রাজনৈতিক আধুনিকীকরণের সমস্যাগুলো আলোচনা কর
রাজনৈতিক আধুনিকীকরণের সমস্যাগুলো আলোচনা কর |
রাজনৈতিক আধুনিকীকরণের সমস্যাগুলো আলোচনা কর
- অথবা, আধুনিকীকরণের সংকটগুলো সংক্ষেপে আলোচনা কর।
- অথবা, রাজনৈতিক আধুনিকীকরণের প্রতিবন্ধকতাসমূহ আলোচনা কর।
উত্তর : ভূমিকা : Political modernization বা রাজনৈতিক আধুনিকায়ন সাম্প্রতিক বিশ্ব রাজনীতিতে একটি বহুল আলোচিত বিষয়।
আধুনিককালের গোড়ার দিকে মূলত ইউরোপের দেশগুলোতে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বেশকিছু পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়।
সাম্প্রতিককালে পৃথিবীর অধিকাংশ দেশ আধুনিকীকরণের পথে ধাবিত হচ্ছে। S. P. Huntington তাঁর 'Political Order in Changing Society' শীর্ষক গ্রন্থে বলেছেন, "One can not modernization without making their society politically stable party is the basis of this stability."
রাজনৈতিক আধুনিকীকরণের সংকটসমূহ (Problems of political modernization) : Political modernization বা রাজনৈতিক আধুনিকীকরণ সাম্প্রতিক বিশ্বের একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে সর্বজনস্বীকৃত। রাজনৈতিক আধুনিকীকরণ ব্যতীত কোন রাষ্ট্রের সার্বিক উন্নয়ন সম্ভব নয়।
বর্তমান আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সার্বিক উন্নয়নের জন্য রাজনৈতিক আধুনিকীকরণ একটা অন্যতম রাজনৈতিক ইস্যুতে পরিণত হয়েছে।
তবে রাজনৈতিক আধুনিকীকরণের ক্ষেত্রে অনেক প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। নিম্নে রাজনৈতিক আধুনিকীকরণের সংকটসমূহ আলোচনা করা হল
সাধারণ সমস্যা : Prof. Lucian W. Pye রাজনৈতিক আধুনিকায়নের ক্ষেত্রে যে সমস্ত সাধারণ সমস্যার কথা উল্লেখ করেছেন তা নিম্নরূপ :
১. রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা (Political instability) : রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা রাজনৈতিক আধুনিকায়নের ক্ষেত্রে একটা বড় অন্তরায়। রাজনৈতিক আধুনিকীকরণ নির্ভর করে দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর সার্বিক গঠনমূলক রাজনৈতিক কর্মসূচি ও নেতৃত্বের উপর। তবে দেশে যদি রাজনৈতিক অস্থিরতা বিরাজ করে তবে রাজনৈতিক আধুনিকীকরণ সম্ভব নয় ।
২. শান্তিশৃঙ্খলার অভাব ( Lack of peace ) : দেশে যদি শান্তিশৃঙ্খলা বিরাজ না করে তবে রাজনৈতিক আধুনিকীকরণের পথ সুগম হয় না। উন্নয়নশীল দেশগুলোর রাজনীতি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, হত্যা, নির্যাতন, সন্ত্রাস, রাহাজানি, সংখ্যালঘু নির্যাতন, রাজনৈতিক দলগুলোর সমঝোতার অভাব প্রভৃতি শান্তিশৃঙ্খলার পরিপন্থি যা রাজনৈতিক আধুনিকায়নের পথে বাধা প্রদান করে।
৩. দক্ষ নেতৃত্বের অভাব (Lack of efficient leadership) Charismatic leadership : ছাড়া রাষ্ট্রের রাজনৈতিক আধুনিকায়ন সম্ভব নয়। বিশেষ করে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে দক্ষ রাজনৈতিক নেতৃত্ব ছাড়া রাজনৈতিক কার্যক্রম সঠিকভাবে চালানো সম্ভব হয় না।
৪. রাজনৈতিক যোগাযোগ : রাজনৈতিক যোগাযোগ উন্নত রাজনৈতিক সংস্কৃতির ক্ষেত্রে একটা বড় ইস্যু হিসেবে কাজ করে। রাজনৈতিক যোগাযোগ ছাড়া গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রম সঠিকভাবে চালানো সম্ভব হয় না।
বর্তমান আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোতে রাজনৈতিক যোগাযোগ প্রায় অনুপস্থিত যে কারণে রাজনৈতিক উন্নয়নের পথ সুগম হয় না।
৫. অনুন্নত অর্থনীতি (Undeveloped economic system) : অর্থনীতি ও রাজনীতি পরস্পর ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কযুক্ত। এ প্রসঙ্গে George Harrington বলেছেন, অর্থনৈতিক ক্ষমতা যাদের হাতে থাকে রাজনৈতিক ক্ষমতাও তাদের হাতে থাকে।
কারণ অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী হলে রাজনৈতিক ক্ষমতার চর্চা করা সম্ভব হয়। এজন্য অর্থনৈতিক ভিত্তি মজবুত হওয়া প্রয়োজন।
উন্নয়নশীল রাষ্ট্রগুলোতে অর্থনৈতিক ভিত্তি মজবুত না, বিধায় আধুনিকায়নের পিছনে অনেক প্রতিবন্ধকতা কাজ করে।
৬. সামরিক অনুপ্রবেশ (Military entrance) : সামরিক বাহিনী অগণতান্ত্রিক উপায়ে রাজনৈতিক ক্ষমতা কুক্ষীগত করে। যে কারণে তারা সবসময় তাদের স্বার্থ হাসিল করার জন্য ব্যস্ত থাকে।
বিশেষ করে যারা সামরিক বাহিনীর কেন্দ্রীয় ভূমিকায় থাকে, তাদের মধ্যে দেশাত্মবোধ থাকে না বললেই চলে। তারা মূলত স্বৈরাচারী হিসেবে সকলের কাছে পরিচিত হয়ে উঠে।
৭. গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের অভাব (Lack of democratic values) : Democratic values বা পণতান্ত্রিক মূল্যবোধ রাজনৈতিক আধুনিকায়নের ক্ষেত্রে একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে কাজ করে।
গণতন্ত্রের গুরুত্ব প্রসঙ্গে রুশ দার্শনিক ভলতেয়ার বলেছেন, “তোমাদের মতের সাথে আমার মতের মিল থাকুক বা নাই থাকুক তা রক্ষা করার জন্য প্রয়োজনে আমি আমার জীবন দিয়ে দেব।”
বর্তমান উন্নয়নশীল রাষ্ট্রগুলোতে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের ব্যাপক ঘাটতি দেখা যায়, যে কারণে তারা রাজনৈতিক আধুনিকায়নের ক্ষেত্রে অনেকটা পিছিয়ে পড়েছে।
৮. রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার অভাব (Lack of political experience) : উন্নয়নশীল রাষ্ট্রগুলোতে রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার অভাব ব্যাপকভাবে প্রতিফলিত হয়।
বিশেষ করে যেসব রাষ্ট্রগুলো অনুন্নত সে সমস্ত রাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় বা নিবাহি পর্যায়ে অনভিজ্ঞ কর্মচারী থাকে। বিধায় তারা রাষ্ট্রের উন্নয়ন ক্ষেত্রে গঠনমূলক ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হয় ।
৯. আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ঘাটতি (Lack of International relation) : রাজনৈতিক আধুনিকীকরণের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে এক রাষ্ট্রের সাথে অন্য রাষ্ট্রের যোগাযোগ রক্ষা বজায় রাখা অত্যন্ত জরুরি বিষয়।
তবে সকল ক্ষেত্রে যোগাযোগ রক্ষা করা সম্ভব হয় না। সে কারণে রাজনৈতিক আধুনিকীকরণের পথ সুগম হয় না।
১০. নিম্নমানের রাজনৈতিক সংস্কৃতি (Lower political culture) : রাজনৈতিক আধুনিকীকরণের ক্ষেত্রে উন্নত রাজনৈতিক সংস্কৃতি একটা গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে কাজ করে।
তবে আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় গণতন্ত্রের উন্নয়নের সুষ্ঠু পরিবেশ তেমন নেই বললেই চলে। যে কারণে রাজনৈতিক আধুনিকীকরণের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হচ্ছে।
১১. রাজনৈতিক সচেতনতার অভাব (Lack of political consciousness) : রাজনৈতিক সচেতনতা ছাড়া রাজনৈতিক আধুনিকীকরণের পথ সুগম হয় না। রাজনৈতিকভাবে সচেতন জনগণই উন্নত ও আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার সাথে সম্পৃক্ত হতে পারে।
রাজনৈতিক সচেতনতাই রাজনৈতিক আধুনিকীকরণের প্রাথমিক পর্যায়। সে কারণে যে রাষ্ট্র রাজনৈতিকভাবে সচেতন নয়, সে রাষ্ট্র রাজনৈতিক আধুনিকীকরণের ক্ষেত্রে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়।
উপসংহার : উপরিউক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, রাজনৈতিক আধুনিকীকরণের ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধা তথা গণতান্ত্রিক মানসিকতা না থাকলে রাজনৈতিক আধুনিকীকরণ সম্ভব হয় না।
তাছাড়া রাজনৈতিক আধুনিকীকরণ ছাড়া রাষ্ট্রের সার্বিক উন্নয়ন কার্যক্রম চালানো সম্ভব হয় না। সেক্ষেত্রে আধুনিকীকরণের উপরিউক্ত সমস্যা চিহ্নিত করে সেগুলোকে লোপ করা জরুরি। তবেই রাষ্ট্রের সার্বিক রাজনৈতিক আধুনিকীকরণ ও রাজনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব হবে।