রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রয়োজনীয়তা আলোচনা কর
রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রয়োজনীয়তা আলোচনা কর |
রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রয়োজনীয়তা আলোচনা কর
উত্তরঃ ভূমিকা : মানবজীবনের নিজস্ব স্বকীয়তা বিকাশের ক্ষেত্র হিসেবে সংস্কৃতি অন্যতম সহায়ক উপাদান। সংস্কৃতি জন্মগতভাবে মানুষ লাভ করে না।
এটাকে অর্জন করতে হয়। মানুষ তার পরিবেশ ও লোকাচার তথা তার সার্বিক পারিপার্শ্বিক অবস্থা থেকে সংস্কৃতির শিক্ষা অর্জন করে থাকে।
এ সম্পর্কে সমাজবিজ্ঞানী রস বলেন, "Culture is the total acquired behaviour patterns transmitted by immitation or instruction." তবে সামাজিক পরিবেশ হল সংস্কৃতি বিকাশের অন্যতম মাধ্যম।
মানুষের নিজস্ব সংস্কৃতি বিকাশের ক্ষেত্রে লোকাচার (Folkways) ও অবশ্য পালনীয় লোকরীতি (Mores) বিশেষ ভূমিকা রাখে।
রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রয়োজনীয়তা : পৃথিবীর যে কোন দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় রাজনৈতিক সংস্কৃতি (Political culture) একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রত্যয় হিসেবে কাজ করে।
রাজনৈতিক সংস্কৃতি রাষ্ট্রের ও জাতির রাজনৈতিক মূল্যবোধ, বিশ্বাস ও রাষ্ট্রের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে ফুটে উঠে।
শুধুমাত্র রাষ্ট্রের ক্ষেত্রেই নয়, মানুষের সামাজিক জীবনের ক্ষেত্রেও রাজনৈতিক সংস্কৃতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।
নিম্নে রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রয়োজনীয়তা বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হল :
১. আলমন্ড ও পাওয়েল এর অভিমত : সমাজবিজ্ঞানী আলমন্ড ও পাওয়েল (G. A. Almond and G. B. Powell) তাঁদের 'Comparative Politics' শীর্ষক গ্রন্থে যে মন্তব্য করেছেন সেখানে রাজনৈতিক সংস্কৃতির গুরুত্ব স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়।
তাঁদের অভিমত, "As people's attitudes affect what they will do a nation's political culture affects the conduct of its citizen and leaders thought the political system."
তাঁদের বক্তব্যে ব্যক্তির ও রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে Political culture বা রাজনৈতিক সংস্কৃতির গুরুত্ব সুস্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়।
২. লুসিয়ান পাই এর অভিমত : রাজনৈতিক সংস্কৃতির গুরুত্ব প্রসঙ্গে L. W. Pye অভিমত ব্যক্ত করেছেন। তাঁর রচিত 'Aspects of Political Development' গ্রন্থে এ বিষয়ে আলোচনা করেছেন।
উক্ত গ্রন্থে তিনি রাজনৈতিক, সংস্কৃতি ও সাধারণ সংস্কৃতি আলোচনা করতে গিয়ে বলেন সাধারণ সংস্কৃতির ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সংস্কৃতির গুরুত্ব ও তাৎপর্য বিরোধ বিতর্কের ঊর্ধ্বে।
তাঁর মতানুসারে রাজনৈতিক প্রক্রিয়া পদ্ধতি রাজনৈতিক সংস্কৃতির মাধ্যমে সুশৃঙ্খল ও অর্থপূর্ণ হয়ে উঠে। দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে সুশৃঙ্খল ও অর্থবহ করে তোলার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সংস্কৃতি সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
L. W. Pye এর অভিমত, "Political culture provides a means of linking micro-analysis and macro analysis."
৩. দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থার ক্ষেত্রে : পৃথিবীর সকল দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সংস্কৃতির ভূমিকা রয়েছে, সেক্ষেত্রে এদের ভূমিকাকে কোনভাবেই অস্বীকার করা যায় না।
রাজনৈতিক সমাজতত্ত্বের আলোচনা ক্ষেত্রের পরিপ্রেক্ষিতে এ আধুনিক ও নবীন সামাজিক বিজ্ঞানটির উপযোগিতা সহজেই উপলব্ধি করা যায়।
তাছাড়া একমাত্র রাজনৈতিক সংস্কৃতির মাধ্যমেই বর্তমান, সামাজিক ও রাজনৈতিক কাঠামোসমূহ সম্পর্কে সম্যকভাবে বিচার বিশ্লেষণ করা সম্ভব।
অন্যদিকে, আধুনিক রাজনৈতিক সমাজতত্ত্বের ধারণাসমূহ গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার ক্ষেত্রে যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি একনায়কতান্ত্রিক, স্বৈরতান্ত্রিক ও কমিউনিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থার ক্ষেত্রেও বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক।
৪. রাজনৈতিক সংস্কৃতি অধিক বাস্তববাদী : বর্তমান সমাজব্যবস্থায় রাজনৈতিক সমাজতত্ত্বের ভূমিকা বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। রাজনৈতিক সমাজতত্ত্ব অধিকতর বাস্তবমুখী কার্যসাধনে পারদর্শী।
আন্তঃসামাজিক বিজ্ঞানকেন্দ্রিক আলোচনার পথে যাবতীয় বাধাকে রাজনৈতিক সমাজতত্ত্ব অপসারিত করে ও সামাজিক বিজ্ঞানসমূহের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতার পথকে সুপ্রশন্ত করে রাজনৈতিক সংস্কৃতি জনগণকে অধিক আত্মসচেতন করে তোলে।
৫. রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার স্থিতিশীলতা : দেশের বিদ্যমান রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রকৃতির মাধ্যমে রাজনৈতিক ব্যবস্থার স্থিতিশীলতা বা পরিবর্তনের সম্ভাবনা সম্পর্কে সম্যকভাবে অবহিত হওয়া যায়।
সাধারণত জনসাধারণের রাজনৈতিক মূল্যবোধ ও মনোভাবের উপর রাজনৈতিক ব্যবস্থার স্থিতিশীলতা বহুলাংশে নির্ভর করে।
রাষ্ট্রের চলমান রাজনৈতিক ব্যবস্থা, তার মৌলিক কাঠামো ও কার্যপ্রক্রিয়া সম্পর্কে জনসাধারণ ব্যাপক ঐকমত্য পোষণ করতে পারে।
সেক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক ব্যবস্থা বিশেষভাবে শক্তিশালী ও স্থিতিশীল হয়ে উঠে। এ প্রসঙ্গে সমাজবিজ্ঞানী এলান বল বলেন, "Where this consensus is weak, there is gerater likelihood of the political system being challenged by disorder or even revolution."
৬. রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রতি জনগণের দৃষ্টিভঙ্গি : দেশের চলমান রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রতি জনগণের দৃষ্টিভঙ্গি দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির মাধ্যমে প্রকাশ পায়।
আর বিদ্যমান রাজনৈতিক ব্যবস্থার ব্যাপারে ব্যক্তিমানুষ, বিভিন্ন গোষ্ঠী ও সংগঠন, রাজনৈতিক দল প্রভৃতির মূল্যবোধ, মনোভাব, দৃষ্টিভঙ্গি ও বিশ্বাস তথা বিচার বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক সংস্কৃতির দৃষ্টিভঙ্গির বিভিন্ন সাহায্য সহযোগিতার প্রয়োজন পড়ে ।
৭. রাজনৈতিক ব্যবহার প্রকৃতি বুঝার ক্ষেত্রে : বিভিন্ন রাষ্ট্রের বিদ্যমান রাজনৈতিক ব্যবস্থায় অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সংস্কৃতির ভূমিকা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
বিশেষভাবে রাষ্ট্রের রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রকৃতি বুঝার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সংস্কৃতিই মুখ্য ভূমিকা পালন করে থাকে।
সাধারণত রাষ্ট্রের বিদ্যমান আর্থসামাজিক বিন্যাসের মাধ্যমে রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে উঠে। এ আর্থসামাজিক বিন্যাসে সংকট দেখা দিলে রাজনৈতিক সংস্কৃতিতেই সংকটের সৃষ্টি হয়।
৮. রাজনৈতিক সচেতনতা সৃষ্টি : দেশের জনগণকে রাজনৈতিক সচেতন করতে রাজনৈতিক সংস্কৃতির ব্যাপক গুরুত্বপূর্ণ অবদানকে কোনভাবেই অস্বীকার করা যায় না।
দেশের চলমান রাজনৈতিক ব্যবস্থায় অংশগ্রহণের মাত্রার পরিপ্রেক্ষিতে দেশবাসীর রাজনৈতিক বিষয়ে সচেতনতা ও সক্রিয়তার মান সহজেই অনুধাবন করা যায়।
কেননা রাজনৈতিক বিষয়ে সচেতনতার প্রকাশ ঘটে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অংশগ্রহণের মাধ্যমে। তাছাড়া দেশের বিদ্যমান রাজনৈতিক ব্যবস্থা সম্পর্কে বিভিন্ন ব্যক্তির মনোভাব ও দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে রাজনৈতিক সংস্কৃতির মাধ্যমে সহজেই অনুধাবন করা যায়।
৯. সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশের ক্ষেত্রে : সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের জন্য রাজনৈতিক সংস্কৃতি রাষ্ট্রের উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডকে বেগমান করতে সাহায্য করে।
বিশেষ করে বাংলাদেশসহ অন্যান্য তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে রাজনৈতিক সংস্কৃতি মানুষকে উন্নয়নের দ্বারপ্রান্তে নিতে সাহায্য করে।
তাছাড়া সদ্য স্বাধীন দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থার পুনর্গঠন, গণতান্ত্রিক মতাদর্শ প্রচার ও কূটনৈতিক সম্পর্ক অটুট রাখার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সংস্কৃতির ভূমিকা অনন্য ।
১০. অনগ্রসর রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে : অনগ্রসর রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা তথা রাষ্ট্রের সামগ্রিক উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সংস্কৃতি জনগণের মাঝে অনুপ্রেরণা যোগায়।
তৃতীয় বিশ্বের অনগ্রসর দেশের বিদ্যমান রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রতি জনগণের মনোভাব, মূল্যবোধ, বিশ্বাস ও দৃষ্টিভঙ্গি রাষ্ট্রের অনুকূলে রাখতে রাজনৈতিক সংস্কৃতি সকল স্বার্থকে উপেক্ষা করে জনকল্যাণকে অটুট রাখতে সাহায্য করে।
১১. গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে : রাষ্ট্রের বিদ্যমান রাজনৈতিক ব্যবস্থা গণতান্ত্রিক মতাদর্শের সাথে খাপখাওয়াতে গিয়ে মাঝেমধ্যে সংঘর্ষের সৃষ্টি হয়।
এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য বিদ্যমান রাজনৈতিক সংস্কৃতি গণতান্ত্রিক মতাদর্শকে প্রতিষ্ঠিত করতে বলিষ্ঠভাবে সহযোগিতা করে।
এ ধরনের রাজনৈতিক সংস্কৃতি গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণকারী ব্যবস্থাকে তাৎপর্যপূর্ণ করে তোলে। কেবলমাত্র নির্বাচিত আইনসভা, সর্বজনীন প্রাপ্তবয়স্কের ভোটাধিকার, রাজনৈতিক দলব্যবস্থা প্রভৃতি অংশগ্রহণকারী পণতন্ত্রের ধারণাকে বাস্তবে রূপায়িত করতে পারে না।
সেক্ষেত্রে ব্যক্তি, গোষ্ঠী তথা সমগ্র সমাজের রাজনৈতিক সচেতনতার মাত্রা রাজনৈতিক সংস্কৃতির মাধ্যমে প্রতিফলিত হয়ে উঠে।
১২. রাজনৈতিক ও সামাজিক জীবনে : রাজনৈতিক সংস্কৃতির মাধ্যমে রাষ্ট্রের জনগণের ও জাতির রাজনৈতিক মূল্যবোধ, বিশ্বাস ও দৃষ্টিভঙ্গিতে প্রতীয়মান হয়।
মানুষের সামাজিক জীবনে সামাজিক সংস্কৃতি যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি মানুষের রাজনৈতিক সংস্কৃতির গুরুত্ব ও তাৎপর্য অপরিসীম।
সমাজবিজ্ঞানী বুরলাটস্কি তাঁর The Modern State and Politics' শীর্ষক গ্রন্থে মন্তব্য করেন যে, রাজনৈতিক সংস্কৃতি রাজনৈতিক কার্যকলাপের মাত্রাকে বিশেষভাবে অনুধাবনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে ।
উপসংহার : উপরিউক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, রাষ্ট্রের বিদ্যমান রাজনৈতিক ব্যবস্থায় জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধি ও রাজনৈতিক ব্যবস্থায় অধিকাংশ জনগণকে সম্পৃক্ত করার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সংস্কৃতি জনগণকে উৎসাহ ও প্রেরণা যোগায়।
তাছাড়া রাষ্ট্রের বিভিন্ন বিধিবিধান ও তার উপযোগিতা ও গ্রহণযোগ্যতা পেতে রাজনৈতিক সংস্কৃতির বিশ্লেষণ একান্ত গুরত্বপূর্ণ।
এজন্যই L. W. Pye তাঁর 'Aspect of Political Analysis' গ্রন্থে বলেছেন, "Political culture encompasses both the political ideals and the operating norms of a polity."