নবাব আলীবর্দী খানের প্রশাসনিক কৃতিত্ব আলোচনা কর
নবাব আলীবর্দী খানের প্রশাসনিক কৃতিত্ব আলোচনা কর |
নবাব আলীবর্দী খানের প্রশাসনিক কৃতিত্ব আলোচনা কর
- অথবা, নবাব আলীবর্দী খানের শাসনকালের একটি বিবরণ দাও ।
- অথবা, নবাব আলীবর্দী খানের কৃতিত্ব মূল্যায়ন কর ।
- অথবা, নবাব আলীবর্দী খান কিভাবে বাংলায় মসনদ দখল করেন? তিনি কি কি সমস্যার মুখোমুখি হন? সমস্যা সমাধানে কতটুকু সফল হয়েছিলেন?
উত্তর : ভূমিকা : বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাসে নবাব আলীবর্দী খানের শাসনামল একটি উল্লেখযোগ্য অধ্যায় । আলীবর্দী খান একজন অসাধারণ প্রতিভা সম্পন্ন ব্যক্তি ছিলেন।
মুঘল সাম্রাজ্য যখন ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়েছিল এবং মারাঠাদের হানায় ভারতের সর্বত্র ত্রাসের সঞ্চার হয়েছিল তখন আলীবর্দীর সাহস ও সুযোগ্য সেনাপতিত্বের গুণে বাংলাদেশ মারাঠা হানাদারদের আক্রমণ হতে রক্ষা পেয়েছিল।
ইহা শান্তি ও সমৃদ্ধির পথে অগ্রসর হয়েছিল। নানা প্রতিকূলতার সাথে সংগ্রাম করে দীর্ঘ ষোল বছর তিনি স্বীয় নবাবি অক্ষুণ্ণ রেখেছিলেন।
→ আলীবনী খানের প্রশাসনিক কৃতিত্ব : নিয়ে নবাব আলীবর্ণী খানের প্রশাসনিক কৃতিত্ব আলোচনা করা হলো :
১. পরিচয় ও উপাধি লাভ : আলীবর্দী খানের প্রকৃত নাম ছিল মির্জা মুহাম্মদ আলী। তিনি ছিলেন জাতিতে তুর্কী এবং শিয়া মতাবলম্বী।
তার পিতামহ আওরঙ্গজেবের দুধভাই ছিলেন এবং পিতা মির্জা মুহাম্মদ আওরঙ্গজেবের তৃতীয় পুত্র মুহাম্মদ আজমের অধীনে সামান্য চাকুরি করতেন।
মির্জা মুহাম্মদের দু'পত্র আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর অভাব অনটনের মধ্যে পতিত হয়। তখন তারা উড়িষ্যার সহকারী সুবাদার ও আত্মীয় সুজাউদ্দিনের নিকট গমন করেন।
সুজাউদ্দিন এ পরিবারের দু'ভাইকে চাকুরি দেন। কালক্রমে তারা সুজাউদ্দিনের উপর প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়।
এমনকি সুজাউদ্দিনের শাসনকার্যের সফলতার পশ্চাতে এ প্রাকৃদ্বয়ের যথেষ্ট অবদান রয়েছে। ১৭৭২ সালে সুজাউদ্দিন বাংলার মসনদ অধিকার করার সময়ও তারা কৃতিত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেন।
তাদের কার্যে ও বিশ্বস্ততার সন্তুষ্ট হয়ে সুজাউদ্দিন হাজি আহমদকে তার অন্যতম উপদেষ্টা ও পরে . দিওয়ান নিযুক্ত করেন।
আর মীর্জা মুহাম্মদ আলীকে রাজমহলের ফৌজদার নিযুক্ত করে “আলীবর্দী খান” উপাধিতে ভূষিত করেন।
২. বিহারের নায়েব পদে নিযুক্তি : নবাব সুজাউদ্দিন যখন ১৭০৩ খ্রিষ্টাব্দে বিহারের সুবেদারি লাভ করেন তখন তিনি আলীবর্দী খানকে বিহারের নায়ের পদে নিয়োগ করেন।
এ সময় বিহারের প্রদেশে অশান্তি ও বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি বিরাজ করেছিল। অবাধ্য জমিদারগণ খাজনা দেয়া বন্ধ করেন, তাদের অনেকেই লুটতরাজ করতেন।
আলী খান কঠোরহস্তে অবাধ্য জমিদারদের দমন করে রাজস্ব প্রদানে বাধ্য করেন। হিন্দু পোত্রগুলো দমন করে দেশে শান্তি-শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনেন। ফলে রাষ্ট্রের রাজস্ব আয়ও বৃদ্ধি পায়।
সঙ্গে সঙ্গে আলীবর্দী খানের শক্তি ও প্রভাব বাড়তে থাকে। এতে তার ক্ষমতার মোহ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। তিনি বাংলার মসনদ দখল করার চিন্তা করতে থাকেন।
৩. বাংলার মসনদ অধিকার : নবাব সুজাউদ্দিনের মৃত্যুর পর তার পুত্র সরফরাজ খান ১৭৩৯ খ্রিঃ -এ বাংলার মসনদ লাভ করেন। শাসক হিসেবে তিনি দুর্বল হওয়ায় আলিবর্দী খান ও হাজি আহমদ মসনদ দখলের জন্য ষড়যন্ত্র শুরু করেন।
সরফরাজ খান ও সংবাদ জানতে পেরে মহা বিপদে পড়েন। যে সব আমীর এ ষড়যন্ত্রের সাথে জড়িত ছিলেন তারা নবাবকে আলীবর্দীর সঙ্গে একটা আপোষ মীমাংসায় আসার জন্য পরামর্শ দেন।
কিন্তু অন্যান্য আমীরগণ যুদ্ধ ঘোষণা মন্ত্রণা দেন। ফলে যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে পড়ে। মুর্শিদাবাদের ২৬ মাইল উত্তর-পশ্চিমে গিরিয়া নামক সালে ১৭৪০ সালের ১মে সরফরাজ খান আলীবর্দী খানের মধ্যে ঘোরতর যুদ্ধ শুরু হয়।
গিরিয়ার যুদ্ধে সরফরাজ পরাজিত ও নিহত হন। খুঁজের ২ দিন পর আলীবর্দী যান মুর্শিদাবাদে প্রবেশ করেন এবং বাংলার মসনদে বসেন। এ সময়ে তার বয়স ছিল ৬০ বছর।
৪. রাজাশাসন : আলীবর্দী যখন বাংলার মসনদে বসেন তখন তার বয়স ছিল ৬০ বছর। কিন্তু তার কর্মদক্ষতা ও নৈপুণ্য কোন অংশে কম ছিল না।
তিনি তার ভাতিজা ও জামাতা নওয়াজিশ মুহাম্মদ খানকে বাংলার সুরের দিওয়ান ও জাহাঙ্গীর নগরের নায়েব নাযিম নিয়োগ করেন।
নবাব তার কনিষ্ঠ ভ্রাতৃপুত্র ও জামাতা জৈনুদ্দিনকে বিহারের মায়ের নিয়োগ করেন। তার বৈমাত্রেয় ভগিনী শাহ খানমের স্বামী মীর মুহাম্মদ জাফর খান পুরাতন সৈন্য দলের বখশী পদে নিযুক্ত হন।
নুরুল্লাহ বেগ খানকে নতুন সৈন্যদলের বখশী পদে নিয়োগ করা হয়। নবাব তার দ্বিতীয় ভ্রাতৃঘর ও জামাত সৈয়দ আহম্মদ খানকে রংপুরের ফৌজদার এবং আতাউল্লাহ খানকে আকবর মহল ও ভাগলপুরের ফৌজদারি দায়িত্ব অর্পণ করেন।
কামান, বারুল নৌবহে দারোগা পদগুলোতে যোগ্য লোক নিয়োগ করা হয়। মসনদ অধিকারের কয়েক মাস পর আলীবর্দী খান সম্রাট মুহাম্মদ শাহের নিকট হতে সনদ লাভ করেন।
এ সনদের দ্বারা সম্রাট তাকে বাংলা বিহারের সুবেদার নিয়োগ করেন এবং তাকে ও পরিবারের লোকদেরকে উপাধি ও মনসব প্রদান করেন। এর ফলে বাংলার মানসের আলীবর্দীর অধিকার বৈধ বলে গণ্য হয়।
৫. উড়িষ্যা বিজয় : নবাব সুজাউদ্দিন যখন বাংলার সুবেদার তখন দ্বিতীয় মুর্শিদকুলি উড়িষ্যার নায়েব নাযিম ছিলেন। সরফরাজ খান প্রথম মুর্শিদকুলির জামাতা ছিলেন এবং আলীবর্দী গানের সঙ্গে সংঘর্ষে সরফরাজ খান নিহত হলে মুর্শিদকুলির জামাতা মির্জা লুতফুল্লাহ স্ত্রী দুর্দানা বেগম ও জামাতা মিয়া বাকর গানের প্ররোচনায় আলীবর্দীর বিরুদ্ধে যড়যন্ত্র করেন।
আলীবর্দী মুর্শিদকুলির নিকট থেকে বিপদের আশঙ্কা করে তার বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা কেরন। ১৭৪০ খ্রিষ্টাব্দে ৩ মার্চ বালেশ্বরের নিকট ফুলযায়ী নামক স্থানে সংঘর্ষ বাঁধে।
মুর্শিদকুলি পরাজিত হয়ে উড়িষ্যা ত্যাগ করেন। আলীবর্দী খান সহজেই উড়িষ্যা দখল করে ভ্রাতৃষ্পুত্র সৈয়দ আহমদ খানকে নায়েব নাযিম হিসেবে রেখে মুর্শিদাবাদে ফিরে আসেন।
৬. মারাঠা হাঙ্গামা : ১৭৪১ খ্রিষ্টাব্দে আলীবর্দী খান বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার একচ্ছত্র অধিপতি হন। স্বাধীন নবাব হিসেবে রাজ্য শাসন করতে থাকেন।
কিন্তু তিনি নিরবচ্ছিন্ন শান্তি নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলার স্থাপন করতে পারেননি। তার প্রধান করণ ছিল ১৭৪২ থেকে ১৭৫০ খ্রিষ্টাব্দে পর্যন্ত ১০ বৎসর ধরে তাকে দুর্ধর্ষ মারাঠা অক্ষর বর্গিদের উপর্যুপরি হামলা, হাঙ্গামা, লুটতরাজ, উৎপীড়ন, নির্যাতন ও ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপের সম্মুখীন হতে হয়।
ষাট বছরের বৃদ্ধ আলীবর্দী খান কঠোরভাবে এ বিপদের মোকাবিলা করেন। দুর্ধর্ষ বর্গিদের নিপীড়ন বন্ধের জন্য আলীবর্দী খান বলিষ্ঠ পদক্ষেপ গ্রহণ করেন।
তিনি মুর্শিদাবাদ থেকে এক বিশাল বাহিনী নিয়ে কটোয়ায় উপস্থিত হন। ভাস্কর পণ্ডিত যখন দুর্গা পূজায় ব্যস্ত ছিল তখন নবাবের বাহিনী আতর্কিত আক্রমণ করে তার শিবির তছনছ করে দেয়।
১৭৪২ খ্রিষ্টাব্দের ২৭ সেপ্টেম্বর ভাস্কর পণ্ডিত কটোয়া ত্যাগ করে উড়িষ্যায় যায়। শেখ মাসুমকে পরাজিত ও নিহত করে কটক দখল করে।
১৭৪০ সালে বর্ণিয়া তৃতীয়বারের মত বাংলায় আক্রমণ চালায়। রঘুজী ভোঁসালের অধীনে বর্গিবাহিনী পশ্চিম বাংলার বিভিন্ন স্থানে লুটতরাজ করতে থাকে।
বর্গি বাহিনীর কোন নিয়মিত সেনাবাহিনী ছিল না। তারা গেরিলাদের মত আক্রমণ করে উৎপীড়নের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। আলীবর্দী কূটনৈতিক চালে তাদের দমন করতে মনস্থ করেন।
তিনি রঘুজী ভোঁসালের সেনাপতি ভাস্কর পণ্ডিত ও বর্গি বাহিনীর সদস্যদের অনেক উপহার প্রদানের প্রলোভনে তার সঙ্গে সন্ধিচুক্তি সম্পাদন করতে আহ্বান জানান।
এ সুযোগে আলীবর্দী খান পণ্ডিত ভাস্কর ও তার ২২ জন অনুচরকে হত্যা করেন। এ হত্যাকাণ্ডের সংবাদে ১৭৪৪ খ্রিষ্টাব্দ ৩১ মার্চের মধ্যে বর্গিরা বাংলা ত্যাগ করে।
৭. আফগান বিদ্রোহ : ১৭৪৫ খ্রিষ্টাব্দে আলীবর্দী খান তার বিশ্বস্ত আফগান সেনাপতি মোস্তফা খানের বিদ্রোহের মোকাবিলা করেন। গোলাম মোস্তফা আলিবর্দীর নিকট বিহারের নায়েব নাযিম পদ দাবি করেন।
নবার তার জন্য উপহার পাঠান। কিন্তু দুরাত্মা সেনাপতি আলীবর্দীর বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করেন। রাজধানী মুর্শিদাবাদ আক্রমণ করেন।
কিন্তু তার এ প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। ফলে - ১৭৪৫ সালে বিহারের নায়েব জৈনুদ্দিন গোলাম মোস্তফাকে ভোজপুরের নিকট এক যুদ্ধে পরাজিত ও নিহত করেন।
৮. আলিবর্দী ও ইংরেজ বণিক : নবাব আলিবর্দীর শাসনামলে ইউরোপীয় বণিকদের বাণিজ্যে যথেষ্ট উন্নতি হয়। পূর্বে ইংরেজ বণিকদের ৪ হতে ৫টি জাহাজে বাণিজ্য চলত ১৭৪৪ খ্রিষ্টাব্দে ইহা বৃদ্ধি পেয়ে ৪০ হতে ৫০ টিতে দাঁড়ায় ইংরেজগণ সময় সময় শুল্ক ফাঁকি দিত।
১৭০৮ খ্রিষ্টাব্দে ইংরেজ বণিকরা বাংলার আর্মেনিয়ান ও মুঘল বণিকদের কয়েকটি জাহাজ আটক রাখে। এদের জাহাজ ছেড়ে দেবার জন্য নবাব কলকাতার গভর্নর বারওয়েলের নিকট পরওয়ানা পাঠান।
ইহা অমান্য করায় নবাব ইংরেজদের বাণিজ্য সুবিধা বন্ধ করে দেন। উপায় না দেখে ইংরেজরা জাহাজগুলো ছেড়ে দেয় এবং এক লক্ষ পঞ্চাশ হাজার টাকার ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য হয়।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, সামান্য অবস্থা হতে জীবন শুরু করে নিজ প্রতিভা যোগ্যতা, বিচক্ষণতা ও কর্মদক্ষতার গুণে বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার নবাব হতে সক্ষম হন।
আলীবর্দী খান বিশ্বাসঘাতকতার সাথে ক্ষমতা দখল করলেও যোগ্য ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞার দ্বারা তা গৌরবের সাথে রক্ষা করার চেষ্টা করেন।
যার ফলে তার সময়ে জনগণ সুখে-শান্তিতে বসবাস করতে সক্ষম হয়েছিল। বাংলার ইতিহাসে চিরকাল তার নাম স্মরণীয় হয়ে রয়েছে।