রাজনৈতিক সামাজিকীকরণের মুখ্য মাধ্যমগুলো আলোচনা কর
রাজনৈতিক সামাজিকীকরণের মুখ্য মাধ্যমগুলো আলোচনা কর |
রাজনৈতিক সামাজিকীকরণের মুখ্য মাধ্যমগুলো আলোচনা কর
উত্তর ভূমিকা : "Political socialization is the establishment and development of attitudes and beliefs about political system."
আধুনিক সময়ে সমাজব্যবস্থার সফলতা নির্ভর করে রাজনৈতিক ব্যক্তিদের সামাজিকীকরণের উপর। রাজনৈতিক সামাজিকীকরণ ছাড়া কোন ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব পরিপূর্ণরূপে বিকশিত হয় নি।
এক্ষেত্রে সমাজ বিজ্ঞানী এরিস্টটল থেকে শুরু করে জন স্টুয়ার্ট মিল এর অপরাপর রাষ্ট্রচিত্মাবিদগণ রাজনৈতিক সামাজিকীকরণে সামাজিক পরিবর্তন এবং রাজনৈতিক উন্নয়নের উল্লেখযোগ্য দিক হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।
রাজনৈতিক সামাজিকীকরণ : রাজনৈতিক সামাজিকীকরণ হলো এমন একটি পদ্ধতি যার সাহায্যে শিশুর প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পথে রাজনৈতিক মূল্যবোধ ও মনোবৃত্তি জাগরিত করা যায় এবং প্রাপ্তবয়স্কদের বিভিন্ন রাজনৈতিক উপাত্তের উপযোগী করে গড়ে তুলা যায় ।
প্রামাণ্য সংজ্ঞা : বিভিন্ন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বিভিন্নভাবে রাজনৈতিক সামাজিকীকরণকে সংজ্ঞায়িত করেছেন। নিম্নে তাদের কয়েকটি সংজ্ঞা উল্লেখ করা হলো :
আলমন্ড ও পাওয়েল (Almond and Powell) বলেন, “রাজনৈতিক সামাজিকীকরণ হলো এমন এক প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে রাজনৈতিক সংস্কৃতি রক্ষিত ও পরিবর্তিত হয়ে থাকে।”
ডসন ও প্রিউইট (Dawson and Prewitt) বলেন, “রাজনৈতিক সামাজিকীকরণ একটি জাতির রাজনৈতিক কৃষির রূপদান করে ও দীর্ঘকাল জীবিত রাখে।”
রবার্ট হাইম্যান (Robert Hyman) বলেন, “রাজনৈতিক সামাজিকীকরণ আবেগজড়িত ও বাহ্যিক রাজনৈতিক আচার আচরণের ক্ষেত্রে সার্বক্ষণিক এক শিক্ষা পদ্ধতি।"
এলান আর. বল (Alan R. Ball ) এর মতে, “রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রতি সমানভাবে এবং রাজনৈতিক ব্যবস্থা সম্পর্কে বিশ্বাস সৃষ্টি করা এবং এর অগ্রগতিকেই রাজনৈতিক সামাজিকীকরণ বলে।”
Herbert Hymen এর মতে, "রাজনৈতিক সামাজিকীকরণ হচ্ছে আবেগজড়িত ও ব্যক্তি রাজনৈতিক ভাবধারার বা আচার ব্যবহার শিক্ষালাভের এক অত্মহীন প্রক্রিয়া।”
Gabriel A. Almond, "Political socialization is the process of induction in to the political culture."
তবে আমরা সামাজিকীকরণ প্রসঙ্গে বিভিন্ন রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞগণের চিম্মাধারা বিশ্লেষণ করে একটি গ্রহণযোগ্য সংজ্ঞা নির্ধারণ করতে পারি।
রাজনৈতিক সামাজিকীকরণ বলতে এমন একটি পন্থাকে বুঝায় যার মাধ্যমে কতকগুলো নির্দিষ্ট মূল্যবোধ, রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি সমাজের সদস্যদের মধ্যে সঞ্চারিত করার বাস্বব ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়।”
রাজনৈতিক সামাজিকীকরণের মুখ্য মাধ্যম : নিম্নে রাজনৈতিক সামাজিকীকরণের মুখ্য মাধ্যমগুলো আলোচনা করা হলো :
১. পরিবার : শিশু পরিবারে জন্মগ্রহণ করে, পরিবারে জীবন অতিবাহিত করে এবং পরিবারেই মৃত্যুবরণ করে। সুতরাং জন্মলগ্ন থেকেই পরিবারের মাধ্যমে শিশুর সামাজিকীকরণ শুরু হয়।
সামাজিকীকরণ এর মূল উদ্দেশ্য হল, শিশুর মধ্যে সংস্কৃতি স্থানান্তর, সেক্ষেত্রে পরিবার হল প্রথম ও প্রধানতম মাধ্যম। নতুন প্রজন্ম গঠনে পরিবার এর কোন বিকল্প নেই। কেননা-
ক. জন্মের পর কেবল পরিবারই শিশুর অভিজ্ঞতার উপর একচেটিয়া প্রভাব বিস্তারের সুযোগ পায়।
খ. শিশুর জীবনে পরিবারের প্রভাব অধিক স্থায়ী।
পরিবার এমন একটি 'Cohesive Primary Group' যার মাধ্যমে শিশুর মধ্যে, 'We Feeling' গড়ে উঠে। এর ফলে পরিবারের সদস্যদের থেকে অভ্যাস মনোভাব প্রভৃতি শিশুর মধ্যে সংক্রমিত হওয়ার পথ সুগম হয়।
২. সঙ্গী দল : ব্যক্তির সামাজিকীকরণে পরিবারের পরই সঙ্গী দল এর ভূমিকা অগ্রগণ্য। সংক্ষেপে বলতে গেলে সঙ্গী দল হল সমবয়সীদের এমন একটি দল যারা পরস্পর কতকগুলো সাধারণ বৈশিষ্ট্য যেমন- বয়স, লিঙ্গ, সম্প্রদায় ইত্যাদি বিষয়ে সমপর্যায়ের হয়।
মূলত সঙ্গী দল পরিবারের বাইরে ব্যক্তির সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ার প্রথম ধাপ নিয়ন্ত্রণ করে। এ পর্যায়ে শিশু পরিবারের গণ্ডির বাইরে তার সমবয়সীদের সাহচর্যে এসে তাদের সাথে মেলামেশা ও খেলাধুলা ইত্যাদি মিথষ্ক্রিয়ামূলক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়। তখন সে এমন কতকগুলো সামাজিক আচরণ ও বিষয় আয়ত্ত করে যা সে পরিবারে শিখে না।
৩. শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান : গৃহ পরিবেশে অর্জিত জ্ঞান ও মনোভাব নিয়ে শিশু বৃহত্তর সামাজিক পরিমণ্ডলে প্রবেশ করে। এ বৃহত্তম পরিমণ্ডলের প্রথম ধাপ হচ্ছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এক্ষেত্রে শিশুর সামাজিকীকরণে শিক্ষকমণ্ডলী, বইপত্র এবং শ্রেণিবন্ধুরা প্রভাব বিস্তার করে।
শিশু যখন প্রথম বিদ্যালয়ে প্রবেশ করে তখনই আনুষ্ঠানিকভাবে তার দীক্ষিতকরণ শুরু হয়। এখানে ক্রমে শিশু শিক্ষক, পাঠ্যপুস্তক ও সহপাঠীর সান্নিধ্য লাভ করে এবং এদের প্রভাব পড়ে শিশুর উপর।
এখানে এসে শিশু শুধুমাত্র পুঁথিগত বিদ্যাই অর্জন করে না, এর পাশাপাশি শিক্ষক ও বিভিন্ন পরিবার ও সংস্কৃতির প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে স্বীয় সমাজের মূল্যবোধ, নিয়ম এবং সমাজস্বীকৃত আচরণগুলো একটা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা দ্বারা আয়ত্ত করে। এ শিক্ষণের মাধ্যমে ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব দ্রুত উন্নত হয়।
৪. ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান : মানবসমাজে ধর্ম ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত মানুষের সমগ্র জীবনধারা জুড়ে ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের প্রভাব প্রতিক্রিয়া প্রবলভাবে প্রতিপন্ন হয়।
পরিবারের মাতাপিতার বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি পালন এবং সমাজস্থ ব্যক্তিবর্গের বিভিন্ন ধ্যানধারণা, আদর্শ ও বিশ্বাসে ধর্মের প্রভাব দেখে শিশু সামাজিকীকরণের শিক্ষা পায়।
ধর্ম নির্দেশিত পন্থায় জীবনযাপন করতে গিয়ে মানুষ অন্যায়, অত্যাচার, হিংসা, বিদ্বেষ, ক্রোধ, ঘৃণা ইত্যাদি বর্জন করে সহজ সরল জীবন সম্পর্কে প্রবৃত্ত হয়। আর এভাবেই সামাজিক সম্পর্ক উন্নত হয়।
৫. বিবাহ : যখন ব্যক্তি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়, তখন সে ব্যক্তিগত আচরণের ক্ষেত্রে এক নয়া রদবদল ও পরিবর্তন ধারার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়।
যে দু'টি পরিবারের মধ্যে বিবাহ হয় সে দু'টি পরিবারের অভ্যাস, ভাবধারা, আচার-আচরণ ভিন্ন হতে পারে। আর এ ধরনের দু'টি পরিবার পরস্পর পরস্পরের সাথে খাপখাওয়াতে পারলে সামাজিকীকরণের `আরেকটি পর্ব সম্পাদিত হয়।
বিবাহের পর যথাযথ নিয়মে সন্তান হয়। তখন ব্যক্তিকে নতুন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়। মাতাপিতা হিসেবে তাকে আবার পরিবারের সাথে খাপখাওয়াতে হয়। সুতরাং বলা যায়, বিবাহ ব্যক্তির সামাজিকীকরণের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
৬. প্রতিবেশী ও আত্মীয়স্বজন : পরিবারের পরেই শিশু নিকট প্রতিবেশী ও আত্মীয়স্বজনের সাথে মিশতে শুরু করে। তাদের কার্যকলাপ, কথাবার্তা, আচারব্যবহার, সংস্কৃতি বিভিন্ন বিষয় আয়ত্ত করতে থাকে, যা তার জীবনে সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলে । সুতরাং ব্যক্তির সামাজিকীকরণে প্রতিবেশীর ভূমিকা কম নয় ।
৭. গণমাধ্যম : বিজ্ঞানের উৎকর্ষতার ফলে প্রচার মাধ্যমগুলো বিশেষ করে টেলিভিশন, রেডিও, সিনেমা এবং এর সাথে পত্রপত্রিকা বা সাময়িকীসমূহ আমাদের সামাজিক জীবনে বিশেষ করে ব্যক্তির সামাজিকীকরণে বেশ কার্যকরী ভূমিকা রাখছে।
তবে এর মধ্যে দূরদর্শনের ভূমিকা সর্বাধিক। এ গণমাধ্যমগুলোতে ঐ সমাজের বিভিন্ন আদর্শ ও মূল্যবোধের প্রকাশ ঘটে।
বিশেষ করে সমাজের পরিবর্তিত মূল্যবোধ ও মনোভাবগুলোর প্রকাশ পায়, যা ব্যক্তির সামাজিকীকরণে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
তাছাড়া প্রচার মাধ্যমগুলো বৈশ্বিক সংস্কৃতির সাথে ব্যক্তির পরিচয় ঘটায়। বিভিন্ন প্রকার শিক্ষামূলক, বিনোদনমূলক ও সমাজসেবামূলক অনুষ্ঠানসহ বিভিন্ন প্রকার বিজ্ঞাপন প্রচার করা হয় যার দ্বারা ব্যক্তি প্রভাবিত হয় এবং ব্যক্তি বিভিন্ন পরিবেশের সাথে খাপখাওয়াতে শিখে।
এক গবেষণায় দেখা গেছে, আমেরিকার ৩-১৬ বছর বয়সীরা বিদ্যালয়ের চেয়ে টেলিভিশনের সামনেই বেশি সময় কাটায়। টেলিভিশনের যে প্রভাব শিশুর প্রতি তাকে খাটো করে দেখার অবকাশ নেই। [Somelser, Sociology P-68]
৮. বই ও ম্যাগাজিন : যারা লিখতে ও পড়তে পারে তাদের সামাজিকীকরণে পুস্তক এবং সাময়িক পত্রপত্রিকা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
আমাদের চিন্তার জগৎ অর্থাৎ আমাদের অভিজ্ঞতা এবং জ্ঞান, মূল্যবোধ এবং ভাবাদর্শ নানারকমের সংস্কার এবং বিশ্বাস ছাপার অক্ষরে প্রতিবিম্বিত হয়।
কাজেই নানারকমের পুস্তক ও পত্রপত্রিকা আমাদেরকে সমাজে প্রচলিত ধ্যানধারণার সাথে পরিচিত হতে সাহায্য করে।
৯. রাষ্ট্র : রাষ্ট্র একটি শক্তিশালী সংগঠন। এটি আইন তৈরি করে এবং আশা করে যে, সবাই যেন আইন পালন করে। সকলকে বাধ্যতামূলক আইন মানতে হয়। কেউ যদি ব্যর্থ হয়, তাহলে তার জন্য রয়েছে শাস্তি। এভাবেই রাষ্ট্র ব্যক্তির আচরণে প্রভাব ফেলে।
১০. অন্যান্য মাধ্যম : আসর, সভাসমিতি, যুব সংগঠন, রাজনৈতিক দল, ক্রীড়া প্রতিষ্ঠান প্রভৃতি মাধ্যম দ্বারা ব্যক্তি নীতিবান, স্বেচ্ছাসেবী, অধিকার, আনন্দ প্রভৃতি অর্জনের মাধ্যমে সমাজ স্বীকৃত হয়ে থাকে।
উপসংহার : পরিশেষে উপরিউক্ত আলোচনা থেকে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, সামাজিকীকরণ হচ্ছে সামাজিক মিথষ্ক্রিয়া এবং সমাজের বাইরে এটি সম্ভব নয়।
সামাজিকীকরণ একটি জীবনব্যাপী চলমান প্রক্রিয়া। পারিবারিক জীবনে মাতাপিতা ও ভাইবোন থেকে শুরু করে সমাজজীবনের প্রতিটি স্তরে এসে বিভিন্ন গণমাধ্যমের সাহায্যে ব্যক্তির সামাজিকীকরণ হয়।
আত্মীয়স্বজন ছাড়া প্রতিবেশী, খেলার সাথি, বন্ধুবান্ধব, শিক্ষক, সহপাঠী, বইপুস্তক, রেডিও, টেলিভিশন, ম্যাগাজিন, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন ইত্যাদির সবকিছু ব্যক্তির সামাজিকীকরণে সাহায্য করে থাকে। এজন্য বলা হয় সামাজিকীকরণ সমাজের প্রতিটি অবয়বের সাথে যুক্ত।