এলিটবাদ ও গণতন্ত্রের ধারণা ব্যাখ্যা কর। এলিট ও গণতন্ত্রের মধ্যে সম্পর্ক বিশ্লেষণ কর
এলিটবাদ ও গণতন্ত্রের ধারণা ব্যাখ্যা কর। এলিট ও গণতন্ত্রের মধ্যে সম্পর্ক বিশ্লেষণ কর |
এলিটবাদ ও গণতন্ত্রের ধারণা ব্যাখ্যা কর। এলিট ও গণতন্ত্রের মধ্যে সম্পর্ক বিশ্লেষণ কর
উত্তর : ভূমিকা : সমাজবিজ্ঞান বা রাজনৈতিক সমাজ তত্ত্বের আলোচনায় এলিট তত্ত্ব একটা উল্লেখযোগ্য স্থান দখল করে আছে।
এলিট তত্ত্বের মাধ্যমে ক্ষমতার মূল উপাদান সম্পর্কে একটা সুস্পষ্ট ধারণা লাভ করা সম্ভব। যে কোন সমাজব্যবস্থাই বিশেষ করে গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থাই এলিট তত্ত্বের ধারণা বিশেষভাবে প্রয়োগযোগ্য।
বর্তমানে গণতন্ত্রের ক্লাসিক্যাল ধারণায় এলিটবাদী গণতন্ত্রের কথা বলা হয়। সিম্যুর মার্টিন লিপসেট (Seymour Martin Lipset) এলিটবাদী গণতন্ত্রের ধারণাটি প্রয়োগ করেছেন।
Harold D. Lasswell. এলিট সম্পর্কে বলেছেন, "The study of politics is the study of the influcence and the influential."
এলিটবাদ ও গণতন্ত্রের ধারণা : রাজনৈতিক প্রক্রিয়া পর্যালোচনার ক্ষেত্রে এলিট তত্ত্ব বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। ক্লাসিক্যাল গণতন্ত্রের প্রবক্তাগণ জনগণের ক্ষমতার উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করে থাকেন।
এ গণতন্ত্রের ধারণার ক্ষেত্রে এলিট তত্ত্বের প্রয়োগযোগ্যতা লক্ষ্য করা যায়। নিম্নে এলিটবাদের সাথে গণতন্ত্রের সম্পর্ক বিশ্লেষণ করা হল :
ক্ষমতার ধারণা : সকল সংগঠনের সঙ্গেই ক্ষমতার ধারণা সংযুক্ত। এ ক্ষমতা প্রয়োগ করে মুষ্টিমেয় মানুষ বা জনসমষ্টি এটা মূলত এক বাস্তব অভিজ্ঞতা।
এ অভিজ্ঞতারই অভিব্যক্তি ঘটেছে এলিট তত্ত্বের মাধ্যমে। বস্তুত বর্তমানে Classical গণতন্ত্রের ধারণার জায়গাতে এলিটবাদী গণতন্ত্রের (Elitist democracy) এর কথা বলা হয়।
সিম্যুর মার্টিন লিপসেট (Seymour Martin Lipset) এলিটবাদী গণতন্ত্রের ধারণাটি প্রয়োগ করেছেন। সকল সমাজব্যবস্থাতেই এলিট শ্রেণির অস্তিত্ব পরিলক্ষিত হয়।
এটাকে অস্বীকার করা যায় না। আবার এলিটবাদকে গণতন্ত্রে সম্পূর্ণ অস্বীকৃতি হিসেবে প্রতিপন্ন করাও অসঙ্গত।
ক্ষমতার কেন্দ্রীভবন : সামগ্রিকতাবাদী সামজের সবচেয়ে বড় বাধা হল ক্ষমতার কেন্দ্রীভবন। ক্ষমতার এ কেন্দ্রীভবনের বিরুদ্ধে একটি বড় রক্ষাকবচ হল এলিটবাদ।
বর্তমানে গণতন্ত্র বলতে একটি প্রতিযোগিতামূলক, উন্মুক্ত ও বহুত্ববাদী সাংগঠনিক ব্যবস্থাকে বুঝায়। এলিটবাদী মস্কা রাজনৈতিক শক্তিসমূহের বিভিন্নতার প্রয়োজনীয়তা এবং স্বাধীন সূত্র ও প্রকৃতি বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের গুরুত্বের কথা বলেছেন।
এক্ষেত্রে মস্কা সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিরোধিতা করেছেন। তিনি The Rulling Class শীর্ষক গ্রন্থে বলেছেন, "Collectivism and communism, like all doctrines that are based on the passions and the blind faith of the masses, tend to destory multiplicity of political forces."
এলিট শাসন ও গণতন্ত্রের মধ্যে সামঞ্জস্যতা : ক্লাসিক্যাল গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক ধারণায় বিশ্বাসী চিন্তাবিদরা এলিটবাদের বিরোধিতা করেন। কিন্তু অন্যান্য সমাজবিজ্ঞানীদের কাছে এলিটবান ও গণতন্ত্র পরস্পর বিরোধী হিসেবে প্রতিপন্ন হয় না।
বরং এদের মধ্যে সামঞ্জস্যপূর্ণ সম্পর্ক বিদ্যমান। এ ধরনের মতবাদে বিশ্বাসী চিন্তাবিদদের মধ্যে সুম্পিটার (Schumpeter) এর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
তিনি তাঁর Capitalism, Socialism and Democracy নামক গ্রন্থে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। তাঁর অভিমত অনুসারে বলা যায়, গণতন্ত্র হচ্ছে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের এক বিশেষ প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা।
এ ব্যবস্থার মধ্যে জনগণের ভোটের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক সংগ্রামের মাধ্যমে ব্যক্তিবর্গ সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা লাভ করে। গণতন্ত্রের মাধ্যমে মানুষ প্রতিদ্বন্দ্বী এলিটদের মধ্যে বাছাই করার সুযোগ পায় ।
বহুজানের শাসনব্যবস্থায় রবার্ট এ ডাল ( Robert A. Dahl) এর মতানুসারে বহুজনের শাসনব্যবস্থায় (Polyarchy) রাজনৈতিক বিচারে সকল নাগরিকই হল সমান।
তবে তিনি বাস্তবে এ কথাও অস্বীকার করেন নি যে, সমাজে ক্ষমতার উপায়সমূহ অসমভাবে বর্ণিত হয়। সংশ্লিষ্ট নেতৃবর্গ নীতিনির্ধারণের জন্য প্রস্তাব উত্থাপন করতে পারে এবং অপরের দ্বারা উত্থাপিত প্রস্তাব বাতিল করতে পারে।
তবে এ নেতৃবর্গের পিছনে থাকে কিছু উপনেতা এবং একদল অনুগামী। এ সমস্ত বৈশিষ্ট্য এলিটদের শাসনকে বহুজনের শাসনে রূপান্তরিত করে।
সমাজতান্ত্রিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা : পুঁজিবাদী গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ন্যায় সমাজতান্ত্রিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায়ও এলিট তত্ত্বের প্রাসঙ্গিকতা ও প্রায়োগিকতা লক্ষ্য করা যায়।
কমিউনিস্ট সমাজব্যবস্থায় ক্ষমতার প্রকৃতি ও বন্টন সম্পর্কিত আলোচনার ক্ষেত্রে এলিট তত্ত্বের প্রয়োগযোগ্যতা লক্ষ্য করা যায়।
আবার সাম্যবাদী রাজনৈতিক ব্যবস্থায়ও ক্ষমতা এলিট (Power-elite) এর কর্তৃত্বপূর্ণ মনোভাব লক্ষণীয়। এলিটবাদীরা সামাজিক এলিট সম্পর্কিত মার্কসীয় বক্তব্যের বিরোধিতা করেন। এক্ষেত্রে তারা বিভিন্ন যুক্তির মাধ্যমে সমাজতন্ত্রের বিরোধিতার স্বার্থে বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন।
মস্কার সমাজতন্ত্র বিরোধী ধারণার পরিপ্রেক্ষিতে অধ্যাপক আশরফ ও শর্মা মন্তব্য করেছেন, "Mosca further observed that the strength of socialism lies more in its negative aspect, its minute pointed, merciles criticism of our present organization of society."
উন্নয়নশীল গণতান্ত্রিক দেশে এলিট তত্ত্বের প্রাসঙ্গিকতা : বিশেষ করে উন্নয়নশীল বা বিকাশমান দেশগুলো প্রসঙ্গে এলিটবাদী ধারণা অধিকতর প্রাসঙ্গিক প্রতীয়মান হয়।
এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক আশরফ ও শর্মা তাঁদের বিভিন্ন যুক্তির মাধ্যমে উন্নয়নশীল রাষ্ট্রে এলিটদের অস্তিত্বের কথাকে স্বীকার করেছেন।
উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বহু ও বিভিন্ন নতুন সামাজিক শক্তি সৃষ্টির ক্ষেত্রে এলিটদের প্রাধান্য পরিলক্ষিত হয়। এ সমস্ত বিকাশমান সমাজে আধুনিকীকরণ প্রক্রিয়ার প্রেক্ষিতে এলিটদের ভূমিকা বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ।
সমালোচনা : এলিটবাদের বিভিন্ন সমালোচনা রয়েছে। বিরুদ্ধবাদীরা এলিট তত্ত্বের বিরুদ্ধে বিভিন্ন যুক্তির কথা উল্লেখ করেছেন । নিম্নে কতিপয় যুক্তিসমূহ তুলে ধরা হল :
১. অনেকের অভিমত অনুসারে পৃথিবীর কোন কোন দেশে উদারনৈতিক ঐতিহ্য অতিমাত্রায় দুর্বল। সাধারণত এসব দেশেই এলিটবাদকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে।
২. অনেকে আবার এলিট তত্ত্বের মধ্যে সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার ছায়া প্রত্যক্ষ করেছেন, যা আধুনিক সমাজব্যবস্থার জন্য কাম্য নয়।
৩. অনেক সমাজবিজ্ঞানী অভিমত ব্যক্ত করেছেন যে, বিভিন্ন সমাজের বাস্তব অবস্থাকে এলিট তত্ত্বে উপযুক্তভাবে বিশ্লেষণ করা হয় নি।
আবার বহুত্ববাদী চিন্তাবিদরা স্বল্পসংখ্যক ব্যক্তির হাতে ক্ষমতা কুক্ষিগত করার ধারণাকে বিরোধিতা করেছেন।
উপসংহার : উপরিউক্ত সমালোচনা সত্ত্বেও বর্তমান ক্ষমতার রাজনীতিতে এলিট তত্ত্বের প্রয়োগযোগ্যতাকে কোনভাবেই উপেক্ষা করা যায় না।
গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থায় এলিট তত্ত্বের আলোচনা বিশেষ সহায়ক ভূমিকা পালন করে থাকে। বর্তমানে গণতন্ত্র ক্রমান্বয়ে উন্নত স্তরে উপনীত হচ্ছে। সেক্ষেত্রে এলিট তত্ত্বের আধুনিক মতবাদ বিশেষভাবে সহায়তা করছে।
এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক আশরফ ও শর্মা মন্তব্য করেছেন, "There exists a significant relationship between economic structure and social structure, the structure of the groups within the elite and the structure of the constitutional system."