বাংলায় ইউরোপীয় বণিকদের কর্মতৎপরতা বিশ্লেষণ কর
বাংলায় ইউরোপীয় বণিকদের কর্মতৎপরতা বিশ্লেষণ কর |
বাংলায় ইউরোপীয় বণিকদের কর্মতৎপরতা বিশ্লেষণ কর
- অথবা, ইউরোপীয় বিভিন্ন কোম্পানি ও বাংলার সাথে বাণিজ্যিক কর্মতৎপরতা তুলে ধর।
উত্তর : ভূমিকা : পনেরো শতকের রেনেসাঁত্তোর ইউরোপের উল্লেখযোগ্য দিক ছিল ষোলো শতকের ভৌগোলিক আবিষ্কার।
আর বাংলায় ইউরোপীয় কোম্পানিগুলোর বাণিজ্যিক কর্মতৎপরতা ছিল ইউরোপে ভৌগোলিক আবিষ্কার ও স্তপ্রসূত বাণিজ্যিক বিপ্লবের ফলশ্রুতি।
ভৌগোলিক আবিষ্কারের ফলে ইউরোপীয় বিভিন্ন বণিক গোষ্ঠী যেমন পর্তুগিজ, ওলন্দাজ, দিনেমার, ব্রিটিশ ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানি একে একে বাংলায় আগমন করে এবং বাংলার সাথে বাণিজ্যিক কর্মতৎপরতায় লিপ্ত হয়।
→ বাংলায় ইউরোপীয় বণিকদের কর্মতৎপরতা : মধ্যযুগে বিশেষ করে সুলতানী ও মুঘল যুগে ইউরোপের বিভিন্ন সামুদ্রিক ব্যবসায়ী জাতির সাথে বাংলার বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়।
আর এই সূত্র ধরে ইউরোপীয় কোম্পানিগুলো বাংলার সাথে তাদের বাণিজ্যিক কর্মতৎপরতা চালাতে থাকে। নিম্নে এসকল বিদেশি কোম্পানি তথা ইউরোপীয় কোম্পানির সাথে বাংলার বাণিজ্যিক কর্মতৎপরতারই একটি বিবরণ নিম্নে তুলে ধরা হলো :
১. বাংলায় পর্তুগিজদের বাণিজ্যিক কর্মতৎপরতা : ১৪৯২ সালে পর্তুগিজ নাবিক ভাস্কো-ডা-গামা নৌপথে দক্ষিণ আফ্রিকার উত্তমাশা অন্তরীপ ঘুরে সর্বপ্রথম ভারতে আসার যে পথ আবিষ্কার করেন তার সূত্র ধরে ১৫১৬ সালে পর্তুগিজেরা সবপ্রথম বাংলায় আগমন করে।
ভারতের পশ্চিম উপকূলবর্তী গোয়া নামক অঞ্চলে পর্তুগিজদের স্থায়ী ঘাঁটি ছিল। এই ঘাঁটি হতে তারা মৌসুমি বাতাস ধরে বাংলায় আসত এবং কিছুকাল ব্যবসা-বাণিজ্য করে আবার মৌসুমি বাতাস ধরে গোয়াতে প্রত্যাবর্তন করত।
কিন্তু বাংলার সুলতান মাহমুদ শাহ (১৫৩৩-১৫৩৮) ১৫৩৬ সালে আফগান নেতা ও বীর শের শাহের সম্ভাব্য আক্রমণের বিরুদ্ধে সামরিক সাহায্যের বিনিময়ে পর্তুগিজদের চট্টগ্রাম ও সাতগাঁও বন্দরে প্রচুর জমি দান করেন এবং তথায় স্থায়ী কুঠি স্থাপনেরও অধিকার দান করেন।
যদিও শেরশাহ বাংলা হতে পর্তুগিজদের বিতাড়িত করেছিলেন। কিন্তু মুঘল শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠার সাথে সাথ পর্তুগিজেরা পুনরায় বাংরার সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে তোলে এবং পরবর্তী দীর্ঘকাল যাবৎ বাণিজ্যিক কর্মতৎপরতার পাশাপাশি রাজনৈতিক তৎপরতায়ও লিপ্ত হয়।
ষোলো শতকের শেষার্ধ হতে সপ্তদশ শতকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত পর্তুগিজ জাতি বাংলার সাথে ব্যবসা-বাণিজ্য অব্যাহত রাখে।
পর্তুগিজরা বাংলা হতে যেসব পণ্য বিদেশে রপ্তানি করত তার মধ্যে প্রধান ছিল চা, ডাল, খি, তৈল, মোম ও মধু। তাছাড়া ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে তাদের একটি উল্লেখযোগ্য দিক ছিল দাস ব্যবসা।
তারা বাংলা হতে অসংখ্য মানুষকে জোরপূর্বক ক্রয় করে বিদেশে রপ্তানি করত। অন্যদিকে আমদানি বাণিজ্যের ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, পর্তুগিজরা চীন দেশ হতে কারুকার্য কচিত রেশমি কাপড়, মালাক্কা দ্বীপপুঞ্জ হতে লবঙ্গ, এলাচি, দারচিনি প্রভৃতি গরম মসলা, বর্ণিও হতে কপূর্র, সিংহল হতে চীনাবাদাম, মালাবার হতে গোলমরিচ এবং মালদ্বীপ হতে কড়ি আমদানি করত।
উল্লেখ্য যে বাংলায় তখন কড়িই ছিল ক্রয়-বিক্রয়ের প্রধান মাধ্যম। আবার অভ্যন্তরীণভাবে পর্তুগিজরা কতিপয় শিল্প নিয়ন্ত্রণ করতে। যেমন মিষ্টি ও আচার শিল্প।
তারা দুধ ও চিনির সাহায্যে নানা প্রকার রসাল ও শুকনা মিষ্টি তৈরি করে তা বিক্রি করত। নানাবিধ আচার তৈরিতেও ছিল পর্তুগিজরা অত্যধিক পটু।ব্যবসা-বাণিজ্যের পাশাপাশি বাংলার কৃষি ক্ষেত্রেও পর্তুগিজদের "অবদান ছিল গুরুত্বপূর্ণ।
তারা উত্তর আমেরিকা থেকে গোলআলু ও তামাক, ব্রাজিল হতে বানাম, ওয়েস্ট ইন্ডিজ থেকে পেঁপে, আনারস, কামরাঙ্গা ও পেয়ারা, ইউরোপ থেকে জলপাই ও কৃষ্ণকলি প্রভৃতি এনে এদেশে প্রচলন করে। উল্লেখ্য যে পর্তুগিজদের বাংলায় আগমনের পূর্বে এইগুলো বাংলায় ছিল না।
বস্তুত পর্তুগিজদের বাণিজ্যিক কর্ম তৎপরতার পাশাপাশি রাজনৈতিক কর্মতৎপরতা এবং বিদেশি শক্তি কর্তৃক বাংলায় বাণিজ্য করার প্রয়াস প্রভৃতি কারণে সপ্তম শতকের প্রথমার্ধেই তারা বাংলা হতে বিদায় গ্রহণ করে।
২. বাংলায় ওলন্দাজ ও সিনেমারদের বাণিজ্যিক তৎপরতা : পর্তুগিজ ও ইংরেজদের অনুসরণ করে হল্যান্ডের ডাচ বা ওলন্দাজরা ও পরে ডেনমার্কের সিনেমাররা বাংলার সাথে বাণিজ্য করার আগ্রহ নিয়ে এদেশে আগমন করে।
ওলন্দাজরা ১৬৫৩ সালে পশ্চিমবঙ্গের চুঁচুড়া বন্দরে এবং দিনেমাররা পশ্চমবঙ্গের শ্রীরামপুরে বাণিজ্য কেন্দ্র স্থাপন করে।
কিছু দিন তারা বাংলার সাথে বাণিজ্য করলেও ইংরেজদের সাথে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে তারা এদেশ থেকে বিদায় নেয়।
৩. বাংলায় ফরাসিদের বাণিজ্যিক তৎপরতা : ফরাসিরা বাংলার চন্দন নগরে বাণিজ্য কুঠি স্থাপন করে। ফরাসি নেতা ডুপ্লে সর্বপ্রথম 'ফরাসি ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির বাংলার চন্দননগর কুঠির ভারপ্রাপ্ত প্রধান হিসেবে নিযুক্তির পর থেকেই বাংলার সাথে ফরাসি বাণিজ্যের সূচনা ঘটে।
কিন্তু বাংলায় ফরাসি বণিকদের বাণিজ্যিক কর্মতৎপরতা তেমন স্থায়িত্ব লাভ করেনি। ফরাসিদের মধ্যে রাজনৈতিক দূরভিসন্ধি মাথাচাড়া দিয়ে উঠলে ইংরেজ বণিক গোষ্ঠীর সাথে তাদের দ্বন্দ্ব দেখা দেয় এবং ইংরেজদের বিরোধিতা ও প্রতিযোগিতায় টিকতে না পারায় বাংলায় ফরাসিদের বাণিজ্যিক কর্মতৎপরতার অবসান ঘটে।
৪. বাংলায় ব্রিটিশ ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির বাণিজ্যিক কর্ম তৎপরতা : ১৮৩৩ সালে সর্বপ্রথম বাংলার সাথে ব্রিটিশ ইস্ট- ইন্ডিয়া কোম্পানির বাণিজ্যিক সম্পর্কের সূচনা ঘটে। ঐ বৎসরের মে মাসে উড়িষ্যার অন্তর্গত হরিহরপুরে ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানি প্রথম বাণিজ্য কুঠি স্থাপন করে।
এর পরে ১৬৫১ সালে হুগলি শহরে ইংরেজদের আরেকটি কুঠি স্থাপিত হয় এবং ঐ বৎসর বাংলার সুবাদার শাহ সুজার নিকট থেকে ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানি বাৎসরিক মাত্র তিন হাজার টাকা রাজস্বের বিনিময়ে বাংলায় বিনা শুক্ষে অবাধ বাণিজ্য করার অধিকার লাভ করে।
অবাধ বাণিজ্য অধিকার লাভ করায় কোম্পানির বাণিজ্যিক আকাঙ্ক্ষা বৃদ্ধি পায়। ফলে কোম্পানি তার বাণিজ্য দ্রুত সম্প্রসারণ করতে থাকে।
১৬৫৮ সালে কাশিমবাজার ও পাটনা, ১৬৬৮ সালে ঢাকা এবং রাজমহল ও মালদহে কোম্পানির বাণিজ্য কুঠি স্থাপিত হয়।
এমনকি ১৬৮০ সাল নাগাদ কোম্পানির বাণিজ্য দেশের সর্বত্র বিস্তার লাভ করে। এ সময় বাংলা থেকে প্রধানত রেশমি, সূতীবস্ত্র, সোড়া, চিনি প্রভৃতি ক্রয় করে কোম্পানি বিদেশে রপ্তানি করতে থাকে।
বাণিজ্যের সূত্র ধরে কোম্পানির রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। ১৬৯৮ সালে কোম্পানি মুঘল সম্রাটের নিকট থেকে বাৎসরিক ১২ হাজার টাকা রাজস্বের বিনিময়ে কলকাতা, সুতানটি ও গোবিন্দপুর এই তিনটি গ্রামের জমিদারী সনদ লাভ করে।
অতঃপর ১৭১৭ সালে মুঘল সম্রাট ফররুখ শিয়ারের নিকট থেকে ফরমান লাভ করে কোম্পানি বাংলায় বাণিজ্যিক কর্মতৎপরতাকে একটি শক্তিশালী ভিত্তির উপর সুপ্রতিষ্ঠিত করার প্রয়াস পায়।
ফরমান অনুযায়ী কোম্পানি বাৎসরিক ৩ হাজার টাকা রাজস্বের বিনিময়ে সমগ্র দেশে বিনাশুল্কে অবাধ বাণিজ্য করার অধিকার লাভ করে, কোম্পানির নৌকা ও জাহাজ স্বাধীনভাবে চলাচলের অনুমতি লাভ করে, মুর্শিদাবাদের টাকশালে কোম্পানি তার নিজস্ব টাকা তৈরির অধিকার লাভ করে এবং অতিরিক্ত ৩৮টি গ্রামের উপর জমিদারী সনদ সহ কোম্পানির অধীনস্থ দেশীয় কর্মচারীদের বিচার করার অধিকার কোম্পানি লাভ করে ।
এভাবে কুঠি স্থাপন ও বাণিজ্য সম্প্রসারণ এবং বিভিন্ন ফরমান লাভের মাধ্যমে কোম্পানি এদেশে বাণিজ্যিক কর্মতৎপরতা বৃদ্ধির পাশাপাশি রাজনৈতিক কর্মতৎপরতা চালাতে থাকে এবং পলাশির যুদ্ধ ও ১৭৬৫ সালের দিউয়ানি লাভের মাধ্যমে একটি বণিক সংঘ থেকে রাজনৈতিক সরকারে কোম্পানির উত্তরণ ঘটে।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, বাংলা ইউরোপীয় বিভিন্ন কোম্পানির বাণিজ্যিক কর্মতৎপরতা ছিল ষোলো শতকের ভৌগোলিক আবিষ্কার ও তৎপ্রসূত বাণিজ্যিক বিপ্লবের ফলশ্রুতি।
তবে বিভিন্ন কোম্পানির মধ্যে একমাত্র ব্রিটিশ ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানিই বাংলায় বাণিজ্যিক কর্মতৎপরতাকে একটি স্থায়ী রূপ দান করে এবং বাণিজ্যিক কর্মতৎপরতার উপর ভিত্তি করেই কালক্রমে ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানি এদেশের ভাগ্য বিধাতা হয়ে উঠেছিল ।