রাজনৈতিক ব্যবস্থা কাকে বলে । রাজনৈতিক ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য আলোচনা কর
রাজনৈতিক ব্যবস্থা কাকে বলে । রাজনৈতিক ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য আলোচনা কর |
রাজনৈতিক ব্যবস্থা কাকে বলে । রাজনৈতিক ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য আলোচনা কর
- অথবা, রাজনৈতিক ব্যবস্থা কী? রাজনৈতিক ব্যবস্থার উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্যগুলো বর্ণনা কর ।
উত্তর : ভূমিকা : আধুনিক চিন্তাবিদদের অভিমত অনুসারে একটি দেশের রাজনৈতিক অবস্থা ও কর্মধারার স্বরূপে বিচার বিবেচনার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক ব্যবস্থার বিশ্লেষণ সাহায্য করে।
প্রকৃত প্রস্তাবে রাজনৈতিক ব্যবস্থা হল মানুষের আচার ব্যবহারের ভিত্তিতে নির্ধারিত যাবতীয় রাজনৈতিক পদ্ধতি ও কার্যাবলি ।
রাজনৈতিক ব্যবস্থা : সমাজের ভিতর সকল প্রকার রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনসমূহের বৈশিষ্ট্য, প্রকৃতি, পারস্পরিক সম্পর্ক প্রভৃতি বিষয়কে রাজনৈতিক ব্যবস্থা হিসেবে অভিহিত করা হয়।
প্রামাণ্য সংজ্ঞা : বিভিন্ন সমাজবিজ্ঞানী রাজনৈতিক ব্যবস্থার 'সংজ্ঞা প্রদান করেছেন। নিম্নে সেগুলো ধারাবাহিকভাবে উল্লেখ করা হল :
আধুনিক চিন্তাবিদরা রাজনৈতিক জীবনের সকল দিক সামগ্রিকভাবে বিচার বিশ্লেষণের উপযোগী এক ধারণা গড়ে তোলার পক্ষপাতী।
এ শ্রেণির চিন্তাবিদদের মধ্যে ডেভিড ইস্টন, অ্যালান বল, অ্যালমন্ড ও পাওয়েল, মর্টন ক্যাপলান, কোলম্যান প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য ।
অধ্যাপক বল বলেন, "A more rewarding approach to the problems of classification would be to classify types of political system rather than to concentrate an types of Governments".
ডেভিড ইস্টন (David Eastop) তাঁর The Political System' শীর্ষক রচনায় রাজনৈতিক ব্যবস্থা সম্প বিস্তারিত আলোচনা করেছেন।
Easton বলেছেন, "Political system is that system to interactions in any society through which binding or authoritative allocations are made." ইস্টন এর মতানুসারে বলা যায় রাজনৈতিক ব্যবস্থা হল সমাজের সেই সমস্ত ক্রিয়াপ্রতিক্রিয়া ব্যবস্থা যার মাধ্যমে বাধ্যতামূলক নীতিনির্ধারণের সিদ্ধান্তসমূহ গৃহীত হয়।
অ্যালমন্ড ও পাওয়েল (G. A. Almond and G. B. Powell) তাঁদের 'Comparative Politics : A Development Approach' শীর্ষক গ্রন্থে রাজনৈতিক ব্যবস্থা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন।
তাঁদের মতে, " (Political system) directs attention to the entire scope of political activities within a society, regardless of where in the society such activities may be located."
ডেভিড উড (David M. Wood) বলেছেন, "Political system thus becomes a set of interrelated variables conceived to be politically relevant and treated as if they could be separated from other variables conceived to be.....not immediately relevant to politics.
সর্বোপরি বলা যায় যে, রাষ্ট্র ও রাজনৈতিক ক্ষমতার দ্বারা রাজনৈতিক ব্যবস্থা অনুমোদিত হয়। রাজনৈতিক ব্যবস্থা হল রাজনৈতিক বিচারে প্রাসঙ্গিক এমন বেশ কিছু পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত পরিবর্তনীয় (Variable) সমন্বিত ব্যবস্থা।
রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্য : সমাজবিজ্ঞানী অ্যালমন্ড ও পাওয়েল (G. A. Almond and G. B. Powell) রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রকৃতি ও বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আলোচনা করেছেন।
এ দুই আধুনিক রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞানীর আলোচনায় রাজনৈতিক ব্যবস্থায় বহু ও বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের পরিচয় পাওয়া যায়। এসব বৈশিষ্ট্যের মধ্যে নিম্নলিখিত বৈশিষ্ট্যগুলো বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য
১. অন্তর্ভুক্তিমূলক (Comprehensive) : রাজনৈতিক ব্যবস্থা হল অন্তর্ভুক্তিমূলক। বিভিন্ন উপকরণের সমন্বয়ে রাজনৈতিক ব্যবস্থা পরিচালিত। দৈহিক বলপ্রয়োগের সাথে সম্পর্কযুক্ত যাবতীয় মিথস্ক্রিয়া (Interactions) ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত।
রাজনৈতিক ব্যবস্থার সাথে সম্পর্কযুক্ত সকল কাঠামোই রাজনৈতিক ব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত। বিভিন্ন আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান রাজনৈতিক ব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত।
জাতপাতের ভিত্তিতে গড়ে উঠা গোষ্ঠী, স্বার্থগোষ্ঠী, রাজনৈতিক দল, সংযোগসাধনমূলক সংস্থাসমূহ প্রভৃতি রাজনৈতিক ব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত বিষয়।
২. পারস্পরিক নির্ভরশীলতা ( Interdependence) : রাজনৈতিক ব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত অংশসমূহ অনেক। এসব অংশ পরস্পরের উপর নির্ভরশীল। কোন একটি ক্ষেত্রে মিথষ্ক্রিয়ার পরিবর্তন অন্যান্য ক্ষেত্রেও পরিবর্তন সূচিত করে।
সমাজবিজ্ঞানী অ্যালমন্ড (Almond) বলেছেন, .......by interdependence we mean that a change in one subset of interactions produces changes in all the other subjects."
উদাহরণ হিসেবে বলা যায় যে, যোগাযোগ ব্যবস্থায় প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের প্রভাব রাজনৈতিক দল, আইনসভা, শাসনবিভাগ প্রভৃতি ক্ষেত্রে পরিলক্ষিত হয়।
৩. সীমানা (Boundary) : সকল রাজনৈতিক ব্যবস্থাতেই অন্যান্য ব্যবস্থার সাথে রাজনৈতিক ব্যবস্থার সীমানা নির্ধারণ করা হয়। অন্যান্য ব্যবস্থার সমাপ্তি এবং রাজনৈতিক ব্যবস্থার শুরু সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা থাকে।
রাজনৈতিক ব্যবস্থা সমাজের কতকগুলো মিথস্ক্রিয়াকে স্বতন্ত্র করে নিয়ে নিজের অন্তর্ভুক্ত করে। রাজনৈতিক ব্যবস্থার সীমানা সম্পর্কে Almond 4, "When we talk about good and bad boundary maintenance, we must use criteria appropriate for boundary maintenance."
৪. রাজনৈতিক কাঠামো (Political structure) : বিশেষীকৃত কাঠামোর পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যে পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। প্রত্যেক রাজনৈতিক ব্যবস্থাতেই নিজস্ব রাজনৈতিক কাঠামো বর্তমান থাকে।
এ রাজনৈতিক কাঠামোই হল সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক ব্যবস্থার গ্রস্থিকরণ, পুঞ্জীকরণ এবং সংযোগসাধনমূলক কার্যাবলির ভিত্তি।
৫. সংমিশ্রিত সংস্কৃতি (Mixed culture): সংস্কৃতিগত বিচারে সকল রাজনৈতিক ব্যবস্থাই হল মিশ্র প্রকৃতির । কোন রাজনৈতিক ব্যবস্থাতেই অবিমিশ্র রাজনৈতিক সংস্কৃতি দেখা যায় না।
প্রাচ্যের বা পাশ্চাত্যের রাজনৈতিক ব্যবস্থাসমূহ অথবা প্রাচীন বা আধুনিক রাজনৈতিক ব্যবস্থাসমূহ অবিমিশ্র রাজনৈতিক সংস্কৃতিসম্পন্ন নয়।
আধুনিক রাজনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যে প্রাচীন কালের রাজনৈতিক সংস্কৃতির উপাদান দেখা যায়। অনুরূপভাবে আবার প্রাচ্যের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় পাশ্চাত্যের রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিচয় পাওয়া যায়।
৬. বহু উদ্দেশ্য সাধক (Multifunctionality) : রাজনৈতিক কাঠামোর কার্যাবলি বহু ও বিভিন্ন। আধুনিক রাজনৈতিক ব্যবস্থার একটি বড় বৈশিষ্ট্য হল কাঠামোগত পৃথকীকরণের আনুপাতিক আধিক্য।
রাজনৈতিক কাঠামোর বিভিন্ন অংশে এ পৃথকীকরণ লক্ষ্য করা যায়। এক্ষেত্রে উদাহরণ হিসেবে আইনসভা, আদালতসমূহ, আমলাতন্ত্র, সংগঠিত স্বার্থগোষ্ঠীসমূহ, রাজনৈতিক দল, নির্বাচন ব্যবস্থা প্রভৃতি রাজনৈতিক কাঠামোর কথা উল্লেখ করা যায়।
রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ধারাবাহিকভাবে এবং ঐতিহ্যগত বিষয়াদিকে রাজনৈতিক ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালিত করে।
Prof. Almond বলেছেন, " (Political system) can penetrate it, regulate it, translate its particularistic and diffused impacts. into the moderns political language of interest articulation, public policy and regulation."
৭. রাজনৈতিক কার্যাবলি (Political functions) : রাজনৈতিক ব্যবস্থাতেই বিভিন্ন রাজনৈতিক কার্যাবলি সম্পাদন করে। রাজনৈতিক ব্যবস্থার ক্রিয়াবাদী (Functional) ব্যাখ্যার পরিপ্রেক্ষিতে রাজনৈতিক ব্যবস্থার বিভিন্ন ভূমিকা ও কার্যাবলির কথা বলা হয়।
অধ্যাপক অ্যালমস্ত রাজনৈতিক ব্যবস্থার কার্যাবলিকে দু'টি শ্রেণিতে বিভক্ত করেছেন। এ দু'টি শ্রেণির কার্যাবলি হল উপকরণ শ্রেণির কার্যাবলি (Input categories) এবং উপপদ শ্রেণির কার্যাবলি (Output categories)।
উপকরণ শ্রেণির কার্যাবলির অন্তর্ভুক্ত বিষয় হল রাজনৈতিক সামাজিকীকরণ ও নিয়োগ, স্বার্থসমূহের গ্রন্থিকরণ (Articulation) স্বার্থসমূহের পুঞ্জিকরণ (Aggregation) প্রভৃতি। উপপস শ্রেণির কার্যাবলির অন্তর্ভুক্ত হল নিয়মনীতি প্রণয়ন, নিয়মনীতির প্রয়োগ প্রভৃতি।
৮. সর্বজনীনতা (Universality) : রাজনৈতিক ব্যবস্থা হল একটি সর্বজনীন ব্যবস্থা। আদিম বা আধুনিক নির্বিশেষে এবং উন্নত বা উন্নয়নশীল নির্বিশেষে সবধরনের সমাজব্যবস্থাতেই এক ধরনের রাজনৈতিক ব্যবস্থা বর্তমান দেখা যায়।
এ ব্যবস্থার মাধ্যমে সমাজজীবনের বিধিসম্মত মিথষ্ক্রিয়া অব্যাহত থাকে এবং অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক ক্ষেত্রে শৃঙ্খলা বজায় রাখা সম্ভবপর হয়।
এ অভ্যন্তরীণ কাঠামোর প্রেক্ষিতে বিভিন্ন রাষ্ট্রের রাজনৈতিক ব্যবস্থাসমূহের মধ্যে বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যগত ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়।
৯. পারস্পরিক মিথষ্ক্রিয়া (Interaction) : রাজনৈতিক ব্যবস্থা হল কতকগুলো মিথস্ক্রিয়ার সমষ্টি। সামগ্রিক সামাজিক আচরণ থেকে এসব মিথষ্ক্রিয়া আসে। এদের মাধ্যমে সমাজের মূল্যসমূহ বরাদ্দকৃত হয়।
ইস্টন বলেছেন, "A political system is a set of interactions abstracted from the totality of social behaviour through which values are allocated for a society."
১০. আত্মনিয়ন্ত্রিত (Self-regulating) : ডেভিড ইস্টন রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে আত্মনিয়ন্ত্রিত এবং প্রতিবেদনশীল ব্যবস্থা হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন।
বস্তু ও মূল্যের বরাদ্দ প্রসঙ্গে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করাই হল রাজনৈতিক ব্যবস্থার উদ্দেশ্য এবং সিদ্ধান্ত হল বাধ্যতামূলক ও কর্তৃত্বসম্পন্ন। কারণ বলপ্রয়োগের বৈধ ক্ষমতা এ সিদ্ধান্তের সাথে সম্পর্কযুক্ত।
১১. রাজনৈতিক বরাদ্দকরণ (Political allocation) : রাজনৈতিক ক্ষমতা, রাজনৈতিক সংস্কৃতি, রাষ্ট্রের প্রকৃতি, রাজনৈতিক সচলতা প্রভৃতি নির্ধারিত ও নিয়ন্ত্রিত হওয়ার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক ব্যবস্থার গুরুত্ব বিরোধ বিতর্কের ঊর্ধ্বে। সেজন্য বলা হয়, রাজনৈতিক ব্যবস্থার মুখ্য বৈশিষ্ট্য হল রাজনৈতিক বরাদ্দকরণ।
১২. রাজনৈতিক সীমানা (Political area) : সকল রাজনৈতিক ব্যবস্থার ক্ষেত্রেই সীমানার ধারণা সম্পর্কযুক্ত। কিন্তু রাজনৈতিক ব্যবস্থার ক্ষেত্রে এ সীমানার বিষয়টি সমস্যাবহুল।
কারণ রাজনৈতিক ব্যবস্থার সীমানা নির্ধারণ অত্যন্ত কঠিন। তার কারণ হল রাজনৈতিক ব্যবস্থায় ব্যক্তিবর্গ অরাজনৈতিক ভূমিকা পালন থেকে রাজনৈতিক ভূমিকা পালনের শামিল হতে পারে।
উপসংহার : উপরিউক্ত আলোচনা শেষে বলা যায় যে, পৃথিবীর কোন রাষ্ট্রের রাজনৈতিক ব্যবস্থা স্থিতিশীল নয়। এটা নিয়ত পরিবর্তনশীল।
সংকটকালীন পরিস্থিতিতে তা অধিকতর সম্প্রসারিত হয়। তাছাড়া পরস্পর নির্ভরশীল বিভিন্ন অংশের একত্রে অবস্থানের ভিত্তিতে এক একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে উঠে।
প্রত্যেক ব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত বিভিন্ন অংশগুলো পরস্পরের উপর নির্ভরশীল। একটি অংশ পরিবর্তিত হলে অন্য অংশের উপর প্রভাব পড়ে।
এজন্য G. A. Almond বলেন, "(A system) implies the independence of parts and boundary of some kind between it and its environment."