বাংলায় মুঘল আধিপত্য বিস্তারে মীর জুমলার ভূমিকা বিশ্লেষণ কর
বাংলায় মুঘল আধিপত্য বিস্তারে মীর জুমলার ভূমিকা বিশ্লেষণ কর |
বাংলায় মুঘল আধিপত্য বিস্তারে মীর জুমলার ভূমিকা বিশ্লেষণ কর
উত্তর : ভূমিকা : সুবাদার মীর জুমলার বিজয়সমূহ বাংলায় মুঘল শাসনব্যবস্থা ও সাম্রাজ্য সুদৃঢ়ীকরণের ইতিহাসে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা।
সম্রাট শাহজাহানের পুত্রদের মধ্যে সংঘটিত উত্তরাধিকার যুদ্ধের একযুগ সন্ধিক্ষণে সম্রাট আওরঙ্গজেবের সেনাপতি মীর জুমলা বাংলার সুবাদারি লাভ করেন।
সুবাদার হিসেবে অধিষ্ঠিত হয়ে তিনি বাংলার বিভিন্ন অঞ্চল জয় করে তথায় মুঘল শাসন কারেন করেন। সম্রাট আওরঙ্গজেব তাকে খান-ই-খানান ও সিপাহসালার উপাধি প্রদান করেন। সম্রাট তাকে সাতহাজারী মনসবের পুরস্কার প্রদান করেছিলেন।
বাংলায় মুঘল আধিপত্য বিস্তারে মীর জুমলার ভূমিকা : বাংলায় মুঘল আধিপত্য বিস্তারে মীর জুমলার ভূমিকা অপরিসীম। নিয়ে বাংলায় মুঘল আধিপত্য বিস্তারে মীর জুমলার ভূমিকা আলোচনা করা হলো :
১. বাংলায় মুঘল সুবাদার হিসেবে নিয়োগ : সুবাদার মীর বাংলা ভাগ্যান্বেষণে ভারতবর্ষে এসে অতি সাধারণ অবস্থা থেকে স্বীয় মেধা ও যোগ্যতাবলে সম্রাট শাহজাহানের প্রধান উজির পদে নিয়োগ লাভ করেন।
ভ্রাতৃবিরোধকালে আওরঙ্গজেবের পক্ষাবলম্বন করায় আওরঙ্গজেবের কাছ থেকে পুরস্কারস্বরূপ ১৬৬০ খ্রিষ্টাব্দে বাংলার সুবাদার হিসেবে নিযুক্তি লাভ করেন।
২. বিশৃঙ্খলা সমন : মীর জুমলার দায়িত্ব গ্রহণের প্রাক্কালে দেশের শাসনব্যবস্থায় চরম বিশৃঙ্খলা বিরাজ করছিল। সুজার পলায়নের পর বাংলায় মুঘল শাসনের বিরুদ্ধে যে বিদ্রোহ ও বিশৃঙ্খলা দেখা দেয় মীর জুমলা কঠোর হস্তে সে সকল বিদ্রোহ বিশৃঙ্খলা দূর করে বাংলার শান্তি-শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনেন।
৩. কুচবিহার বিজয় : সম্রাট শাহজাহানের পুত্রদের মাঝে উত্তরাধিকারী যুদ্ধের সময় কুচবিহারের রাজা প্রাণনারায়ণ মুঘল সম্রাটের আনুগত্য অস্বীকার করে মুঘল অধিকৃত কামরূপ পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করেন।
উত্তরাধিকার যুদ্ধের অবসানের পর আওরঙ্গজেব ক্ষমতা গ্রহণ করে মীর জুমলাকে বাংলার সুবাদার নিযুক্ত করে কুচবিহারের রাজা প্রাণনারায়ণকে সমুচিত শিক্ষাদানের নির্দেশ প্রদান করেন।
মীর জুমলা ক্ষমতা গ্রহণের পর কুচবিহার ও কামরূপে মুঘল শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য প্রস্তুতি নেন। ১৬৬০ খ্রিষ্টাব্দের ১ নভেম্বর মীর জুমলা ১২,০০০ অশ্বারোহী ৩০,০০০ পদাতিক এবং নৌবাহিনীর বিশাল এক বহর নিয়ে কুচবিহার অভিযান বন।
মীর জুমলার আগমনের সংবাদে প্রাণনারায়ণ রাজধানী থেকে পলায়ন করেন। মীর জুমলা কুচবিহারের রাজধানী দখল করে এর নামকরণ করেন অসীমনগর।
৪. আসাম বিজয় : কুচবিহার অধিকারের পর মীর জুমলা ১৮৬২ সালে আসামে বিজয় অভিযান করেন। দুর্গম পথ অতিক্রম করে তিনি আসামের দিকে অগ্রসর হন। মার্চ মাসে তিনি আসামের রাজধানী ঝাড়গাঁও শহরে এসে উপস্থিত হন।
এতে ভীত হয়ে আসামের রাজা জয়ধ্বজ রাজধানী এবং তার সমস্ত সম্পত্তি ত্যাগ করে পূর্ব পার্বত্য অঞ্চলে পলায়ন করেন। মীর জুমলা অতি সহজেই আসামের রাজধানী দখল করে নেন।
৫. অহোমরাজের সাথে সন্ধি : মীর জুমলা আসাম অভিযানে অহোমদের সমুচিত শিক্ষা নিতে সংকল্প করেন। কিন্তু বর্ষা মৌসুমে মুঘল সৈন্যগণ অত্যন্ত দুঃখ-দুর্দশায় পতিত হয়।
অনেক সৈন্য মারা যান। ফলে অহোম সৈন্যরা বিক্ষিপ্তভাবে মুঘলদের উপর হামলা চালায়। কিন্তু মীর জুমলা স্বীয় মনোবল অটুট রাখেন।
বর্ষা শেষে মুঘল সৈন্যদের অবস্থার উন্নতি হয়। মীর জুমলা সৈন্যদল নিয়ে অহোমরাজার বিরুদ্ধে অগ্রসর হন এবং কয়েকটি স্থান দখল করেন।
অবস্থা বেগতিক দেখে অহোমরাজ মুঘলদের নিকট বশ্যতা স্বীকার করে এবং সন্ধি প্রস্তাব দেন। মীর জুমলা দিলির খানের পরামর্শে অহোমরাজ জয়ধ্বজের সাথে সন্ধি করেন।
৬. জমিদারদের বিরুদ্ধে অভিযান : মুঘলদের উত্তরাধিকার দ্বন্দ্বের সুযোগে যেসব জমিদার মুঘল শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়ে উঠে তারমধ্যে হিজলির জমিদার বাহাদুর খান বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
মীর জুমলা শাসনভার গ্রহণ করেই অবাধ্য জমিদারদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করেন। তিনি হিজলির জমিদার বাহাদুর খানকে ঢাকায় নজরবন্দি করে রাখেন। যুদ্ধের সময় তিনি পালিয়ে হিজলিতে যান এবং মুঘলদের বিরোধিতা করেন।
ফলে মীর জুমলা এবং উড়িষ্যার সুবাদার দু'দিক থেকে হিজলি আক্রমণ করেন। বাহাদুর খান পরাজিত ও বন্দি হয় এবং হিজলিতে মুঘল আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়।
৭. শাসনব্যবস্থায় মুঘলীকরণ : সুবাদার মীর জুমলা মাত্র ৩ বছর শাসনকার্য পরিচালনা করেন। অল্প সময়ের মধ্যে তিনি শাসনব্যবস্থায় মুঘলীকরণ করেন। তিনি স্বয়ং প্রজাদের অভিযোগ শুনতেন এবং প্রতিকারের ব্যবস্থা করতেন।
ন্যায়পরায়ণতা ও সুবিচারের জন্য তিনি খ্যাতি অর্জন করেন। তিনি প্রশাসনকে স্বচ্ছ ও গতিশীল করতে দুর্নীতিপরায়ণ কর্মচারীদের পদচ্যুত করেন।
তার দরবারের লোকজন মুঘল রাজদরবারের আদব-কায়দা অনুকরণ করতো। শাসনকার্য পরিচালনায় তার মৌলিক প্রতিভার পরিচয় পাওয়া যায় ।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, বাংলায় মুঘল আধিপত্য বিস্তারে সুবাদার মীর জুমলা কৃতিত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। তার শাসনামলে সুবা বাংলার প্রশাসনিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও ভৌগোলিক ক্ষেত্রে যথেষ্ট অগ্রগতি হয়েছিল।
তার সুবাদারির বেশিরভাগ সময়ই তিনি আসাম ও কুচবিহার অভিযানে ব্যস্ত ছিলেন। এতদসত্ত্বেও শাসনব্যবস্থার সুষ্ঠু পরিচালনায় এবং প্রজাসাধারণের সুখ-শান্তি বর্ধনে তিনি কৃতিত্বের পরিচয় দেন।
অতি অল্প সময়ে শাসনকার্য পরিচালনায় এবং মুঘল আধিপত্য বিস্তারে তিনি যে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখে গেছেন তা অন্য কোনো সুবাদারের পক্ষে সম্ভব হয়নি।