ইসলাম খান চিশতি সম্পর্কে আলোচনা কর। তার কৃতিত্ব মূল্যায়ন কর
ইসলাম খান চিশতি সম্পর্কে আলোচনা কর। তার কৃতিত্ব মূল্যায়ন কর |
ইসলাম খান চিশতি সম্পর্কে আলোচনা কর। তার কৃতিত্ব মূল্যায়ন কর
- অথবা, ইসলাম খান চিশতি কে ছিলেন? তার কৃতিত্ব বর্ণনা কর।
উত্তর : ভূমিকা : বাংলায় মুঘল শাসন প্রতিষ্ঠায় ইসলাম খান চিশতির অবদান অপরিসীম। বাংলায় তৎকালিন সময়ে যে কয়জন সুবাদার মুঘল শাসন বাংলায় সুদৃঢ় করার জন্য অবদান রেখেছেন তাদের মধ্যে ইসলাম খান চিশতি অন্যতম।
সম্রাট জাহাঙ্গীরের আমলে বাংলার সুবাদার হিসেবে ইসলাম খান নিযুক্ত হন। তার স্বল্পকালীন শাসনামলে তিনি বিভিন্ন অভিযান পরিচালনা করার মাধ্যমে বাংলার বার ভূঁইয়া এবং পাঠার সর্দারদেরকে বিপর্যস্ত ও ব্যতিব্যস্ত করে রেখেছিলেন। তিনি অত্যন্ত বিচক্ষণতার সাথে বাংলায় মুঘল শাসন পাকাপোক্ত করেন।
→ ইসলাম খান চিশতির পরিচয় : ইসরাম খান চিশতি ১৫৭০ খ্রিষ্টাব্দে ফতেহপুর সিক্রির এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন ফতেহপুর সিক্রির সাধক পুরুষ শেখ সেলিম চিস্তির দৌহিত্র।
জাহাঙ্গীর কুলি খানের মৃত্যুর পর ইসলাম খানকে (১৬০৮-১৩ খ্রি.) সম্রাট জাহাঙ্গীর বাংলার সুবাদার নিযুক্ত করেন। তিনি ছিলেন যেমন সুদক্ষ শাসক, দুর্ধর্ষ সেনাপতি, ঠিক তেমনি ছিলেন বিচক্ষণ রাজনীতিবিদ।
তিনি বাল্যকাল থেকেই সম্রাট জাহাঙ্গীরের সঙ্গী ছিলেন। ১৬০৮ সা বাংলার সুবাদার নিযুক্ত করে তাকে ইসলাম খান উপাধি দেয়া হয়। তিনি প্রথমে ২,০০০ মনসবদারি লাভ করার পরে পরবর্তীতে ৫,০০০-এ উন্নীত হয় ।
→ ইসলাম খান চিশতির কৃতিত্ব : নিতে ইসলাম খান চিশতির কৃতিত্ব আলোচনা করা হলো :
১. বাংলার সুবাদারি লাভ : সম্রাট জাহাঙ্গীর ইসলাম ान চিশতিকে ১৫০৮ খ্রিষ্টাব্দে বাংলার সুবাদার নিযুক্ত করে পাঠান। সুবাদার নিযুক্ত হওয়ার পর তিনি বিভিন্ন অভিযান পরিচালনা করার মাধ্যমে বাংলার বীর ভূঁইয়া এবং পাঠান সর্দারদের বিপর্যস্ত ও ব্যতিব্যস্ত করে তুলেছিলেন।
এ কারণে তিনি সম্রাট জাহাঙ্গীরের একান্ত আস্থাভাজন হিসেবে গণ্য হন। সম্রাট তার কাছ থেকে সামরিক ও প্রশাসনিক ব্যাপারে সর্বদা পরামর্শ গ্রহণ করেন।
২. বার ভূঁইয়াদের সমন : ইসলাম খান বাংলার সুবাদার নিযুক্ত হওয়ার পরপরই বাংলার বার ভূঁইয়াদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করেন।
তিনি যশোহরের রাজা প্রতাপাদিত্য, বীর হাশ্মীর, সেলিম খান, শামস খান, ভূষণার রাজা ছত্রজিৎ, পুটিয়ার পীতাম্বর এবং সোনার গাঁয়ের বীরশ্রেষ্ঠ ভূঁইয়া নেতা মুসা খানকে তিনি পরাস্ত করে মুঘল আধিপত্য স্বীকার করে নিতে বাধ্য করেন।
৩. ওসমানের বিরুদ্ধে অভিযান : রাজমহলে অবস্থান করে ইসলাম খান উপলব্ধি করেন যে, বাংলার মুঘল আধিপত্যের বিরুদ্ধে বড় হুমকি বিদ্রোহী আফগান নেতা খাওয়াজা ওসমান।
এইজন্য তিনি ওসমানকে দমন করার জন্য ওসমান খানের রাজধানী বোকাইনগর আক্রমণ করে ১৬১১ খ্রিষ্টাব্দে তা অধিকার করেন।
ওসমান খান পলায়ন করে সিলেট আশ্রয়পূর্বক আবার শক্তি সঞ্চয় করেন। ফলে শ্রীহট্টের অন্তর্গত দৌলদাপুরে সংঘটিত আরও একটি যুদ্ধে ইসলাম খান ওসমান খানকে পরাজিত ও নিহত করেন।
৪. বীরভূম, পার্ট্রেটা ও হিজলি দখল : সুবাদার ইসলাম খান ঢাকার পথে রাজমহল ত্যাগ করার পূর্বে পৌঁছে পৌঁছে শায়খ কামালকে ২,০০০ অশ্বারোহী ও ৪,০০০ পদাতিক বাহিনীসহ বীরভূমের বীর হাম্বীর, পাচেটের শামস খান ও হিজলির সলীম খানের বিরুদ্ধে সমরাভিযান প্রেরণ করেন।
শায়খ কামালের নেতৃত্বে ইসলাম খান এক বিশাল বাহিনী প্রেরণ করেন এবং মির্জা নাথানের ভাষ্য অনুযায়ী এ তিনজন রাজা বা ভূস্বামী মুঘল সেনাপতির নিকট আত্মসমর্পণ করেন।
৫. কামরুপের রাজা পরীক্ষিতের সাথে সংঘর্ষ : ১৬০৩ খ্রিষ্টাব্দে কামরুপের রাজা পরীক্ষিতের বিরুদ্ধে ইসলাম খান অভিযান প্রেরণ করেন। অভিযানে জয়লাভ করলে কামরুপের রাজা ইসলাম খানের আনুগত্য স্বীকার করেন।
৬. ফতেহাবাদের মজলিশ : কুতুবের সাথে যুদ্ধ প্রতাপাদিত্য ও শত্রুজিতকে বশ্যতা স্বীকারে বাধ্য করলেও ফতেহাবাদের মজলিশ কুতুবের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করেন।
ইসলাম খানের ভাই শায়খ হাবীব উল্লাহ এ অভিযানে নেতৃত্ব দেন। মজলিশ কুতুৰ মুঘল আধিপত্য স্বীকার করে নেন।
৭. সিলেটের বায়োজিদ কররানীর সাথে সংঘর্ষ : খাজা ওসমানকে পরাজিত ও নিহত করে মুঘল সৈন্যবাহিনী আফগান শক্তির প্রধান কেন্দ্র শ্রীহট্ট (বর্তমান সিলেট) আক্রমণ করল।
শ্রীহট্টের আফগান দলপতি বায়োজিদ কররানী মুঘল সৈন্যবাহিনীর নিকট আত্মসম্পর্ণ করলে সমগ্র শ্রীহট্ট মুঘল সাম্রাজ্যভুক্ত হলো।
৮. রামচন্দ্রের বিরুদ্ধে অভিযান : ইসলাম খান ১৬১২ খ্রিষ্টাব্দে প্রতাপাদিত্যের জামাতা বাকেরগঞ্জের অধিপতি রামচন্দ্রের বিরুদ্ধেও অভিযান প্রেরণ করেন। যুদ্ধে বাকেরগঞ্জের অধিপতি রামচন্দ্র পরাজিত হলে বাকেরগঞ্জে মুঘল সাম্রাজ্যভুক্ত হলো।
৯. রাজধানী স্থানান্তর : ইসলাম খানই সর্বপ্রথম ১৬১০ খ্রিষ্টাব্দে রাজমহল হতে রাজধানী ঢাকায় স্থানান্তরিত করেন এবং মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের নামানুসারে এর নাম রাখেন জাহাঙ্গীরনগর। ইসলাম খান রাজধানী ঢাকাতেই অধিকাংশ সময় অবস্থান করতেন ।
১০. চরিত্র ও কৃতিত্ব : সুবাদার ইসলাম খান চিশতী ছিলেন। অন্যতম একজন শাসক। যিনি নিজের প্রচেষ্টাবলে বাংলায় মুঘল শাসন একচ্ছত্রভাবে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন।
তিনি মাত্র ৪ বছর সুবাদার থাকলেও তার এই স্বল্পকালীন সময়ের রাজত্ব ছিল গৌরবগাঁথা। তার শাসনামলে তিনি বাংলার জমিদারদেরকে দমন করেন।
বাংলায় মুঘল সাম্রাজ্যের আয়তন বৃদ্ধি করেন। তিনি সর্বপ্রথম ঢাকাকে রাজধানীর মর্যাদা দান করেন। তিনি ঢাকা শহরের আধুনিকায়নে কাজ করেন।
ঢাকার ধোলাইখাল তার খনন করা বলে জানা যায়। ইসলাম খান অত্যন্ত সৌখিন মানুষ ছিল। তিনি সুসজ্জিত বাজরায় চড়ে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়াতেন। শাসক হিসেবে তিনি ছিলেন অত্যন্ত সফল ও প্রজাদরদি।
মৃত্যু : সুবাদার ইসলাম খান ১৬১৩ খ্রিষ্টাব্দের ২১ আগস্ট ঢাকার নিকটবর্তী ভাওয়ালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, মুঘল সাম্রাজ্য গঠনে ইসলাম খান চিশতীর অবদান সত্যিই প্রশংসনীয়। মুঘল সাম্রাজ্য বাংলায় সুবিন্যস্ত করার ক্ষেত্রে তাঁর অসামান্য অবদান ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিখিত থাকবে।
সুবাদার ইসলাম খান চিশতি বাংলা থেকে বারভূঁইয়াদের দমন করেন এবং ঢাকাকে বাংলার রাজধানী হিসেবে মর্যাদা দেন।
সম্রাট জাহাঙ্গীরের একান্ত আস্থাভাজন ব্যক্তি সুবাদার ইসলাম খান বাংলায় মুঘল শাসন বিস্তারে অসামান্য ভূমিকা রাখেন। বাংলায় মুঘল অধিকার প্রতিষ্ঠা তার জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তি।