রাজনৈতিক সমাজতত্ত্বের অর্থনীতির সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য আলোচনা কর
রাজনৈতিক সমাজতত্ত্বের অর্থনীতির সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য আলোচনা কর |
রাজনৈতিক সমাজতত্ত্বের অর্থনীতির সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য আলোচনা কর
- অথবা, রাজনৈতিক সমাজতত্ত্বের সাথে অর্থনীতির সম্পর্ক বিশ্লেষণ কর ।
উত্তরঃ ভূমিকা : রাজনৈতিক সমাজতত্ত্ব ও অর্থবিদ্যা এ দু'টি সামাজিক বিজ্ঞান একে অপরের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কযুক্ত।
অর্থনৈতিক উপাদানসমূহের দ্বারা রাজনৈতিক সমাজব্যবস্থা প্রভাবিত হয়, আবার রাজনৈতিক পরিবেশ ও অর্থনৈতিক প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করে থাকে।
স্ব-স্ব বিষয়বস্তু আলোচনার ক্ষেত্রে সমজাতত্ত্ব ও অর্থনীতি পরস্পরকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে থাকে।
রাজনৈতিক সমাজতত্ত্ব : যে কোন সামাজিক বিজ্ঞানের ন্যায় রাজনৈতিক সমাজতত্ত্বের সংজ্ঞা ও ধারণা তার আলোচনার পরিধির দ্বারাই নির্ধারিত হয়। সাবেকি রাজনীতি ছিল সম্পূর্ণরূপে রাজনীতিকেন্দ্রিক।
কিন্তু আধুনিক কালে বহুলাংশে সামাজিক স্বরূপ সম্পন্ন হয়ে পড়েছে। আধুনিক রাজনীতির বীজ বাস্তবে সমগ্র সমাজের বৃহত্তর ক্ষেত্রে পরিব্যাপ্ত।
অর্থনীতির সাথে রাজনৈতিক সমাজতত্ত্বের সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য : বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক সমাজতত্ত্বের সাথে অর্থনীতির সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য উভয়ই পরিলক্ষিত হয়।
নিম্নে রাজনৈতিক সমাজতত্ত্বের সাথে অর্থনীতির সাদৃশ্য বিষয়সমূহ আলোচিত হল :
১. রাজনৈতিক সমাজতত্ত্ব ও অর্থনীতি একে অপরের পরিপূরক : রাজনৈতিক সমাজতত্ত্ব ও অর্থনীতি এ দু'টি সামাজিক বিজ্ঞান একে অপরের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কযুক্ত।
উভয়ের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক অত্যন্ত গভীর। অর্থনীতির মুখ্য ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল উৎপাদন, বণ্টন, ভোগ প্রভৃতি।
এসব বিষয় মানুষের সামাজিক জীবনকে যেমন প্রভাবিত করে তেমনি আবার সামাজিক জীবনের দ্বারাও রাজনৈতিক বিষয়সমূহ প্রভাবিত হয় ।
২. উভয়ের সাথে সম্পর্ক অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত : রাজনৈতিক সমাজতত্ত্বের জ্ঞান ছাড়া অর্থনীতির আলোচনা অসম্পূর্ণ ও বিপদগামী। অনুরূপভাবে, রাজনৈতিক সমাজতত্ত্বের আলোচনাও অর্থনৈতিক বিধিসমূহের ক্রিয়াপ্রতিক্রিয়ার ধারণা।
ব্যতিরেকে মূল্যহীন প্রতিপন্ন হয়। সেজন্য বলা হয়, সমাজতত্ত্ব ও অর্থনীতির মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক বস্তুত ওতপ্রোত ও অঙ্গাঙ্গিভাবে সংযুক্ত ।
অধ্যাপক বিদ্যাভূষণ ও সচদেব বলেন, "The fact that society is influenced by economic factors, which economic process are largely determined by the social environment."
৩. অর্থনীতি রাজনৈতিক সমাজতত্ত্বের উপর নির্ভরশীল : অর্থনীতি হল একটি সামাজিক বিজ্ঞানের অন্যতম শাখা। কিন্তু অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ একটি ব্যবহারিক দিক আছে।
স্বভাবতই একটি ব্যবহারিক বিজ্ঞান হিসেবে অর্থনীতির তাৎপর্য অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু অন্যান্য সামাজিক বিজ্ঞান বিশেষ করে সমাজতত্ত্বের সাহায্য ব্যতিরেকে অর্থনীতি বেশিদূর অগ্রসর হতে পারে না ।
৪. উভয়ে সমসাময়িক বিষয় নিয়ে আলোচনা করে : অর্থনীতির আলোচনা সামাজিক পারিপার্শ্বিকতাকে অস্বীকার করতে পারে না।
মানুষের অর্থনৈতিক আচার আচরণ, কাজকর্ম ও চিন্তাভাবনা প্রভৃতি সামাজিক ও রাজনৈতিক পারিপার্শ্বিকতা মূল্যবোধ, সামাজিক ও রাজনৈতিক কাঠামো প্রভৃতির উপর নির্ভরশীল।
এক্ষেত্রে উভয়ের মধ্যে সমসাময়িক বিষয়কে বেশি অগ্রাধিকার দিতে হয়। অধ্যাপক ম্যাকাইভার বলেন, “Thus economic phenomena is constantly determined by all kinds of social and political need."
৫. সমাজতত্ত্বের উপর অর্থনীতির প্রভাব : আবার অর্থনীতিও সমাজতত্ত্ব ও রাজনৈতিক সমাজতত্ত্বকে প্রভাবিত করে।
মানুষের সমাজজীবনের সকল ক্ষেত্রেই অর্থনৈতিক উপাদান ও শক্তিসমূহের গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব প্রতিক্রিয়া পরিলক্ষিত হয়। এ কারণে অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যাপারে সমাজতাত্ত্বিকদের আগ্রহী হতে দেখা যায়।
৬. মানুষের সামাজিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে : মানুষের সামাজিক ও রাজনৈতিক সম্পর্কসমূহ অর্থনৈতিক সম্পর্কের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে থাকে।
অধ্যাপক জিসবার্ট এর অভিমত অনুসারে সমাজে অর্থনৈতিক প্রক্রিয়ার বিকাশ প্রভাবিত করে মানুষের সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনকে।
মার্কসবাদী দার্শনিক (Karl Marx and Fredrick Engels) মানবসমাজের নির্ধারক হিসেবে একমাত্র অর্থনৈতিক উপাদানের উপর গুরুত্বারোপ করেছেন।
৭. অভিন্ন বিষয়বস্তু : মানবসমাজে এমন অনেক অর্থনৈতিক বিষয় বর্তমান যেগুলো সামাজিক ও রাজনৈতিক দিক থেকে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
সংশ্লিষ্ট বিষয়সমূহের অসামান্য সামাজিক তাৎপর্য অর্থনীতিবিদ ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ নির্বিশেষে কেউই অস্বীকার করতে পারে না।
৮. অনুশীলনের ক্ষেত্রে সাদৃশ্য : সাম্প্রতিককালে রাজনৈতিক সমাজতত্ত্ব ও অর্থনৈতিক অনুশীলনের ব্যাপারে অনেক ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য সাদৃশ্য বর্তমান, আধুনিক সমাজতত্ত্বের জনসম্প্রদায়ের আচার আচরণ বিশ্লেষণ ক্ষেত্রে পরিসংখ্যানমূলক ও গাণিতিক পদ্ধতি ব্যাপকভাবে অনুসৃত হয়। অনুরূপভাবে আধুনিক অর্থনীতির আলোচনায় উন্নতমানের বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়।
বৈসাদৃশ্য : রাজনৈতিক সমাজতত্ত্ব ও অর্থনীতির মধ্যে কিছু বৈসাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়, যা নিম্নে উল্লিখিত হল :
১. ভেদরেখা থাকে : রাজনৈতিক সমাজতত্ত্ব ও অর্থনীতির মধ্যে একটি ভেদরেখা বর্তমান থাকে। অধ্যাপক বােমোর বলেছেন, “আলোচ্য বিষয়বস্তু, আলোচনা ক্ষেত্রের পরিধি, অনুশীলনের পদ্ধতি দৃষ্টিভঙ্গি প্রভৃতির পরিপ্রেক্ষিতে সামাজিক বিজ্ঞানের এ দু'টি শাখার মধ্যে পার্থক্যের অস্তিত্ব পরিলক্ষিত হয়।”
২. আলোচনা ক্ষেত্রের পার্থক্য : আলোচনা ক্ষেত্রের প্রেক্ষিতে উভয়ের মধ্যে পার্থক্য বিদ্যমান রয়েছে। সমগ্র সমাজের সামগ্রিক আলোচনা রাজনৈতিক সমাজতত্ত্বে পাওয়া যায়, কিন্তু অর্থনীতিতে এর পরিপূর্ণ চিত্র পাওয়া যায় না।
৩. পরিধির ক্ষেত্রে পার্থক্য : রাজনৈতিক সমাজতত্ত্বের আলোচনা ক্ষেত্রের পরিধি অত্যন্ত ব্যাপক। অপরদিকে, অর্থনীতির আলোচনা ক্ষেত্রের পরিধি সংক্ষিপ্ত, অর্থনীতি সমাজের একটি বিশেষ দিক নিয়ে আলোচনা করে।
৪. অনুশীলনের ক্ষেত্রে পার্থক্য : রাজনৈতিক সমাজতত্ত্ব ও অর্থনীতির মধ্যে আলোচ্যবিষয় অনুশীলনের ক্ষেত্রে অনুসৃত পদ্ধতির ক্ষেত্রেও পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। আলোচ্য সামাজিক বিজ্ঞান দু'টির অনুশীলন পদ্ধতি একে অপর থেকে আলাদা।
৫. দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য : রাজনৈতিক সমাজতত্ত্বের আলোচনার ক্ষেত্রে একটি সার্বিক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করা হয়। অপরদিকে, অর্থনীতিতে সমাজবদ্ধ মানুষের অর্থনৈতিক আচার আচরণ ও কাজকর্ম ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ ক্ষেত্রে কেবলমাত্র অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করা হয়।
৬. প্রকৃতিগত পার্থক্য : রাজনৈতিক সমাজতত্ত্বের উপজীব্য বিষয় হল সমাজবদ্ধ মানুষের সাধারণত সমষ্টিগত আচার আচরণ। এ আলোচনা ব্যক্তিকেন্দ্রিক নয়।
অপরদিকে, অর্থনীতির আলোচনায় মানুষের ব্যক্তিগত আচার আচরণের উপর গুরুত্বারোপ করা হয়।
উপসংহার : রাজনৈতিক সমাজতত্ত্ব ও অর্থনীতি দু'টি স্বতন্ত্র বিষয়। এ বিষয়ে দ্বিমতের অবকাশ নেই। তা সত্ত্বেও উভয়ের মধ্যে যে গভীর ও নিবিড় সম্পর্ক বর্তমান সে কথাও অস্বীকার করা যায় না।
এ দু'টি সামাজিক বিজ্ঞানের পারস্পরিক নির্ভরশীলতা বিরোধ বিতর্কের ঊর্ধ্বে। এ বিষয়ে Prof. T. B. Bottomore তাঁর 'Sociology' শীর্ষক গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন, "Political sociology is a science of only recent growth whereas economics has attained as advanced degree of maturity."