বাংলায় পর্তুগিজদের উত্থান ও পতন আলোচনা কর
বাংলায় পর্তুগিজদের উত্থান ও পতন আলোচনা কর |
বাংলায় পর্তুগিজদের উত্থান ও পতন আলোচনা কর
উত্তর : ভূমিকা : বাংলায় পর্তুগিজ বণিকদের আগমন একটি স্মরণীয় ঘটনা। সুলতানি ও মুঘল আমলে ইউরোপের অধিকাংশ সামুদ্রিক ব্যবসায়ী জাতির সঙ্গে বাংলার বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। পর্তুগিজরাই সর্বপ্রথম বাংলায় আগমন করে এদেশের সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে তোলে।
→ বাংলায় পর্তুগিজদের উত্থান : নিম্নে বাংলায় পর্তুগিজদের উত্থান আলোচনা করা হলো:
১. ভাস্কো দা গামার আগমন : ১৪৯৮ সালে পর্তুগিজ নাবিক ভাস্কো দা গামা আফ্রিকার পশ্চিম পূর্ব উপকূল ঘুরে যাবর সমুদ্র পথে ভারতবর্ষে আসার জলপথ আবিষ্কার করেন।
এরপর পর্তুগিজ বণিকগণ ভারতবর্ষ তথা বাংলায় বাণিজ্য করতে আসে। ১৫১৬ সালে পর্তুগিজরা প্রথম বাংলায় আগমন করে।
২. চট্টগ্রামে বাণিজ্য কুটি স্থাপন : ১৫১৭ সালে নো ডি- সিলভেরা নামে জৈনক পর্তুগিজ সমর অধিনায়ক এক নৌবাহিনী নিয়ে চট্টগ্রামে আগমন করেন।
চট্টগামে বাণিজ্য কুটি স্থাপনের সকল তার ব্যর্থ হয়। অপরদিকে, গোয়ার পর্তুগিজ শাসনকর্তা নুনো দা কুনহা বাণিজ্য কুটির স্থাপনের চেষ্টা করতে থাকেন।
১৫৩৬ সালে সুলতান মাহমুদ শেরশাহের বিরুদ্ধে পর্তুগিজদের সাহায্য লাভের আশায় চট্টগ্রামে বাণিজ্য কুটি স্থাপনের অনুমতি প্রদান করে। এভাবে বাংলায় পর্তুগিজ বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠা লাভ করে।
৩. হুগলিতে বাণিজ্যিক কুটির স্থাপন : পুনঃপ্রতিষ্ঠার পর আবার পর্তুগিজরা এদেশের বাণিজ্য করার অনুমতি পায়।
১৫৭৯-৮০ সালে মুঘল সম্রাট আকবর ভাগীরথী নদীর তীরে হুগলি নামক একটি গ্রামে পর্তুগিজদের কুড়ি তৈরির অনুমতি দেন এবং এটাই কালক্রমে একটি সমৃদ্ধ শহর ও বাংলায় পর্তুগিজদের বাণিজ্যের প্রধান কেন্দ্রে পরিণত।
এখান থেকে পর্তুগিজদের ব্যবসা-বাণিজ্য উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকে। আইন-ই-আকবরির বর্ণনা অনুযায়ী ১৫৮৭ সালে ও হুগলি ও সপ্তগ্রাম পর্তুগিজদের দখলে ছিল।
৪. বাংলার বিভিন্ন স্থানে কুটির নির্মাণ : হুগলিকে কেন্দ্র করে বাংলার বিভিন্ন স্থানে পর্তুগিজরা বাণিজ্য কুটির নির্মাণ করতে থাকে। অল্পদিনের মধ্যে তারা হিজলি সাতগাঁও, ঢাকা, যশোর, নোয়াখালী, সোনারগাঁও প্রভৃতি বাণিজ্য কুটির ও বসতি স্থাপন করে।
৫. বাংলার রপ্তানি বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ : ১৫৮৩ সাল থেকে ১৬৩০ সাল পর্যন্ত বাংলার রপ্তানি বাণিজ্য পর্তুগিজদের দখলে ছিল। পর্তুগিজরা বাংলা থেকে যেসব পণ্য বিদেশে রপ্তানি করতো। তার মধ্যে প্রধান ছিল চাল, ডাল, ঘি, তৈল, মোম ও মধু।
অভ্যন্তরীণভাবে পর্তুগিজরা কতিপয় শিল্প নিয়ন্ত্রণ করতো। যেমন মিষ্টি ও আচার শিল্প। এদেশ থেকে পণ্য বিদেশে রপ্তানি করে তারা প্রচুর অর্থ সম্পদের অধিকারী হয়েছিল।
৬. দাস-দাসীদের পরিচালনা : সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথম দিকে পর্তুগিজদের ক্ষমতা ও প্রভাব ব্যাপক বৃদ্ধি পায়। তাদের বাণিজ্যিক কার্যকলাপের একটি অংশ ছিল দাস ব্যবসা।
তারা মানুষকে দাস হিসেবে ক্রয় করে বিদেশে রপ্তানি করতো। এমনকি মুঘল শত্রু আরাকান রাজাকে সজিনা করতে সাহস পায়।
৭. বাংলার জনপথ নিয়ন্ত্রণ : বিদেশি বণিকদের মধ্যে সর্বপ্রথম পর্তুগিজরাই বাংলায় বাণিজ্যিক আধিপত্য বিস্তার লাভ করেছিল। সতেরো শতকের প্রথম দিকে বাণিজ্যের সকল ক্ষেত্রে পর্তুগিজদের প্রভাব অপরিসীম।
তারা চট্টগ্রাম, হুগলি সাতগাঁও ছাড়াও বঙ্গোপসাগর ও অন্যান্য জলপথ নিয়ন্ত্রণ করতো। বাণিজ্যিক জাহাজ তাদের অনুমতি ছাড়া বাণিজ্য কেন্দ্রে ভিড়তে পারতো না। পর্তুগিজদের অনুমতি ছাড়া বাংলায় কেউ ব্যবসা করতে পারতো না ।
→ বাংলায় পর্তুগিজদের পতন : নিয়ে বাংলায় পর্তুগিজদের পতন আলোচনা করা হলো-
১. দুর্নীতিগ্রন্ত শাসন : বাংলায় পর্তুগিজদের পতনের অন্যতম কারণ হলো দুর্নীতিপরায়ণ শাসনব্যবস্থা। পর্তুগিজ সেনা ও কর্মচারীর উপর পর্তুগিজ কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণ ছিল না।
তাই তারা নিয়মিত বেতন না পাওয়ার কারণে জনগণের নিকট থেকে অতিরিক্ত কর ও উৎকোচ গ্রহণ করতো। তাদের অন্যায় অবিচার | বাংলার জনগণ মেনে নেয়নি।
২. অত্যাচারী শাসক : পর্তুগিজ শাসকগণ বাংলার মানুষকে অমানবিক অত্যাচার ও নির্যাতন করতেন। যার ফলে স্থানীয় জনগণ তাদের আচরণে অতিষ্ঠ হয়ে পড়ে।
পর্তুগিজদের অত্যাচার ও লুটতরাজের ফলে আরব বণিকগণ বাংলাদেশ থেকে ফিরে যেতে বাধ্য হয়। তাছাড়া তারা স্থানীয় বালক বালিকা ক্রয় করে দাসদাসীতে পরিণত করতেন।
৩. সুনির্দিষ্ট নীতির প্রভাব : বাংলায় পর্তুগিজদের পতনের আরেকটি অন্যতম কারণ হলো শাসকদের সুনির্দিষ্ট নীতির অভাব। বিভিন্ন পর্তুগিয়া শাসনকর্তা বিভিন্ন নীতি গ্রহণ করার পর্তুগিজ শক্তি স্থায়ী হয়নি।
৪. পর্তুগিতাদের ধর্মানুতা : পর্তুগিজদের ধর্মান্ধতা তাদের পতনের অন্যতম কারণ। তারা ছিল খ্রিষ্টান ক্যাথলিক। পর্তুগিজ | বাংলার মানুষকে জোরপূর্বক খ্রিষ্টান ধর্মে ধর্মান্তরিত করেন। যার ফলে বাংলার জনগণ তাদের পতন চা
৫. মিশ্র বিবাহ : পুস্তগিজরা বাংলা ব্যবসা করতে আসার পর দীর্ঘদিন বাংলায় বসবাস করতে থাকে। এর ফলে তারা স্থায়ী বসবাস করতে থাকে এবং বাঙালি নারীদের বিবাহ করে। যার ফলে একটি মিশ্র বিবাহের সৃষ্টি হয়। এটা বাংলার জনগণ মেনে নিতে পারেনি।
৬. ডাক ও ইংরেজ শক্তির আক্রমণ : পর্তুগিজদের ব্যবসা বাণিজ্য উৎসাহিত হয়ে ইউরোপের আরও বাণিজ্যিক সম্প্রদায় নেদারল্যান্ড ও ইংরেজরা বাংলায় ব্যবসা করতে আসে।
এতে করে পর্তুগিজদের একচেটিয়া বাণিজ্য নষ্ট হয়। বাণিজ্যিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার কারণে তাদের মধ্যে সংঘর্ষ দেখা দেয়। তারা বাংলায় ডাচ্ ও ইংরেজদের নিকট পরাজিত হন।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, উত্থান, বিকাশ ও পতন জগতের স্বাভাবিক নিয়ম। এক্ষেত্রে পর্তুগিজরাও ব্যতিক্রম নয়। তারা বাংলায় অফুরন্ত ধনসম্পদের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে এদেশে সর্বপ্রথম বাণিজ্য করতে আসে।
যা পর্তুগিজরা অল্পদিনের মধ্যে খুব জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। কিন্তু পর্তুগিজদের অত্যাচার ও কুশাসনে তাদের পতন ঘটে।