবস্থার মধ্যে ঐকমত্যে উপনীত হওয়ার প্রক্রিয়ায় কিছু কিছু সামাজিক গোষ্ঠী সক্রিয় উদ্যোগ বিশেষভাবে পরিলক্ষিত হয়। এ প্রসঙ্গে রাজনৈতিক দল ও স্বার্থগোষ্ঠীর কথা উল্লেখ করা যায়।
উপসংহার : প্রকৃত প্রস্তাবে বলা যায় যে, রাজনীতিক সমাজতত্ত্বে সমাজতত্ত্ব ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান উভয় উপাদানই বর্তমান।
রাজনীতিক সমাজবিজ্ঞানীরা রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও সমাজতত্ত্ব এ দুই সামাজিক বিজ্ঞানের বিশেষ কিছু উপাদানের সংযোগ সমন্বয়ের মাধ্যমে নিজেদের আলোচনা ক্ষেত্র গড়ে তুলেছেন।
রাজনীতিক সমাজতত্ত্বে রাজনীতির উপর সমাজের এবং সমাজের উপর রাজনীতির প্রভাব প্রতিক্রিয়া নিয়ে আলোচনা করা হয়।
অধ্যাপক আসরফ ও শর্মা এ প্রসঙ্গে মন্তব্য করেছেন, "Political sociology aims at understanding the sources and the social basis of conflict, as well as the process of management of conflict."