নবাব আলীবর্দী খানের সাথে মারাঠা ও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সম্পর্ক নির্ণয় কর
নবাব আলীবর্দী খানের সাথে মারাঠা ও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সম্পর্ক নির্ণয় কর |
নবাব আলীবর্দী খানের সাথে মারাঠা ও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সম্পর্ক নির্ণয় কর
- অথবা, নবাব আলীবর্দী খানের সাথে মারাঠা ও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সম্পর্ক নিরূপণ কর।
উত্তর : ভূমিকা : নবাব আলীবর্দী খানের শাসনামলের সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো মারাঠা ও ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির সাথে তার সম্পর্ক।
দুর্ধর্ষ মারাঠা হানাদারদের পুনঃপুনঃ আক্রমণের বিরুদ্ধে বাংলা ও বাংলার জনগণকে রক্ষা এবং সুচতুর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বাংলার শান্তি ও সমৃদ্ধির ক্ষেত্রে নবাব আলীবর্দী খান এক মহান ঐতিহ্য ও দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছেন।
নিম্নে এদের সম্পর্ক নির্ণয় করা হলো :
→ নবাব আলীবর্দী ও মারাঠা সম্পর্ক : ১৭৪০ খ্রিষ্টাব্দের মে মাসে বাংলার মসনদে আরোহণ করার অব্যবহিত পর থেকে ৬০ বছরের বৃদ্ধ আলীবর্দী খানের শাসনামলের বেশিরভাগ সময়ই কেটেছে মারাঠাদের আক্রমণ প্রতিরোধের কাজে ব্যাপৃত থাকে।
বলা যায়, আলীবর্দী খানের সাথে মারাঠাদের সম্পর্ক ছিল যুদ্ধ ক্ষেত্র ও সংঘর্ষের এক দীর্ঘ অধ্যায়। আলীবনী খান ও মারাঠাদের মধ্যকার সম্পর্ক তথা ১৭৪২-১৭৫১ খ্রিঃ পর্যন্ত দশ বছরকালের সংঘর্ষকে নিলিখিত কয়েকটি পর্যায়ে বিভক্ত করে আলোচনা করা হলো।
১. প্রথম পর্যায় : সম্রাট আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর কয়েক বছরের মধ্যে মারাঠা শক্তি পুনঃসঞ্চয় করে দাক্ষিণাত্যে তাদের রাজ্য স্থাপন করে।
১৭৪২ খ্রিষ্টাব্দে নাগপুরের মারাঠা নায়ক ও মারাঠাদের অন্যতম খ্যাতনামা সেনাপতি রঘুজী ভোঁসলা তাঁর প্রধানমন্ত্রী ভাস্কর পণ্ডিতকে ৪০,০০০ অশ্বারোহী সৈন্যসহ বাংলা আক্রমণ করতে প্রেরণ করে।
ভাস্কর পণ্ডিত বিরাট বর্গি বাহিনী নিয়ে বাংলায় প্রবেশ করে বাংলার বর্ধমান ও মুর্শিদাবাদ অঞ্চলে লুটতরাজ শুরু করলে আলীবণী খান স্বল্প সংখ্যক সৈন্য নিয়েই হুগলি জেলার মুবারক মঞ্জিল হতে বিরাট হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে অগ্রসর হন।
কিন্তু ভাস্কর পণ্ডিত আলীবর্দীর মতো সেনাপতির সাথে সম্মুখ যুদ্ধের প্রবৃত্ত না হয়ে মারাঠাদের অত্যন্ত অনিয়মিত যুদ্ধ পদ্ধতি অনুসরণ করেন।
কিন্তু তাতেও কোন সুবিধা করতে না পেরে তিনি নবাবের নিকট দশ লক্ষ টাকার বিনিময়ে স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের প্রস্তাব নিলে নবাব তাতে অসম্মতি প্রকাশ করেন।
এ সময় আলীবর্দী খান অকস্মাৎ মারাঠাদের একটি বড় সৈন্যদল কর্তৃক বেষ্টিত হয়ে পড়লে ভাস্কর পণ্ডিত সুযোগ বুঝে এক কোটি টাকা দাবি করে সন্ধির প্রস্তাব দেন।
কিন্তু এই বিপদশঙ্কুল পরিস্থিতিতে নবাব সুকৌশলে যুদ্ধ করতে করতে বেষ্টনীচ্ছেদ করে কাটোয়া পৌঁছলে ভাস্কর পণ্ডিত নিরাশ হয়ে বাংলা ত্যাগের প্রস্তুতি গ্রহণ করেন।
২. দ্বিতীয় পর্যায় : মারাঠা সেনাপত্তি বাংলা ত্যাগের অভিপ্রায় ব্যক্ত করলেও তিনি হঠাৎ মুর্শিদাবাদ আক্রমণ করে লুটতরাজ ও ধ্বংসকার্য সাধন করে। অতঃপর ১৭৪২ খ্রিষ্টাব্দের জুন মাসে হুগলি শহর লুন্ঠন ও দখল করেন।
কিন্তু আলীবর্দী মুর্শিদাবাদ হতে অভিযান পরিচালনা করে কাটোয়ায় মারাঠা শিবির আক্রমণ করলে মারাঠা বাহিনী কাটোয়া ত্যাগ করে উড়িষ্যার কটক দখল করেন।
আলীবনী এ সময় উড়িষ্যা অভিমুখে যুদ্ধাভিযান পরিচালনা করতে মারাঠা সেনাপতি ভাস্কর পণ্ডিত উড়িষ্যা ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। ফলে উড়িষ্যা মারাঠা সৈন্য মুক্ত হয়।
৩. তৃতীয় পর্যায় : ১৭৪৩ খ্রিষ্টাব্দে মারাঠা বর্গিরা দুই দলে বিভক্ত হয়ে বাংলায় প্রবেশ করে পুনরায় লুটতরাজ শুরু করলে আলীবর্দী খান পেশোয়া বালজিরাওয়ের সাথে সন্ধি স্থাপন করে সম্মিলিতভাবে মারাঠাদের প্রতিরোধ করার চেষ্টা করে।
ফলে মারাঠা নেতা রঘুজী ভোলা ভীত হয়ে সদলবলে পলায়ন করলেও বালাজিরাও -এর নিকট পরাজিত ও বিপর্যস্ত হয়।
৪, ৪র্থ পর্যায় : ১৭৪৪ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ মাসে মারাঠা নেতা রঘুঞ্জী ভোসলা পেশোয়ারের সাথে গোপন আঁতাত করে পুনরায় বাংলার বিভিন্ন স্থানে লুটতরাজ ও গুপ্ত হামলা চালাতে থাকে। এমতাবস্থায় আলীবর্দী খান কূটকৌশলে তাদের সাথে সন্ধি ও বন্ধুত্বের হাত বাড়ান।
তাঁর এই বন্ধুত্বে আকৃষ্ট হয়ে মারাঠা সেনাপতি তাস্কর পণ্ডিত ও তাঁর ২২ জন সমর নায়ক সন্ধিচুক্তি সম্পাদনের জন্য আলীবর্দী খানের শিবিরে আসলে নবাবের সৈন্যরা তাদেরকে হত্যা করে। এ সংবাদে বর্গি হানাদাররা ভীত হয়ে স্বদেশে পলায়ন করে।
৫. ৫ম পর্যায় : ১৭১৫ খ্রিষ্টাব্দে আলীবর্দী ও আফগানদের মধ্যকার বিরোধের সুযোগে মারাঠা নেতা রমুজী ভোসলা ২৪ হাজার মারাঠা সৈন্য নিয়ে উড়িষ্যা আক্রমণ করে মেদেনীপুর বর্ধমান, বীরভূমে লুটতরাজ করে বিহারের দিকে অগ্রসর হয়।
কিন্তু আলীবর্দী খান তাদেরকে বিহারের সন্নিকটে পরাজিত করে এবং ১৭৪৬ খ্রিস্টাব্দে তাদেরকে বাংলা হতে বিতাড়িত করেন।
এরপর আলীবর্দী খান মারাঠাদেরকে ১৭৪৭ খ্রিস্টাব্দে বর্ধমানের নিকট ১৭৪৮ খ্রিষ্টাব্দে ভাগলপুরের নিকট পরাজিত করে উড়িষ্যা হতে তাদেরকে বিতাড়িত করার প্রস্তুতি গ্রহণ করেন।
অতঃপর তিনি ১৭৪৯ খ্রিস্টাব্দে মারাঠাদের নিকট থেকে উড়িষ্যার রাজধানী কটক ও অন্যান্য অঞ্চল অধিকার করেন। শারীরিক দুর্বলতা সত্ত্বেও বৃদ্ধ অভিযান পরিচালনা করে
৬. শেষ পর্যায় ও সন্ধি চুক্তি : নবাব একের পর এক সফল মারাঠাদেরকে মেনেনীপুর, বর্ধমান ও বীরভূম হতে বিতাড়িত করে অবশেষে ১৭৫১ খ্রিস্টাব্দে তিনি কিছু দিন কাটোয়ায় অবস্থান করেন। এ সময় মারাঠা নেতা বহুজী ভোসলা নবাবের সাথে শান্তি স্থাপন করার জন্য উদগ্রীব হয়ে পড়ে।
অন্যদিকে বৃদ্ধ নবাব নিজের বার্ধক্য ও শারীরিক দুর্বলতা, সৈন্যদের ক্লান্তি এবং বিশেষত মারাঠা দস্যুদের কবল হতে বাংলার জনসাধারণের জানমালের নিরাপত্তা বিধানের জন্য তিনি মারাঠাদের সন্ধি প্রস্তাবে সম্মত হন এবং ১৭৫১ খ্রিষ্টাব্দের মে মাসে উভয়ের মধ্যে সঙ্গি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
→ সন্ধি চুক্তির শর্তসমূহ : সন্ধি চুক্তির মাধ্যমে আলীবর্দী ও মারাঠাদের মধ্যকার দীর্ঘ দশ বছরব্যাপী সংঘর্ষের অবসান ঘটে। এবং উভয়ের মধ্যে স্বাভাবিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়। চুক্তির শর্তসমূহ ছিল নিম্নরূপ-
১. সন্ধির শর্ত অনুযায়ী মারাঠাদের সহায়তাকারী মীর হাবিব আলীবর্দীর মায়েররূপে উড়িষ্যার শাসনকর্তা নিযুক্ত হয় এবং উড়িষ্যার উদ্বৃত্ত্ব রাজস্ব হতে রঘুলী ভোসলার সৈন্যদের বেতন প্রদানের কথা বলা হয়।
২. বাংলার নবাব ৰঘুজীকে বার্ষিক বার লক্ষ টাকা দিবে। রমুজী নবাবের রাজ্য আক্রমণ করা থেকে বিরত থাকবে।
৩. জালেশ্বরের নিকট সুবর্ণরেখা নদী দ্বারা বাংলা ও উড়িষ্যার সীমান্ত নির্দিষ্ট হয়। এ চুক্তির পর মারাঠারা আর আক্রমণ করেননি বাংলায়।
আলীবর্দী ও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি : নবাব আলীবর্দীর | সাথে ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির সম্পর্ক টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হলেও কখনোও সংঘাতময় পরিস্থিতিতে পর্যবসিত হয়নি।
নবাব আলীবর্দীর শাসনামলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বণিকদের বাণিজ্যের যথেষ্ট শ্রী বৃদ্ধি হয়। পূর্বে ৪/৫টি জাহাজের মাধ্যমে বাণিজ্য পরিচালনা করলেও ১৭৪৪ খ্রিস্টাব্দে তারা বাংলায় বাণিজ্যে ৪০ হতে ৫০টি জাহাজ ব্যবহার করে।
এভাবে বাণিজ্যের উন্নতি ঘটলেও তারা মারাঠা যুদ্ধের ব্যয় নির্বাহের জন্য নবাবকে অর্থ সাহায্য দিতে গড়িমসি করে। কিন্তু জগৎশেঠের মধ্যস্থতায় তারা ৪ লক্ষ টাকা অর্থ সাহায্য করে।
১৭৪৮ খ্রিষ্টাব্দে ইংরেজ বণিকরা বাংলার আর্মেনিয়ান ও মুঘল বণিকদের কয়েকটি জাহাজ আটক করলে তারা নবাবের শরণাপন্ন হয়।
আটককৃত জাহাজ ছেড়ে দেবার জন্য নবাব কলকাতার গভর্নর বারওয়েলের নিকট পরওয়ানা পাঠালে ও তারা নবাবের অনুমতি প্রত্যাখ্যান করে।
অতঃপর নবাব ইংরেজদের বাণিজ্য সুবিধা বন্ধ করে তারা আটককৃত জাহাজগুলো ছেড়ে দেয় এবং এক লক্ষ ৫০ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ দিতেও বাধ্য হয়। ফলে নবাব পুনরায় কোম্পানির বণিকদের বাণিজ্য সুবিধা প্রদান করেন।
নবাব ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বণিকদের নিকট থেকে কেবল মারাঠা যুদ্ধের ব্যয়ের জন্য অর্থ সাহায্য ছাড়া লো অতিরিক্ত কিছু আদায় করেননি এতে করে বণিকদের ব্যবসা-বাণিজ্যের যথেষ্ট অগ্রগতি সাধিত হয়।
১৭৪৫ খ্রিষ্টাব্দে নবাব এক আদেশ জারি করে কোম্পানির বণিকদের বাংলায় যুদ্ধবিগ্রহে লিপ্ত হতে এবং তাদের উপনিবেশ দুর্গ নির্মাণ করতে নিষেধ করেন। অধিকন্তু তিনি কোম্পানির নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের ও আশ্বাস দেন।
এভাবে নবাব আলীবর্দী খান যেমন একদিকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে বাণিজ্যিক সুবিধা প্রদান করেন। তেমন অন্যদিকে তাদের উপর নিজের কর্তৃত্বও প্রতিষ্ঠা করে বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছেন।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, নবাব আলীবর্দী দীর্ঘ ১০ বছরকাল মারাঠা বর্গিদের আক্রমণের হাত থেকে বাংলা ও বাংলার জনসাধারণকে রক্ষায় সর্বদা নিয়োজিত ছিলেন। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সাথে কৌশলে সম্পর্ক বজায় রাখেন।