রাজনৈতিক কৃষ্টি কিভাবে বাংলাদেশের রাজনীতিকে প্রভাবিত করে
রাজনৈতিক কৃষ্টি কিভাবে বাংলাদেশের রাজনীতিকে প্রভাবিত করে |
রাজনৈতিক কৃষ্টি কিভাবে বাংলাদেশের রাজনীতিকে প্রভাবিত করে
- অথবা, রাজনৈতিক সংস্কৃতি কাকে বলে? বাংলাদেশের রাজনীতিতে রাজনৈতিক কৃষ্টির গুরুত্ব/প্রভাব আলোচনা কর।
উত্তরঃ ভূমিকা : রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞানের অন্যতম আলোচ্যবিষয় হচ্ছে রাজনৈতিক সংস্কৃতি। বিশ্বায়নের এ যুগে বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যবস্থার পারস্পরিক তুলনামূলক আলোচনার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রয়োগ করা হয়।
রাজনৈতিক সংস্কৃতির আলোচনায় সর্বপ্রথম জি. এ. অ্যালমন্ডের নাম উঠে আসে; যিনি ১৯৫৬ সালে বিষয়টি সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ ধারণা দেন।
কোন সমাজের সভ্যগণ ঐ সমাজের রাজনৈতিক ব্যবস্থা, কাঠামো, ভূমিকা সম্পর্কে যে অনুভূতি, মূল্যবোধ, দৃষ্টিভঙ্গি ও ধারণা পোষণ করে তার সমষ্টিই রাজনৈতিক সংস্কৃতি। ফলে একটি দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি অন্যদের থেকে আলাদা প্রকৃতির হয়ে থাকে।
রাজনৈতিক সংস্কৃতির সংজ্ঞা : রাজনৈতিক সংস্কৃতি যে কোন দেশের রাজনীতির পরিচায়ক। সাধারণ অর্থে, রাজনৈতিক সংস্কৃতি মানুষের রাজনৈতিক জীবনবোধ বা জীবনধারা। আসলে রাজনৈতিক সংস্কৃতি হচ্ছে রাজনৈতিক ব্যবস্থা সম্পর্কে জনগণের মূল্যবোধ, বিশ্বাস ও অনুভূতির সমষ্টি।
প্রামাণ্য সংজ্ঞা : রাজনৈতিক সংস্কৃতি সম্পর্কে বিভিন্ন মনীষী ও রাষ্ট্রচিন্তাবিদ বিভিন্ন ধরনের মতামত প্রদান করেছেন। নিম্নে তাঁদের কয়েকটি সংজ্ঞা উল্লেখ করা হলো :
জি. এ. অ্যালমন্ড ও জি. বি. পাওয়েল (G.A Almond & G. B Powell ) এর মতে, “রাজনৈতিক সংস্কৃতি হলো রাজনৈতিক ব্যবস্থার সদস্যদের রাজনীতির প্রতি ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গি ও মনোভাবের ধরন।”
(Political Culture is the pattern of individual attitudes and orientations towards among the members of a Political system.)
অধ্যাপক এ. আর. বল (A.R.Ball) এর মতে, “রাজনৈতিক ব্যবস্থা ও রাজনৈতিক বিষয়ের প্রতি সমাজের মনোভাব, বিশ্বাস, আবেগ এবং মূল্যবোধগুলোকে রাজনৈতিক সংস্কৃতি বলে।"
(Political culture is composed of attitudes, beliefs, emotions and values of society that relate to the political system and political issues.)
অধ্যাপক অমল কুমার মুখোপাধ্যায় বলেন, "Political culture is composed of attitudes and orientations which people in a given society develop toward objects within their political system."
ডেভিস এবং লুইস (Davies & Lewis) এর মতে, “একটি নির্দিষ্ট সমাজের রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপের প্রতি তার সদস্যদের দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে রাজনৈতিক সংস্কৃতি।” (Political culture is the pattern of orientations to political action within a given society.)
বিয়ার এবং ইউলাম (Beer & Ulam) এর মতে, “রাজনৈতিক সংস্কৃতি বলতে কোন সমাজের সার্বিক সংস্কৃতির সেসব বৈশিষ্ট্যকে বুঝায় যা সরকার পরিচালনা এবং সরকারের কর্তব্য পালনের সাথে সংশ্লিষ্ট।”
উপর্যুক্ত সংজ্ঞাগুলোর আলোকে বলা যায় যে, রাজনৈতিক সংস্কৃতি হলো বিদ্যমান রাজনৈতিক ব্যবস্থা সম্পর্কে জনগণের জ্ঞান ও মনোভাব, রাজনৈতিক বিশ্বাস, মূল্যবোধ, আচার আচরণ ও দৃষ্টিভঙ্গির সমন্বিত রূপ।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে রাজনৈতিক কৃষ্টির গুরুত্ব/প্রভাব : বিশ্বের কমবেশি সব রাষ্ট্রের রাজনীতিই রাজনৈতিক কৃষ্টি দ্বারা প্রভাবিত হয়ে থাকে। বিশেষকরে তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এর প্রভাব অত্যন্ত স্পষ্ট।
নিম্নে বাংলাদেশের রাজনীতিতে রাজনৈতিক কৃষ্টির প্রভাব আলোচনা করা হলো :
১. রাজনৈতিক ব্যবস্থা ও কৃষ্টির পারস্পরিক নির্ভরশীলতা : রাজনৈতিক ব্যবস্থা ও রাজনৈতিক কৃষ্টির মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বিদ্যমান। আর রাজনৈতিক ব্যবস্থা ও কৃষ্টি উভয়েই পরস্পরের উপাদান দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়ে থাকে।
যেমন একটি দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় যখন কোন নতুন মতবাদ বা ভাবধারার উদ্ভব ঘটে তখনই সেটি ঐ দেশের রাজনৈতিক কৃষ্টিকে প্রভাবিত করে এবং রাজনৈতিক কৃষ্টির একটি অংশে পরিণত হয়।
অর্থাৎ রাজনৈতিক ভাবধারা ও মনোভাব পরিবর্তনের সাথে সাথে রাজনৈতিক কৃষ্টিও পরিবর্তিত হয়। এভাবেই রাজনৈতিক উন্নয়ন ঘটে।
২. দুর্বল নেতৃত্ব : বাংলাদেশের রাজনৈতিক কৃষ্টিতে নেতৃত্বের দুর্বলতা পরিলক্ষিত হয়। দুর্বল নেতৃত্বের ফলে বাংলদেশে আজও সুদৃঢ় ও শক্তিশালী রাজনৈতিক কাঠামো গড়ে তোলা সম্ভব হয় নি।
তাছাড়া নেতার ব্যক্তিত্ব, ব্যক্তিগত সংহতি ও গুণাবলির দুর্বলতার কারণে বাংলাদেশের জনগণ রাজনৈতিক ব্যবস্থার সুফল ভোগ করতে পারছে না।
৩. রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা : অস্থিতিশীলতা বাংলাদেশের রাজনৈতিক কৃষ্টির একটি অন্যতম দিক। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার দরুন বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের রাজনৈতিক উন্নয়ন প্রায়শই মুখ থুবড়ে পড়ে।
বাংলাদেশসহ বিশ্বের অনেক দেশে ঘন ঘন রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সহিংসতার ঘটনা ঘটে। এরূপ অরাজকতা রাজনৈতিক ব্যবস্থার ভঙ্গুরতাকে প্রকাশ করে মাত্র।
৪. দলীয় সংহতির অভাব : বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে বিদ্যমান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক ঐক্য ও সংহতির মারাত্মক অভাব রয়েছে।
দলীয় সংহতির অভাবে বাংলাদেশের মানুষ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে ঐকমত্যে পৌঁছাতে ব্যর্থ হয়।
তাছাড়া রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংহতির অভাব থাকায় সর্বদাই তারা পরস্পরবিরোধী অবস্থানে থাকে। এতে রাজনৈতিক উন্নয়নের গতি বাধাগ্রস্ত হয়।
৫. অসচেতনতা : বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে সচেতনতার অভাব রয়েছে। এ অসচেতনতাই রাজনৈতিক উন্নয়নের সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা।
বাংলাদেশের জনগণ রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড, সরকারের গঠন, কার্যাবলি ও ভূমিকা, নিজের অধিকার ও দায়দায়িত্ব সম্পর্কে যথেষ্ট উদাসীন।
এ উদাসীনতাই বাংলাদেশের জনগণের একটি চিরাচরিত বৈশিষ্ট্য হিসেবে আজও বিদ্যমান। ফলে সমাজের একটি বৃহৎ অংশ শোষণ, লাঞ্ছনা ও বঞ্চনার শিকার হচ্ছে এই অসচেতনতার কারণেই ।
৬. অগণতান্ত্রিক মনোভাব : বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনৈতিক এলিটগণ তাদের কর্তৃত্ববাদী মনোভাবের দরুন প্রায়শই অগণতান্ত্রিক আচরণ করে থাকে। এরূপ অগণতান্ত্রিক মনোভাব আদর্শ রাজনৈতিক সংস্কৃতির জন্য হুমকিস্বরূপ।
৭. ব্যক্তি, আবেগ ও সম্মোহনী নেতৃত্বকেন্দ্রিক রাজনীতি : বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি ব্যক্তিকেন্দ্রিক আবেগ, অনুভূতি এবং সম্মোহনী নেতৃত্বের উপর নির্ভরশীল।
ফলে রাজনীতিতে আদর্শের চেয়ে ব্যক্তিবিশেষের চিন্তা চেতনাকে বিশেষ গুরুত্বারোপ করা হয়। এরূপ ব্যক্তিকেন্দ্রিক আদর্শ ও চিন্তাধারা বাংলাদেশের রাজনৈতিক উন্নয়নের পথে অন্যতম প্রতিবন্ধকতা।
৮. সরকার ও জনগণের আস্থাহীনতা : বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে রাষ্ট্র ও জনগণের মধ্যে দা- কুমড়ার সম্পর্ক বিরাজমান। সরকার ও জনগণ উভয়েই পরস্পরবিরোধী অবস্থানে থাকে।
তাছাড়া নেতাদের শহরমুখিতা, অগণতান্ত্রিক মনোভাব, রাজনৈতিক অপেশাদারিত্ব এবং সুযোগসন্ধানী চরিত্রের দরুন এলিটদের প্রতি সাধারণ জনগণের আস্থাহীনতা ও দূরত্ব তৈরি হয়েছে।
৯. জনগণের উদাসীনতা : বাংলাদেশের অধিকাংশ লোক অশিক্ষিত হওয়ায় রাজনীতি সম্পর্কে তারা বেশ অজ্ঞ। এ অজ্ঞতাবশত তারা রাজনৈতিক সংস্কৃতি সম্পর্কে জানার তেমন কোন আগ্রহ দেখায় না।
ফলে তারা বিদ্যমান রাজনীতির প্রকৃত সুফল ভোগ করতে ব্যর্থ হয়। এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের রাজনীতি আজও পশ্চাৎপদ ও নিম্নমুখি কাঠামোর উপর নির্ভরশীল।
১০. সামরিক শাসনের প্রভাব : বাংলাদেশের রাজনীতিতে সামরিক শাসনের নেতিবাচক প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়কালে বাংলাদেশে বেশ কয়েকবার সামরিক শাসন জারি করা হয়েছিল।
এতে রাজনৈতিক কাঠামোর গতিপ্রকৃতি শৃঙ্খলিত হয়ে পড়ে। বাংলাদেশের রাজনীতির এরূপ কৃষ্টি নিঃসন্দেহে রাজনৈতিক উন্নয়নের পথে আজও হুমকিস্বরূপ।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার আলোকে বলা যায় যে, যে কোন দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি ঐ দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থার আয়নাস্বরূপ।
তাই, রাজনৈতিক ব্যবস্থার মূল্যায়নের সর্বশ্রেষ্ঠ মাধ্যম রাজনৈতিক কৃষ্টির চুলচেরা বিশ্লেষণ। তাছাড়া একটি দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থা ও রাজনৈতিক সংস্কৃতির মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই ঘনিষ্ঠ যোগসূত্র থাকে।
এ সূত্র ধরে আমরা বলতে পারি যে, একটি দেশের রাজনৈতিক ভিত্তি কতটা শক্তিশালী বা দুর্বল হবে তা নির্ণায়কের বড় মাধ্যম হচ্ছে ঐ দেশের রাজনৈতিক কৃষ্টি। তবে একথা সত্য যে, উন্নত রাজনৈতিক কৃষ্টি ব্যতীত কখনোই উন্নত রাজনৈতিক ব্যবস্থা আশা করা যায় না।