প্যারেটোর রেসিডিউ সম্পর্কিত মতবাদ ব্যাখ্যা কর
প্যারেটোর রেসিডিউ সম্পর্কিত মতবাদ ব্যাখ্যা কর |
প্যারেটোর রেসিডিউ সম্পর্কিত মতবাদ ব্যাখ্যা কর
- অথবা, রেসিডিউ কী? এ সম্পর্কে প্যারেটোর ধারণা ব্যাখ্যা কর।
উত্তরঃ ভূমিকা : এলিট সম্পর্কে ভিলফ্রেডো প্যারেটো যে বিভিন্ন মতবাদ বিশ্লেষণ করেছেন তার মধ্যে তাঁর রেসিডিউ সম্পর্কিত ধারণা অন্যতম।
তিনি তাঁর The Rise and Fall of Elites' শীর্ষক গ্রন্থে তাঁর রেসিডিউ সম্পর্কিত ধারণার অবতারণা করেছেন।
প্যারেটো রেসিডিউ সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা না দিলেও তিনি কিছু প্রস্তাব (Proposal) বা উপাদানের কথা উল্লেখ করেছেন।
প্যারেটো রেসিডিউ বলতে যা বুঝিয়েছেন তা হচ্ছে রেসিডিউ আসলে ভাবাবেগ নয়। এটা হল ভাবাবেগের অভিব্যক্তি বা প্রকাশ মাত্র।
এ প্রসঙ্গে জেটলিন বলেছেন, "The residues are the manifestations of sentiments and instincts just as the rising of the mercury in thermometer is a manifestation of the rise in temparature."
প্যারেটোর রেসিডিউ সম্পর্কিত ধারণা : প্যারেটোর রেসিডিউ হচ্ছে ব্যক্তির সহজাত প্রবৃত্তি বা প্রবণতা। তাঁর মতে, যেসব প্রপঞ্চ বা ঘটনা আমরা প্রত্যক্ষ করে থাকি সেগুলো দু'টি মৌল উপাদানে বিভক্ত।
একটি অপরিবর্তনীয় উপাদান এবং অপরটি পরিবর্তনীয় উপাদান হিসেবে গণ্য করা হয়। মূলত অপরিবর্তনীয় উপাদানের সাথে রেসিডিউ সম্পর্কিত। তবে রেসিডিউ সুষ্ঠু ধারণা লাভ করতে হলে কিছু বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে ধারণা থাকা দরকার।
নিম্নে এ বৈশিষ্ট্যগুলো তুলে ধরা হল :
১. রেসিডিউ মানুষের ভাবাবেগের বহিঃপ্রকাশ।
২. রেসিডিউ মানুষের প্রবৃত্তির সাথে সম্পর্কিত কিন্তু সকল সহজাত প্রবৃত্তির সাথে এর সম্পর্ক নেই।
৩. রেসিডিউ মানুষের প্রকাশ (Expression) ও কাজ এর খুব কাছাকাছি অবস্থান করে ।
৪. রেসিডিউ পর্যবেক্ষক কর্তৃক সৃষ্ট কতকগুলো বিমূর্ত বিশ্লেষণধর্মী প্রত্যয়, যার সাহায্যে যে কোন ব্যাখ্যা করে থাকে।
৫. রেসিডিউ মানুষের বিশেষ মানসিক অবস্থার প্রকাশ হলেও মানুষের আচরণ অধ্যয়নের ক্ষেত্রে এগুলো মনোবিজ্ঞানীদের জন্য সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচ্য
প্যারেটোর রেসিডিউয়ের শ্রেণিবিভাগ : ডিলফ্রেডো প্যারেটো (Vilfredo Pareto) তাঁর রেসিডিউ এর কতকগুলো শ্রেণিবিভাগ করেছেন। নিম্নে এগুলো আলোচিত হল :
১. সন্দিলনের প্রবণতা (Comination or a tendency to invent and embark on advantures) : মূলত চিন্তাশক্তি, উদ্ভাবন ক্ষমতা, কল্পনাশক্তি, মৌলিকত্ব এসব গুণাগুণ প্রথম শ্রেণির রেসিডিউরের পরিচয় বহন করে। সাধারণভাবে এটাকে Instinct for combination or innovation হিসেবে উল্লেখ করা হয়।
এর অর্থ হচ্ছে মানুষের এ সমস্ত মানসিক ধারণা বা বিমূর্ত ধারণার সাথে সাথে মূর্তমান বস্তু বা ঘটনার মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন করে এবং এটা ব্যক্তির আচরণকে বিভিন্ন নীতিমালার সাহায্যে চূড়ান্তভাবে বিশ্লেষণ করে।
প্যারেটোর মতে, প্রথম শ্রেণির রেসিডিউয়ের উপস্থিতিই একজন মানুষকে পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে বিকশিত করে তোলে। এর ফলে মানুষের যাবতীয় কর্মকাণ্ড, বিভিন্ন তত্ত্ব, মতবাদ, ন্যায়নীতি ইত্যাদি সৃষ্টি হয়েছে।
প্যারেটোর অভিমত অনুসারে পঞ্চম শতকের এথেন্স ও বিংশ শতকের প্রথম দিকের ফ্রান্স এ রেসিডিউ এর মাধ্যমে শক্তিশালী হয়েছিল। অন্যদিকে বলা যায়, স্পার্টা ও অষ্টাদশ শতকের প্রুশিয়াতে এর উপস্থিতি অনেক কম ছিল।
২. গতানুগতিক প্রবণতা (Persistence or preservation) : এ শ্রেণির রেসিডিউ প্রথম শ্রেণি থেকে সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী হিসেবে মনে করা হয়। প্যারেটো বলেছে, “এটা হচ্ছে জড়তার প্রতীক।
এটা মানুষের সে প্রবণতার সাথে সম্পর্কিত যার মাধ্যমে সে রক্ষণশীলতাকে আশ্রয় করে পুরাতনকে আঁকড়ে ধরে রাখতে চায় এবং পরিবর্তন পরিপন্থি হয়ে হরিব জীবনযাপনের আওতাভুক্ত থাকতে চায়।
প্যারেটোর প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির রেসিডিউ মানুষের দু'টি বিপরীতধর্মী প্রবণতার প্রতিভূ এবং সমাজজীবনে এদের তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা সহজেই অনুধাবন করা যায়। গতানুগতিক প্রবণতাকে Persistence of aggregate হিসেবে অভিহিত করা হয়।
৩. অনুভূতি প্রকাশের প্রবণতা (Expressiveness) : এ শ্রেণির রেসিডিউ সম্পর্কে প্যারেটোর অভিমত যে, “মানুষের আচরণ বা কাজ শুধুমাত্র ভাবাবেগকে সুস্পষ্টভাবে প্রকাশ করে না উপরন্তু এটা ভাবাবেগকে জাগরিতও করে থাকে।
ব্যক্তির মধ্যে কোনকিছুর চাহিদা থাকে আর সেজন্য সে কাজ করে।" প্যারেটোর মতে, “ব্যক্তির এ কাজ তাহলে তার চাহিদার বা প্রয়োজনের কারণ হিসেবে গণ্য হতে পারে।”
৪. সামাজিক প্রবণতা (Sociability) : প্যারেটোর ধারণা অনুসারে এ শ্রেণির মানুষ সমাজবদ্ধ জীবনের সাথে সম্পৃক্ত। অর্থাৎ এ শ্রেণির রেসিডিউয়ের উপস্থিতির কারণে মানুষ সামাজিক জীব হিসেবে গণ্য হয়।
এছাড়া বৃহত্তর সমাজের পরিধিতে মানুষ বিভিন্ন সময় যেসব সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় ইত্যাদি ধরনের সংঘের সদস্য হয় সেটা মূলত এ রেসিডিউ এর কারণে।
৫. সংহতির প্রবণতা (Integrity) : মানুষের ভাবাবেগ সমাজে Bquilibrium এর মধ্যে পরিবর্তন আনতে পারে এমন বিষয়গুলোকে প্রতিনিয়ত বিরোধিতা করে। প্যারেটো এ ভাবাবেগগুলোকে তাঁর রেসিডিউয়ের পঞ্চম শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত করেছেন।
এ ধরনের রেসিডিউই শুধুমাত্র পরিবর্তনের বিরোধিতা করে না, বরং সমাজে স্থিতিশীলতার পরিপন্থি হিসেবে কাজ করেছে এমনসব ব্যক্তিকে শাস্তি প্রদান করার ক্ষেত্রে ইন্ধন যুগিয়ে থাকে। এটা প্যারেটো বর্ণিত দ্বিতীয় শ্রেণির রেসিডিউয়ের পরিপূরক হিসেবে বিবেচিত হয়।
৬. যৌন প্রবণতা (Sex) : মানুষের যৌনতার প্রবণতা প্যারেটোর যাবতীয় তত্ত্ব এবং মানুষের চিন্তার ধরনকে প্রবাহিত করতে সক্ষম। তিনি যৌনতাকে সবসময় শক্তিশালী রেসিডিউ হিসেবে গণ্য করেছেন।
যার মূলে রয়েছে মানুষের জৈব, রাসায়নিক, শারীরিক প্রক্রিয়ার বহিঃপ্রকাশ। মানুষের যৌন রেসিডিউ এমনসব ক্রিয়ার উদ্ভাবনের কাজ করে যেগুলো স্থায়ী এবং সেগুলো সর্বকালের মানুষের জন্য প্রযোজ্য।
মৌল মতবাদ : প্যারেটো আবার কিছু মৌল মতবাদে অবতারণা করেছেন। প্রত্যেক ব্যক্তি তাঁর ব্যবহারের সঠিক প্রকৃতি প্রসঙ্গে কখনও ভান করে, কখনও বিশ্লেষণ, আবার কখনও পরিবর্তন করে।
যে উপায়ে বা পথের মাধ্যমে এ সমস্ত ক্রিয়া সম্পূর্ণ করে প্যারেটোর মতে সেটা হল মৌল মতবাদ (Derivati)। প্যারেটো চারটি শ্রেণিতে মৌল মতবাদগুলো বিশ্লেষণ করেছেন। যথা :
১. সমর্থনমূলক (Assertion),
২. কর্তৃত্বমূলক (Appeals to authority).
৩. অনুভূতি (Appeals to sentiments),
৪. মৌখিক প্রবণতা (Verbal proof)।
উপসংহার : উপরিউক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, প্যারেটোর রেসিডিউ বা যুক্তিহীন ক্রিয়া অনেক ক্ষেত্রে সমালোচনার সম্মুখীন হয়।
প্যারেটো দেখিয়েছেন যে, মানুষে অধিকাংশ সময়ই যুক্তিহীন ক্রিয়া বা কার্যসম্পন্ন করে থাকে। পরবর্তীতে মানুষ সেটাকে নানারকম যুক্তিতর্ক, বিশ্লেষণের মাধ্যমে যৌক্তিক হিসেবে প্রমাণ করার চেষ্টা করে।
যেটাকে প্যারেটো ডিরাইভেশন হিসেবে মনে করেন। মূলত তাঁর এ তত্ত্বে ডিরাইভেশন বা পরিবর্তনীয় উপাদান বর্তমান সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে সমর্থ হয়। এখানেই তাঁর তত্ত্বের সার্থকতা।