ভারতীয় এবং বাংলাদেশীয় এলিটদের মধ্যে তুলনামূলক আলোচনা কর
ভারতীয় এবং বাংলাদেশীয় এলিটদের মধ্যে তুলনামূলক আলোচনা কর |
ভারতীয় এবং বাংলাদেশীয় এলিটদের মধ্যে তুলনামূলক আলোচনা কর
- অথবা, বাংলাদেশ ও ভারতীয় এলিটের সম্পর্ক মূল্যায়ন কর।
উত্তর : ভূমিকা : বর্তমান আধুনিক রাজনৈতিক ব্যবস্থা বিশ্লেষণে যে কোন রাষ্ট্রের জন্য এলিটদের অস্তিত্বকে অস্বীকার করবার উপায় নেই।
এশিয়ার অন্যতম দু'টি রাষ্ট্র ভারত ও বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকে এলিট শ্রেণির উপস্থিতি পরিলক্ষিত হয়। অতি সম্প্রতি ভারত ও বাংলাদেশে কিছু নতুন এলিটগোষ্ঠী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে ।
অধ্যাপক অমর্ত্য সেন তাঁর 'How India is Doing' প্রবন্ধে বলেছেন, "The elite groups in India are numerically large It include's millions of civil servants, business people, commercal farmers, educators, office workers and small land owners.".
ভারত ও বাংলাদেশী এলিটদের তুলনামূলক আলোচনা : বাংলাদেশ ও ভারতের জন্মলগ্ন থেকেই কিছু এলিট শ্রেণি সক্রিয় ভূমিকা রেখেছে।
তবে স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে এই দুই রাষ্ট্রের বিভিন্ন পন্থি বা বিভিন্ন শ্রেণির এলিটদের উদ্ভব ঘটেছে। নিম্নে এদের তুলনামূলক বর্ণনা আলোচনা করা হল।
ক. শ্রেণিবিন্যাস : বর্তমান ভারতীয় এলিটদের কতিপয় শ্রেণিতে বিভক্ত করা হয়-
১. বুদ্ধিজীবী এলিট,
২. রাজনৈতিক এলিট,
৩. ব্যবসায়ী এলিট,
৪. তফশিলি ও অনগ্রসর শ্রেণির এলিট,
৫. প্রশাসনিক এলিট,
৬. পরিচালক এলিট,
৭. গ্রামাঞ্চলের এলিট,
৮. ধর্মীয় এলিট।
এলিট শ্রেণির উদ্ভব ঘটে ।
১. রাজনৈতিক এলিট,
২. আমলাতান্ত্রিক এলিট,
৩. ধর্মীয় এলিট,
অপরদিকে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে নিম্নোক্ত :
১. সামরিক এলিট,
২. প্রশাসনিক এলিট,
৩. শ্রমিক এলিট,
৪. কোয়ালিশন এলিট।
বাংলাদেশে এলিট শ্রেণির অবস্থান : বাংলাদেশের রাজনীতিতে এলিট শ্রেণির বিকাশ ঘটেছে স্বাধীনতা পরবর্তী সম থেকে। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় রাজনৈতিক এলিটদের দাপট পরিলক্ষিত হয়।
তখন রাজনৈতিক এলিটদের বিপক্ষে ছিলেন সামরিক ও আমলাতান্ত্রিক এলিট শ্রেণি। কিন্তু পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্রের দুর্বল নীতি ও দুরদর্শিতার অভাবে এবং স্বাধীনতা পরবর্তী রাজনৈতিক সংকটের কারণে সামরিক এলিটগণ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়।
১৯৭৫ সালের আগস্টের ১৫ তারিখের পর থেকে ধীরে ধীরে রাজনৈতিক এলিটদের জায়গাতে সামরিক এলিটগণ স্থলাভিষিক্ত হয়েছে।
পরবর্তীতে বাংলাদেশে রাজনৈতিক এলিটদের হাতকে শক্তিশালী করতে কোয়ালিশন এলিট শ্রেণির উদ্ভব ঘটেছে।
সত্যিকার অর্থে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় কখনও কোন একক এলিট শ্রেণি বা এলিট গোষ্ঠী ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকতে পারে নি। ১৯৭৮ সালে ৩২ জন মন্ত্রিপরিষদের তালিকা মতে এলিট শ্রেণির একটা স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায় ।
এই তালিকাটি নিম্নে তুলে ধরা হল :
১. সাংগঠনিক, আইনজীবী, ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার = ১৪ জন
২. আমলাতন্ত্রী = ৩ জন
৩. ট্রেড ইউনিয়নের সদস্য = ১ জন
৪. শিল্পপতি = ১ জন
৫. সামরিক সদস্য = ৫ জন
৬. অন্যান্য = ১ জন
উপরিউক্ত উপাত্ত বিশ্লেষণ থেকে বুঝা যায় যে, বাংলাদেশে Coalition elite শ্রেণিই রাজনৈতিক ব্যবস্থার কেন্দ্রবিন্দু।
তবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থা বিশ্লেষণ করলে মিশেলস্ হয় কতিপয় ব্যক্তির শাসন (Iron law of oligarchy) এই মতবাদকেই বেশি গ্রহণযোগ্য বলে ধারণা করা হয়।
ভারতীয় এলিটদের অবস্থান : ভারতীয় এলিটদের অবস্থান বিশ্লেষণ করতে হলে নিম্নের এলিট শ্রেণির কার্যপ্রক্রিয়াকে বিশ্লেষণ করতে হবে ।
১. বুদ্ধিজীবী এলিট (Intellectual elite) : ভারত তৃতীয় বিশ্বের অন্যতম উন্নয়নশীল রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত। এ শ্রেণির বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা নিয়ে সর্বদা বিতর্কের ঊর্ধ্বে।
কারণ বুদ্ধিজীবী শ্রেণির যাবতীয় বৈজ্ঞানিক জ্ঞান ও প্রযুক্তিগত কলাকৌশলের আধার। এদের কার্যক্রমের উপর নির্ভর করে রাষ্ট্রীয় জনমত প্রতিষ্ঠিত হয়।
কিন্তু বর্তমান আধুনিক ভারতের বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে স্বার্থ সম্পর্কিত কাজকর্মের ব্যাপক প্রসার ঘটেছে।
বর্তমান ভারতীয় বুদ্ধিজীবীদের অ-রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের উপর অধিক আগ্রহী হতে দেখা যায়। আবার অনেক ক্ষেত্রে মাফিয়াদের দৌরাত্ম্যে বুদ্ধিজীবীরা রাজনৈতিক ময়লান থেকে স্বেচ্ছায় সরে দাঁড়াচ্ছেন।
২. প্রশাসনিক এলিট (Administrative elite) : আধুনিক সময়ে সরকারি কাজকর্ম অতি মাত্রায় জটিল (Complex) প্রকৃতির হয়ে উঠেছে। বর্তমানে প্রযুক্তিবিদ্যা ও বৈজ্ঞানিক কলাকৌশলের অপরিসীম বিকাশের ফলে রাজনীতিবিদদের জ্ঞান-বুদ্ধি দ্বারা এই প্রশাসন ব্যবস্থাকে পরিচালনা করা সম্ভব নয়।
সে কারণে ভারতে প্রশাসনিক এলিটদের বিকাশ ঘটেছে। ভারতের প্রশাসনিক এলিট বলতে ভারতীয় প্রশাসনিক কর্মকর্তা (Indian Administrative Service) দের বুঝায় ।
৩. রাজনৈতিক এলিট : ভারতীয় এলিটদের মধ্যে রাজনৈতিক এলিট শ্রেণি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। রাজনৈতিক এলিট বলতে সাধারণত পেশাদার রাজনীতিবিদ বা পুরো সময়ের রাজনীতিবিদদের বুঝায়।
'রাজনৈতিক এলিট' কথাটি প্রথম ব্যবহার করেছেন Vilfredo Pareto এবং Gaetano Mosca। অধ্যাপক অমর্ত্য সেনের অভিমত অনুসারে ভারতীয় সমাজ ও রাজনীতি এলিটবাদী প্রকৃতি।
ভারতের রাজনৈতিক এলিট শ্রেণির অধিকাংশ ব্যক্তিই উপর মহলের ও মধ্যবিত্ত পর্যায়ের জাতিগোষ্ঠী থেকে উঠে এসেছে।
৪. পরিচালক এলিট : বর্তমান ভারতের এলিট গোষ্ঠীর মধ্যে পরিচালক এলিটদের অস্তিত্ব অনস্বিকার্য হয়ে উঠেছে। বর্তমানে সরকারি ও বেসরকারি পরিচালনাধীন শিল্প, বাণিজ্য, ব্যাংক প্রভৃতি ক্ষেত্রে পরিচালক শ্রেণির অপরিহার্যতা পরিলক্ষিত হয়।
শিল্প-বাণিজ্যের ব্যাপক বিকাশ ও বিস্তার এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অভাবনীয় অগ্রগতি পরিচালক শ্রেণির ভূমিকাকে এখন অপরিহার্য করে তুলেছে।
৫. ব্যবসায়ী এলিট : বিগত দুই-তিন দশকের রাজনৈতিক ব্যবস্থা বিশ্লেষণ থেকে দেখা যায় ভারতে আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে ব্যবসায়ী এলিটদের প্রভাব-প্রতিপত্তি অনেকাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে।
স্বার্থগোষ্ঠী বা চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী হিসেবে Merchant Chambers of Commerce, Indian Chambers of Commerce, Bengal Chambers of Commerce প্রভৃতি ব্যবসায়ী সংগঠন জাতীয় ও আঞ্চলিক রাজনীতিকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে ।
৬. ধর্মীয় এলিট : ভারতের এলিট শ্রেণির মধ্যে ধর্মগুরু ও পুরোহিতদের অস্তিত্বকে অস্বীকার করা যায় না। ভারত যেহেতু হিন্দুপ্রধান দেশ সুতরাং এদেশের রাজনীতিতে ধর্মীয় এলিটশ্রেণী ও পুরোহিতদের অস্তিত্ব অবশ্যম্ভাবী হিসেবে প্রতিপন্ন হয়।
এ প্রসঙ্গে S. L. Sikri মন্তব্য করেছেন, "Social and religious leaders of the eminence of Baba Amte Sushi Muni Jain launch movements which have a direct political bearing."
উপসংহার : উপরিউক্ত আলোচনা থেকে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, ভারত ও বাংলাদেশ উভয় দেশের রাজনৈতিক অবস্থায় এলিট শ্রেণির অস্তিত্ব অপরিহার্য।
তবে রাজনৈতিক ও আর্থসামাজিক ব্যবস্থার পার্থক্যের কারণে এই দুই রাষ্ট্রের মধ্যে এলিট শ্রেণির কিছুটা ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়।
বাংলাদেশে যেমন স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে এলিটদের অস্তিত্ব বেড়েছে, তেমনি ভারতের রাজনীতিতে বর্তমানে এলিট শ্রেণির অস্তিত্বকে বৃদ্ধি করার জন্য বিভিন্নভাবে এলিট শ্রেণি জনগণের উপর প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করেছে।