ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ও সিরাজউদ্দৌলার মধ্যে বিরোধের কারণ বিশ্লেষণ কর
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ও সিরাজউদ্দৌলার মধ্যে বিরোধের কারণ বিশ্লেষণ কর |
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ও সিরাজউদ্দৌলার মধ্যে বিরোধের কারণ বিশ্লেষণ কর
- অথবা, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ও সিরাজউদ্দৌলার মধ্যে বিরোধের কারণ বর্ণনা কর। পলাশি যুদ্ধ সম্পর্কে লিখ।
উত্তর : ভূমিকা : বাংলা, বিহার উড়িষ্যার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজ-উদ-দ্দৌলার সাথে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সংঘর্ষ তথা পলাশির যুদ্ধ বাংলা তথা ভারতের ভাগ্য বিপর্যয়ের ইতিহাসে একটি স্মরণীয় ও উল্লেখযোগ্য ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত।
নবাবি লাভের পর থেকে সিরাজ-উদ-দৌলার বিরুদ্ধে যে প্রাসাদ ষড়যন্ত্রে শুরু হয় তাকে ঘোলা পানিতে মাছ শিকারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় ইংরেজরা যার চূড়ান্ত পরিণতি ঘটে ১৭৫৭ সালের ২০ জুন পলাশির আম্রকাননে।
এই পলাশির যুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতীয় জীবনে নেমে আসে দুর্যোগের ঘনঘটা; অন্তমিত হয়ে যায় বাংলার স্বাধীনতা সূর্য, দুইশ বছরের পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয় স্বাধীনচেতা বাঙালি জাতি।
যদিও পলাশির যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী ছিল না। তথাপি এই যুদ্ধে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে নবাবের পরাজয়ের মধ্যদিয়ে সূচিত হয় বাঙালি জাতীয় জীবনের বিয়োগান্তক ও হতাশাব্যঞ্জক সুদূরপ্রসারী অধ্যায়।
[] নবাব সিরাজউদ্দৌলার সাথে ইংরেজদের সংঘর্ষের কারণ : ১৭৫৬ সালের ৯ এপ্রিল নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা বাংলা-বিহারে- উড়িষ্যার মসনদে আরোহণ এর পর থেকে যে প্রাসাদ ষড়যন্ত্র। শুরু হয় তাতে। ইস্ট-ইন্ডিয়াহ কোম্পানি তথা ইংরেজরাও অংশগ্রহণ করে।
অভ্যন্তরীণ ও বিদেশি শক্তির সম্মিলিত দূরভিসন্ধিতে বিভিন্ন ঘটনা পরম্পরায় নবাব সিরাজ-উদ-দ্দৌলা ও ইংরেজদের মধ্যে সংঘর্ষের সূত্রপাত ঘটে যার বাস্তব রূপায়ন, ঘটে ভাগীরথী নদীর পশ্চিম তীরস্থ পলাশি প্রান্তরে।
এই পলাশির আম্রকাননে ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন বাংলার নবাব ও ইংরেজদের মধ্যে যে যুদ্ধ সংঘটিত হয় তা পলাশির যুদ্ধ নামে পরিচিত। নবাব সিরাজ উদ-দ্দৌলা ও ইংরেজদের সাথে সংঘর্ষ তথা পলাশি যুদ্ধের কারণগুলি ছিল নিম্নরূপ-
১. সিরাজ-উদ-দ্দৌলার বিরুদ্ধে অভ্যন্তরীণ : সিরাজ-উদ-দ্দৌলার সিংহাসন লাভ আলীবর্দী খানের অপর দুই কন্যা সহজে গ্রহণ করতে পারেনি। ঢাকার শাসনকর্তার বিধবা পত্নী ও নবাবের খালা ঘষেটি বেগম ও পূর্ণিয়ার শাসনকর্তার পুত্র ও নবাবের অপর খালাত ভাই শওকত জঙ্গ প্রথম থেকেই সিরাজকে সিংহাসনচ্যুত করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়।
ঘষেটি বেগমের দেওয়ান রাজা রাজবল্লভ, রায়দুর্লভ এবং মীরজাফর ক্রমান্বয়ে এই ষড়যন্ত্রের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে অভ্যন্তরীণ ষড়যন্ত্রকারী চক্রের হাতকে শক্তিশালী করে তোলে।
২. ইংরেজদের উদ্ভুত আচরণ : সিরাজ-উদ-দ্দৌলা যখন সিংহাসনে আরোহণ করেন তখন অন্যান্য ইউরোপীয় বণিকরা চিরাচরিত রীতি অনুযায়ী নতুন নবাবকে স্বীকৃতি পূর্বক উপঢৌকন পাঠিয়ে অভিনন্দন আপন করে। ইংরেজরা এক্ষেত্রে প্রচলিত রীতি অগ্রাহ্য করে ফলে সম্রাট রাগান্বিত হয়।
৩. অভ্যন্তরীণ ষড়যন্ত্রে ইংরেজদের অংশগ্রহণ : নবাবের আত্মীয়স্বজন ও তাদের দোসররা যখন নবাবকে সিংহাসনচ্যুত করার হীন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত তখন ইংরেজরা অভ্যন্তরীণ ষড়যন্ত্রকারীদের সাথে আঁতাত করে নবাবের বিরুদ্ধে তাদেরকে সহায়তা প্রদান করে থাকে। ফলে নবাব ইংরেজদের বিরুদ্ধে ক্রম হয়
৪. নবাবের বিনামতিতে দুর্গ নির্মাণ : দাক্ষিণাত্যে ইঙ্গ- ফরাসি যুদ্ধের অজুহাতে নবাবের অনুমতি না নিয়ে ইংরেজরা কলকাতায় এবং ফরাসিরা চন্দন নগরে দুর্গ নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করে।
সিরাজ-উদ-দ্দৌলা বিদেশিদের দুর্গ নির্মাণের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করলে ফরাসিরা নবাবের আদেশ মান্য করে।
কিন্তু ইংরেজরা তা অগ্রাহ্য করে দুর্গ নির্মাণ ও ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ সংস্কার করতে তৎপর হয়। ফলে নবাবের ধৈর্য্য চ্যুতি ঘটে।
৫. বাণিজ্যিক সুবিধার অপব্যবহার : ১৭১৭ সালের ইংরেজরা সম্রাট ফররুখশিয়ারের ফরমান বলে বাংলায় বিনা শুল্কে বাণিজ্য করার সুযোগ পেয়েছিল।
কিন্তু মুর্শিদকুলি খান ও আলীবর্দী খান ইংরেজদের এই অবাধ বাণিজ্যনীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার থাকায় ইংরেজরা কিছুটা সংযত হয়েছিল।
কিন্তু নবাবের সময় তারা পুনরায় বাণিজ্যিক সুযোগ সুবিধার অপব্যবহার করে এবং প্রচলিত নিয়ম উপেক্ষা করে বিনাশুল্কে অবাধ বাণিজ্য ও ব্যক্তিগত বাণিজ্য পরিচালনা করতে থাকে।
সাথে সাথে ইংরেজরা রাজনৈতিক তৎপরতাও অব্যাহত রাখে। ইংরেজদের এই কার্যকলাপ বন্ধ করার জন্য নবাব আদেশ নিলেও তারা তা অগ্রাহ্য করে।
ফলে একজন স্বাধীন নবাবের আদেশ অমান্য করে এরূপ কার্যকলাপ পরিচালনা করা ছিল নবাবের ক্ষমতা ও প্রতিপত্তির প্রতি হুমকিস্বরূপ।
৬. আলীবর্দী খানের সাথে সন্ধির বরখেলাপ : নবাব আলীবর্দী খানের সাথে সম্পাদিত সন্ধির যাবতীয় শর্ত ভঙ্গ করে ইংরেজরা জনসাধারণের উপর অত্যাচার শুরু করে এবং নবাবকে কর প্রদান করা হতে বিরত থাকে। ফলে সিরাজ-উদ-দ্দৌলা তাদের প্রতি বিক্ষুদ্ধ হয়ে ওঠেন।
৭. সিরাজ-উদ-দ্দৌলা কর্তৃক কাশিম বাজার কুঠি পরিদর্শনে ইংরেজদের বাধা প্রধান : নবাব সিরাজ-উদ-দ্দৌলা যখন ইংরেজদের কাশিমবাজারস্থ কুঠি পরিদর্শনের ইচ্ছা প্রকাশ করে দূত প্রেরণ করেন তখন ইংরেজরা নবাবের দূতকে অপমান করে বিতাড়িত করে। এতে নবাব অপমান বোধ করে ইংরেজদের রাষ্ট্রবিরোধী কার্যকলাপ প্রতিহত করতে বদ্ধপরিকর হন।
৮. ইংরেজদের অস্বীকৃতি : কৃষ্ণদাসকে প্রত্যর্পনের ক্ষেে রাজদরবারে নবাবের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র প্রতিটি কোনায় কোনায় পরিলক্ষিত হয়। ঘষেটি বেগমের পক্ষাবলম্বন করে রাজা রাজবল্লভের পুত্র কৃষ্ণদাস ও তার পরিবার পরিজন প্রভূত ধন- রত্নসহ পালিয়ে কলকাতায় ইংরেজদের আশ্রয় গ্রহণ করে।
নবাব সরাসরি কৃষ্ণদাসকে তার নিকট প্রেরণের জন্য ইংরেজদের নিকট দাবি জানান এবং নারায়ণ সিংহকে দূত হিসেবে ইংরেজদের কাছে প্রেরণ করেন।
কিন্তু ফোর্ট উইলিয়ামের গভর্নর রজার ড্রেক নবাবের দূতকে অপমান করে বের করে দেন এবং নবাবের দাখি রক্ষা করতে অস্বীকৃতি জানায়।
এর ফলে নবাবের ধৈর্যের বাধ ভেঙে যায়। নবাব ইংরেজদের প্রতি ক্ষুব্ধ হয়। পরিশেষে দুই পক্ষের মধ্যে যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে। যা বাংলার ইতিহাসে পলাশির যুদ্ধ নামে খ্যাত।
৯. নবাব সিরাজউদ্দৌলা কর্তৃক কাশিমবাজার ও কলকাতা দখল : নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা ইংরেজদের সমুচিত শান্তি প্রদানের জন্য ১৭৫৬ সালের ৪ জুন ৫০ হাজার সৈন্য নিয়ে কলকাতার দিকে অগ্রসর হয়ে প্রথমে কাশিমবাজারের ইংরেজ কুঠি দখল করেন।
নবাবের এ অতর্কিত আক্রমণে ভীত হয়ে ইংরেজ গভর্নর ড্রেক ও অন্যান্যরা ফোর্ট উইলিয়াম পরিত্যাগ করে কলকাতা নামক স্থানে আশ্রয় গ্রহণ করেন।
ফলে কলকাতা অতি সহজেই নবাবের হস্তগত হয় এবং তিনি আলীবর্দী খানের নামানুসারে কলকাতার নতুন নামকরণ করেন আলীনগর। এর ফলে ইংরেজদের সাথে নবাবের সম্পর্কের আরো অবনতি ঘটে।
১০. অন্ধকূপ হত্যার কল্পকাহিনি : কলকাতা অধিকারের ফলে কয়েকজন ইংরেজ সৈন্যকে সাময়িক বন্দি করা হয়েছিল। বন্দিদের মধ্যে কয়েকজন আহত ও অসুস্থ থাকায় কয়েকজনের মৃত্যুও ঘটে।
বন্দিদের মধ্যে ছিলেন একজন ইংরেজ ডাক্তার হলওয়েল। তিনি নবাবকে বিনাদোষে দোষী সাব্যস্ত করার জন্য অন্ধকূপ হত্যা নামে একটি কাল্পনিক কাহিনি রচনা করে যায়।
তার মতে, নবাব ১৪৬ জন বন্দিকে মাত্র ১৮" × ১৪" – ১০% আয়তন বিশিষ্ট একটি ক্ষুদ্র কক্ষে বন্দি করে রাখা হয়েছিল। এর মধ্যে শাসরুদ্ধ হয়ে ১২৩ জনের মৃত্যু ঘটে এবং বাকী ২৩ জন কোনক্রমে রক্ষা পায়।
বস্তুত সিরাজ চরিত্রকে কলঙ্কিত এবং ইংরেজদেরকে নবাবের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করে তোলার জন্য এই অন্ধকূপ হত্যার কাল্পনিক কাহিনি রচনা করা হয়েছিল।
এই ভিত্তিহীন কাহিনি ইংরেজদের বিক্ষুদ্ধ করেছিল। নবাবের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের আরও একটি নতুন কৌশল এটি ছিল।
১১. ইংরেজদের কলকাতা পুনর্দখল : কলকাতা দখলের সংবাদ মাদ্রাজে পৌছলে তা পুনরুদ্ধারের জন্য সেখানকার ইংরেজ কাউন্সিল রবার্ট ক্লাইভ ও নৌ-সেনাপতি ওয়াটসনের নেতৃত্বে একটি অভিযান প্রেরণের নির্দেশ দেয়।
কলকাতার শাসনকর্তা মানিক চাঁদ ক্লাইভের আগমন সংবাদ পেয়ে মিথ্যা যুদ্ধের ভাল করে পালিয়ে আসলে কলকাতা পুনরায় ইংরেজদের হস্তগত হয়।
১২. সিরাজ কর্তৃক কলকাতা দখলের ব্যর্থ চেষ্টা : ইংরেজরা কলকাতা পুনর্দখল করলে সিরাজ তা পুনরুদ্ধারের জন্য কলকাতা অভিমুখে যাত্রা করেন। কয়েকদিন যুদ্ধের পর ১৭৫৭ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি আলীনগরের সন্ধির দ্বারা ইংরেজ ও নবাবের মধ্যে সমঝোতা হয়।
ফলে কলকাতায় নবাবের আক্রমণ ব্যর্থ হয়। তবে সন্ধি হলেও ইংরেজরা নবাবের বিরুদ্ধে সুযোগের অপেক্ষায় থাকে।
১৩. আলীনগরের সন্ধি ভঙ্গ ও ষড়যন্ত্র : আলীনগরের সন্ধির যারা ইংরেজ ও সিরাজ-উদ-দ্দৌলার মধ্যে সমঝোতা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। সন্ধির শর্তানুসারে ইংরেজরা বেশ কিছু সুযোগ-সুবিধা লাভ করেছিল।
কিন্তু ইংরেজরা আলীনগরের সন্ধির সকল শর্ত ভঙ্গ করে নবাব বিরোধী মুর্শিদাবাদের ষড়যন্ত্রকারীদের সাথে পুনরায় আঁতাত করে।
১৪. সিরাজকে সিংহাসনচ্যুত করার জন্য ষড়যন্ত্রকারী ও ইংরেজদের মধ্যে গোপন চুক্তি : মুর্শিদাবাদে নবাব বিরোধী জোটের দল সিরাজ-উদ-দৌলাকে সিংহাসন থেকে অপসারণের মোৰ ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়।
জগৎ শেঠ, মীরজাফর, রাজবল্লভ, রায় দুর্লভ, উর্মি চাঁদ, ইয়ার লতিফ প্রমুখ সিরাজের স্থলে মীজাফরকে নতুন নবাবের আসনে অধিষ্ঠিত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
ষড়যন্ত্রকারীরা ইংরেজদের সাহায্য প্রার্থী হলে ইংরেজরা তাদেরকে আসনে অধিষ্ঠিত করার সিদ্ধান গ্রহণ করে। ষড়যন্ত্রকারীরা ইংরেজদের ” সাহায্যপ্রার্থী হলে ইংরেজদের তাদেরকে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি প্রদান করে।
অতঃপর মীরজাফর পৌনে দুই কোটি টাকা উপঢৌকনের শর্তসহ বিভিন্ন সুযোগ- সুবিধা প্রদান করার বিনিময়ে বাংলার নবাবি লাভের জন্য রবার্ট ক্লাইভের সাথে এক গোপন চুক্তি সম্পাদন করে।
এভাবে গোপন চুক্তির মধ্য দিয়ে পলাশি যুদ্ধের ক্ষেত্র প্রশস্ত হয় এবং সুযোগ বুঝে রবার্ট ক্লাইড নবাবের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে।
১৫. যুদ্ধের ঘটনা : উল্লিখিত কারণের প্রেক্ষিতে এবং বিশেষ করে মীর জাফরের সাথে রবার্ট ক্লাইভের গোপন চুক্তির ফলে নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা ও ইংরেজদের মধ্যে সংঘর্ষ অনিবার্য হয়ে ওঠে।
সবদিক থেকে ষড়যন্ত্রের জাল পাকা করে ১৭৫৭ সালের ২২ জুন রবার্ট ক্লাইভ তার বাহিনী নিয়ে নবাবের বিরুদ্ধে মুর্শিদাবাদের দিকে অগ্রসর হয়।
অন্যদিকে নবাবের বাহিনীও ইংরেজ আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য অগ্রসর হয়। অতঃপর ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন সকাল আটটায় ভাগিরথী নদীর পশ্চিম তীরে অবস্থিত পলাশির আম্রকাননে নবাব সিরাজউদ্দৌলা ও ইংরেজদের মধ্যে পলাশির যুদ্ধ সংঘটিত হয়।
এ যুদ্ধে নবাবের ছিল ১৫,০০০ অশ্বারোহী ও ৩৪,০০০ পদাতিকসহ সর্বমোট প্রায় ৫০,০০০ সৈন্য যুদ্ধ হাতি ও চল্লিশটি কামান।
অন্যদিকে ক্লাইভের অধীনে ছিল মাত্র ৩২০০ ইউরোপীয় ও দেশীয় সৈন্য ও আটটি কামান। এ সময় শক্তি থাকা সত্ত্বেও নবাবের প্রধান সেনাপতি মীর জাফরের বিশ্বাসঘাতকতা ও ষড়যন্ত্রের ফলে মাত্র ৮ ঘণ্টার ব্যবধানে নবাবের বাহিনী যুদ্ধ ক্ষেত্রে পর্যুদস্ত হয়ে পলায়ন করে।
হতভাগ্য নবাব যুদ্ধ করার ব্যর্থ চেষ্টা করে অবশেষে পলায়ন করে এবং পথিমধ্যে ধৃত হয়ে মীরজাফরের পুত্র মীরনের আদেশে মোহাম্মদী বেগ কর্তৃক ১৭৫৭ সালের ২ জুলাই নিহত হন। তার এ মৃত্যুর মধ্য দিয়ে পলাশি যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে।
→ পলাশির যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী ছিল কি না : পলাশির যুদ্ধকে কোন ক্রমেই অবশ্যম্ভাবী বা অনিবার্য যুদ্ধ হিসেবে চিহ্নিত করা যায় না। প্রকৃতপক্ষে এ যুদ্ধ ছিল অভ্যন্তরীণ ক্ষমতা লিপ্সু ষড়যন্ত্রকারীদের বিশ্বাসঘাতকতা ও ষড়যন্ত্রের ফসল।
নিম্নোক বিষয়গুলোর দিকে দৃষ্টি দিলে পলাশির যুদ্ধ যে অবশ্যম্ভাবী ছিল না তা প্রতীয়মান হয়ে ওঠবে। যথা-
১. নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা শুধুমাত্র ইংরেজদের ঔদ্ধত্যের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করেছিলেন। তাদের উদ্ধত আচরণ ও অবাধ্যতার বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু কোন ক্রমেই তাদেরকে উৎখাত করার সিদ্ধান্ত নেননি।
২. নবাবের সাথে ইংজেরদের সম্পর্কের অবনতি ঘটলেও এবং কয়েকটি ছোট খাট সংঘর্ষ সংঘটিত হলেও তা চূড়ান্ত সংঘর্ষে রূপ লাভ করেনি।
৩. আলীনগরের সন্ধির মাধ্যমে নবাবের সাথে ইংরেজদের সমঝোতা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। কেননা সন্ধির শর্তানুসারে ইংরেজ সমঝোতা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। কেননা সন্ধির শর্তানুসারে ইংরেজরা নিম্নোক্ত সুযোগ- সুবিধা লাভ করেছিল। যথা-
(ক) কোম্পানি বিনা শুল্কে বাংলা, বিহার, উড়িষ্যায় বাণিজ্যিক অধিকার লাভ করে।
(খ) ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ সংস্কার করার অধিকার লাভ করে।
(গ) কলকাতায় নিজস্ব মুদ্রা প্রবর্তনের জন্য কোম্পানি টাকশাল স্থাপনের অনুমতি লাভ করে।
(ঘ) কলকাতা আক্রমণের সময় কোম্পানি ও কোম্পানির কর্মচারীদের যে সমুদয় পণ্য দ্রব্য ও আসবাবপত্র লুষ্ঠিত হয়েছিল সেগুলো প্রত্যর্পণ করতে এবং যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ প্রদান করতে স্বীকৃত হন। এভাবে আলীনগরের চুক্তির মাধ্যমে কোম্পানি ও নবাবের মধ্যকার তিক্ততার আপাতত অবসান ঘটেছিল।
৪. পলাশির যুদ্ধ ছিল দেশীয় ষড়যন্ত্রকারীদের ক্ষমতা লিপ্সার ফসল। মীরজাফরকে মসনদে বসানোর দেশীয় চক্রান্ত পাকাপোক্ত করার পর অর্থ ও নানা সুযোগ-সুবিধা প্রদানের লোভ দেখিয়ে ষড়যন্ত্রকারীরা ইংরেজদেরকে নবাবের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে প্ররোচিত করেছিল। এ সকল কারণে পলাশির যুদ্ধকে অবশ্যম্ভাবী বা অনিবার্য যুদ্ধ হিসেবে চিহ্নিত করা যায় না।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, ইংরেজদের সাথে নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার বিরোধ ছিল প্রচলিত রীতি নীতির বিরুদ্ধে ইংরেজদের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের ফলশ্রুতি।
নবাবের ক্ষমতা ও নিরাপত্তার প্রতি হুমকি হয়ে দেখা দেয়ায় নবাব ইংরেজদের অবাধ্যতার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন।
কিন্তু পলাশির যুদ্ধ সংঘটনে দেশীয় ষড়যন্ত্রকারীদের ক্ষমতা লিকা ও বিশ্বাসঘাতকতাই গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
ইংরেজদেরকে নবাবের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার সুযোগ ও সাহস মীর জাফর জঙ্গরাই জুগিয়েছিল। তাই পলাশির যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী বা অনিবার্য যুদ্ধ বলা যায় না।