মস্কার এলিট তত্ত্ব সম্পর্কে বিশ্লেষণ কর
মস্কার এলিট তত্ত্ব সম্পর্কে বিশ্লেষণ কর |
মস্কার এলিট তত্ত্ব সম্পর্কে বিশ্লেষণ কর
- অথবা, এলিট কী? এলিট সম্পর্কে সমাজবিজ্ঞানী মস্কার অভিমত বিশ্লেষণ কর ।
উত্তর : ভূমিকা : আধুনিক রাজনীতি অধ্যয়নের ক্ষেত্রে এলিট একটি উল্লেখযোগ্য তত্ত্ব হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। শাসক এলিট মতবাদের মধ্যে প্যারেটো (Vilfredo Pareto) এর পর গেইটানো মস্কার (Gaetano Mosca) এর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
মস্কা তাঁর সুপ্রসিদ্ধ 'The Rulling Class' গ্রন্থে এলিট তত্ত্ব সম্পর্কে তাঁর মতবাদ বিস্তারিতভাবে বিশ্লেষণ করেছেন। মূলত শাসক শ্রেণিকেই তার এলিট তত্ত্বের মূল কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে দেখিয়েছেন।
মস্কার পরিচয় : ইতালির অন্তর্গত প্যালারসো নামক দ্বীপে ১৮৫৮ সালে গেইটানো মস্কা জন্মগ্রহণ করেন। তিনি টুরি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম আইনে এবং পরে রাষ্ট্রতত্ত্ব ও রাজনৈতিক অর্থশাস্ত্রে অধ্যাপনা করেন।
তাঁর সুবিখ্যাত গ্রন্থ The Rulling Class' ১৮৯৬ সালে প্রকাশিত হয়। এ গ্রন্থে তিনি এলিট তত্ত্ব সম্পর্কে তাঁর ধারণা ব্যক্ত করেন। ১৯৫১ সালে তিনি পরলোকগমন করেন ।
মক্কার এলিট তত্ত্ব : মস্কার এলিট তত্ত্ব সম্পর্কে নিম্নে বিস্তারিত আলোচিত হল :
দুই শ্রেণির অস্তিত্ব : Mosca তাঁর The Rulling Class' গ্রন্থে এলিট তত্ত্বের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেন, সকল সমাজেই দুই শ্রেণির জনগণ দেখা যায়, এক শ্রেণি যারা শাসন করে এবং অপর শ্রেণি যারা শাসিত হয়।
১. শাসক শ্রেণি : সমাজের শাসক শ্রেণি সর্বদাই সংখ্যায় কম কিন্তু তারা সকল রাজনৈতিক কার্য সম্পন্ন করে থাকে। এ শ্রেণির জনগণই সকল ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখে এবং ক্ষমতা হতে প্রাপ্ত যাবতীয় সুযোগ সুবিধা ভোগ করে। তারা রাষ্ট্রীয় কার্যাদি পরিচালনাসহ সকল প্রকার ক্ষমতা এককভাবে প্রয়োগ করে।
২. শাসিত শ্রেণি : শাসিত শ্রেণি সংখ্যায় অধিক এবং শাসক শ্রেণি কর্তৃক পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়। সংখ্যাগরিষ্ঠ এ সাধারণ জনগণ কতকটা আইনগতভাবে এবং কতকটা জোর জবরদস্তির মাধ্যমে শাসক শ্রেণি কর্তৃক চিরকাল পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে ।
উভয় শ্রেণির অবস্থা : শাসক ও শাসিত শ্রেণি উভয়ের অবস্থা সমাজে ভিন্ন মেরুতে হয়ে থাকে। নিম্নে দুই শ্রেণির অবস্থা উল্লেখ করা হল :
১. শাসক শ্রেণির অবস্থা : এলিট বা শাসক শ্রেণি সকল সমাজ ও সরকার ব্যবস্থাতেই কার্যকরভাবে শাসনকার্য পরিচালনা করে আসছে।
তারা রাষ্ট্রের সকল প্রকার সুযোগ সুবিধা ভোগ করে থাকে। সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও তারা সমাজে উচ্চ মর্যাদা ও একচেটিয়া ক্ষমতার অধিকারী।
মস্কার মতে, এটাই অবশ্যম্ভাবী যে, সুসংগঠিত সংখ্যালঘু শ্রেণি সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রেণির উপর প্রভাব বিস্তার করবে। এ সুসংগঠিত সংখ্যালঘু শাসক শ্রেণিই এলিট শ্রেণি নামে অভিহিত।
২. শাসিত শ্রেণির অবস্থা : অতীতকাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত শাসিত শ্রেণি বা সাধারণ মানুষ সমাজে অবহেলিত হয়ে আসছে। কোন সমাজব্যবস্থাতেই সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষ সরকার পরিচালনার অংশগ্রহণ করে নি।
সুযোগ সুবিধাও উপভোগ করে নি এবং বর্তমান সময়েও করে না। তারা সর্বদাই রাষ্ট্রের সকল প্রকার সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত ও শাসিত হয়ে আসছে।
শাসক শ্রেণির আধিপত্যের কারণ : মস্কার মতে, শাসক শ্রেণির আধিপত্যের কারণ নিম্নরূপ ।
১. তাঁদের সংখ্যালঘিষ্ঠতা : সংখ্যায় কম বলে শাসক শ্রেণি সংগঠিত ও সংঘবদ্ধ। সে কারণে সংখ্যাগুরু অসংগঠিত শ্রেণিকে তারা অতি সহজেই নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়।
অসংগঠিত বিপুল জনগোষ্ঠী কখনও সংগঠিত জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে এককভাবে কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে না।
২. শিক্ষা ও সম্পদের জোর : বিত্ত, শিক্ষা, সম্পদ প্রভৃতির জোরে সংগঠিত ও ঐক্যবদ্ধ, সংখ্যালঘু শাসকশ্রেণী অসংগঠিত সংখ্যাগুরু সাধারণ মানুষের উপর আধিপত্য বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছে।
কখনও কখনও ছলনা, প্রবঞ্চনা এমনকি শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমেও বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে তাঁরা শাসনাধীনে রাখতে পারেন।
আবর্তন চক্র : এলিটের ঘূর্ণনবাদ বা আবর্তন সম্পর্কে প্যারেটোর ন্যায় মক্ষাও তাঁর নিজস্ব অভিমত ব্যক্ত করেছেন। যা নিম্নে উল্লিখিত হল :
১. চক্রাকারে পরিবর্তন : শাসক শ্রেণি আবর্তন চক্রাকারে চলতে থাকে। আজ হোক, কাল হোক শাসক শ্রেণি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় এবং তাদের পতনের পর নতুন শাসক শ্রেণির আবির্ভাব ঘটে। এভাবে এলিটের শাসন চক্রাকারে চলতে থাকে ।
২. অন্তর্দ্বন্দ্বের কারণে পরিবর্তন : এলিটদের অন্তর্দ্বন্দ্বে পুরাতন এলিট বিতাড়িত এবং নতুন এলিট তাদের স্থলাভিষিক্ত হয়। শাসকদের প্রতি একসময় বিক্ষোভের সৃষ্টি হয় এবং সে সময় নিচের স্তর থেকেও শাসক শ্রেণির আবির্ভাব ঘটে।
তাঁরা ক্ষমতাসীনদের অপসারণ করে নিজেরা তাদের স্থান দখল করে নেন। যদি তারা অসুবিধা মনে করেন, তাহলে মধ্যম শ্রেণি হতেও শাসক নিয়োগ করতে পারেন।
৩. সামাজিক পরিবর্তনের জন্য : সামাজিক পরিবর্তন ও উন্নয়নের ফলে নতুন ভাবধারার আবির্ভাব ঘটলে এলিটের পরিবর্তন সাধিত হয়। এজন্য নিম্নশ্রেণীর মধ্যে ব্যাপক পরিবর্তন সূচিত হয়।
তাদের মধ্যে বুদ্ধি, আদর্শ, মূল্যবোধ ইত্যাদির পরিবর্তন আসে। তারা শেষ পর্যন্ত ক্ষমতাসীন এলিটদের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠে।
এক সময় ক্ষমতাসীন এলিট ক্ষমতাচ্যুত হন, কিংবা প্রতিদ্বন্দ্বী শ্রেণি থেকে যোগ্য ব্যক্তিদের স্বীয় দলভুক্ত করে নিয়ে নিজেদের টিকিয়ে রাখেন।
সমালোচনা : মস্কার এলিট তত্ত্বটি বিভিন্নভাবে সমালোচিত হয়েছে। নিম্নে মস্কার এলিট তত্ত্বের সমালোচনা তুলে ধরা হল :
১. নমনীয় : মস্কার শাসক শ্রেণির ধারণাটি খুবই নমনীয়। কেননা শাসক শ্রেণি বলতে তিনি মধ্যবিত্ত শ্রেণি, সম্পত্তির মালিক, রাজনৈতিক কর্মকর্তা, বুদ্ধিজীবী, সরকারি আমলা ইত্যাদি লোকদের চিহ্নিত করেছেন।
২. সমার্থক শ্রেণি : শাসক শ্রেণি ও রাজনৈতিক শ্রেণিকে তিনি সমার্থক বলে মনে করেছেন। কিন্তু এ দু'টি শ্রেণি সর্বক্ষেত্রে সমার্থক নয়।
৩. গণতান্ত্রিক ধারণার বিপরীত : মস্কার এলিট তত্ত্ব গণতান্ত্রিক ধ্যানধারণার সাথে পুরোপুরি সঙ্গতিপূর্ণ নয় ।
৪. এলিট আবর্তন তত্ত্ব সঠিক নয় : মন্তা ধারণা করেন নি যে, এলিটের আবর্তনের সাথে সাথে সমাজের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও কৃষ্টির পরিবর্তন সাধিত হয়।
৫. ক্ষমতার অতিরঞ্জন : রাজনৈতিক শ্রেণির ক্ষমতাকে তিনি অতিরঞ্জিত করে দেখিয়েছেন, তাদের ক্ষমতার একটা সীমাবদ্ধতা অত্যাবশ্যক। এ দিক তাঁর তত্ত্বে উপেক্ষিত হয়েছে।
উপসংহার : উপরিউক্ত আলোচনা শেষে বলা যায় যে, গেইটানো মস্কা তাঁর তত্ত্বে এলিট সম্পর্কে যে ধারণা দিয়েছেন তা বর্তমান সময়ে যথেষ্ট গ্রহণযোগ্য।
যদিও তাঁর তত্ত্বে কিছু সমালোচনা লক্ষ্য করা যায়। বর্তমানে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার মধ্যেও প্রভাবশালী অর্থাৎ এলিটদের অবস্থান খুবই সুদৃঢ়।
সর্বোপরি বলা যায়, বর্তমান রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে সঠিকভাবে ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে তাঁর তত্ত্ব যথেষ্ট সাহায্য করে থাকে।