বাংলার সুবাদার হিসেবে শায়েস্তা খানের কৃতিত্ব মূল্যায়ন কর
বাংলার সুবাদার হিসেবে শায়েস্তা খানের কৃতিত্ব মূল্যায়ন কর |
বাংলার সুবাদার হিসেবে শায়েস্তা খানের কৃতিত্ব মূল্যায়ন কর
- অথবা, সুবাদার শায়েস্তা খানের পরিচয় দাও। তার অবদানসমূহ বর্ণনা কর।
- অথবা, সুবাদার শায়েস্তা খান কে ছিলেন? তার কৃতিত্ব আলোচনা কর ।
উত্তর : ভূমিকা : বাংলায় মুঘল সুবাদারদের মধ্যে সুবাদার শায়েস্তা খান ছিলেন অন্যতম। তিনি দুই পর্বে মোট ২৩ বছর বাংলায় সুবাদার পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন।
রণকৌশলী সেনাপতি ও শ্রেষ্ঠ বিজেতা হিসেবে তিনি বাংলায় ইতিহাসে খ্যাত হয়ে আছেন। তার সময়ে এদেশ সুখ ও শান্তিতে সমৃদ্ধ ছিল।
এদেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির ক্ষেত্রে তার বিশাল অবদান রয়েছে। এজন্যে ঐতিহাসিক জন স্টুয়ার্ট বলেন, “শায়েস্তা খানের স্মৃতি এখন পর্যন্ত এ দেশে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা হয়।
শায়েস্তা খানের পরিচয় : সুবাদার শায়েস্তা খান ছিলেন সম্রাট শাহজাহানের ইতিহাস প্রসিদ্ধ সম্রাজ্ঞী মমতাজ মহলের ভাই ও নূরজাহানের ভ্রাতা আসিফ খানের পুত্র।
প্রথমদিকে তিনি দাক্ষিণাত্যের সুবাদার ছাড়াও মুঘল সম্রাটদের অধীনে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পদে নিযুক্ত ছিলেন। তিনি ১৬৬০ সালে ৬০ বছর বয়সে বাংলার সুবাদার নিযুক্ত হন।
তিনি দুবার ১৬৬৩-৭৮ সাল এবং ১৬৭৯-৮৮ সাল পর্যন্ত মোট ২৩ বছর বাংলায় এ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। এ সময় বাংলার আর্থসামাজিক অবস্থা উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছেছিল।
শায়েস্তা খানের কৃতিত্ব : সুবাদার শায়েস্তা খানের শাসনামল বাংলার ইতিহাসে একটি স্মরণীয় অধ্যায়। একজন শ্রেষ্ঠ বিজেতার পাশাপাশি একজন উদার ও প্রজাহিতৈষী শাসক হিসেবে আজও স্মরণীয় হয়ে আছেন। সমসমায়িক ঐতিহাসিকগণ তার কৃতিত্বের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন।
নিম্নে তার কৃতিত্বসমূহ আলোচনা করা হলো :
১. বিভিন্ন কার্যে বলিষ্ঠ পদক্ষেপ গ্রহণ : সম্রাট আওরঙ্গজের কর্তৃক শায়েস্তা খান বাংলার সুবাদার নিযুক্ত হওয়ার পর অন্যান্য সুযোগ্য কর্মকর্তা এবং তার চার পুত্রের সহযোগিতায় এদেশে শাসনকার্য সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করেন।
তিনি সর্বপ্রথম শাসনব্যবস্থায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধন করেন। তিনি মল ও পর্তুগিজদের দমনের জন্য বাংলার নৌবাহিনীকে পুনর্গঠিত করেন।
দেশের রাজস্ব বৃদ্ধির জন্য তিনি কতিপয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। তিনি আইমাদার ও মদদমাস ভোগীদের সম্পত্তি ফিরিয়ে দেন এবং বৃদ্ধ-ভোগীদের ভাতাদানের ব্যবস্থা করেন।
তিনি বণিক ও ভ্রমণকারীদের উপর কর মাফ করেন এবং শিল্পী, ব্যবসায়ী ও আগন্তকদের ওপর আরোপিত শুভও রহিত করেন।
তার এরূপ উন্নয়নমূলক কাজের জন্য বাংলায় সুখ ও শান্তি ফিরে আসে। দুর্নীতিপরায়ণ কর্মচারীদের বরখাস্ত করে তিনি সৎ কর্মচারী নিয়োগ করে প্রশাসন ব্যবস্থার প্রভূত উন্নতি সাধন করেন।
তিনি মুঘল সম্রাটকে বার্ষিক নির্দিষ্ট কর প্রদান ছাড়াও সাত লাখ টাকা ধার দেন এবং ব্যক্তিগতভাবে নগদ ৩০ লাখ টাকা ও ৪ লাখ টাকা মূল্যের মণিমুক্তা উপহার দেন।
২. কুচবিহার রাজ্যের বিরুদ্ধে অভিযান : পূর্বের সুবাদার মীর জুমলার মৃত্যুর পর কুচবিহার পুনরায় বিদ্রোহ ঘোষণা করলে শায়েস্তা খান বিদ্রোহী শাসনকর্তা প্রাণ নারায়ণের বিরুদ্ধে যুদ্ধের আয়োজন করে।
এতে প্রাণ নারায়ণ ভীত হয়ে সাড়ে পাঁচ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দিয়ে শায়েস্তা খানের বশ্যতা স্বীকার করে।
৩. জয়ন্তিয়া রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ : জয়ন্তিয়ার রাজা পূর্ব প্রতিহত সন্ধি ভঙ্গ করে পুনবার সিলেটে আক্রমণ চালিয়ে লুটতরাজ শুরু করে। এতে শায়েস্তা খান ক্ষিপ্ত হয়ে তার বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করেন এবং ভয়ে রাজা পলায়ন করলে জন্তিয়া মুখ সাম্রাজ্যভুক্ত হয়।
১৬৭৬ সালে শায়েস্তা খান মুরাং অঞ্চলে অভিযা প্রেরণ করলে মুরাং রাজা সহজেই তার বশ্যতা স্বীকার করে।
৪. চট্টগ্রাম বিজয় : মীর জুমলায় মৃত্যুর পর আরাকানের র রাজা চট্টগ্রাম অধিকার করে। শায়েস্তা খান চট্টগ্রাম বিজয়ের জন্য নৌ-সেনাপতি ইবনে হোসেন ও পুত্র বুজুর্গ উমেদ খানকে প্রেরণ করেন।
১৬৬৬ সালে মুঘল বাহিনী আরাকানের নিকট হতে চট্টগ্রাম দখল করেন। ফলে সেখান হতে মগ ও ফিরিঙ্গী দস্যুরা পলায়ন করে।
শায়েস্তা খান চট্টগ্রামের নতুন নামকরণ করেন। ইসলামাবাদ। এরপর তিনি ১৬৬৭ সালে সন্দ্বীপ দখল করেন।
৫. ইংরেজদের দমন : এসময় ইংরেজরা বাংলায় ব্যাপক শক্তিশালী হয়ে ওঠেন। ১৬৭৯ সালে শায়েস্তা খান দ্বিতীয়বার বাংলার সুবাদার হয়ে আসলে ইংরেজদের সাথে তার সংঘর্ষ হয়।
স্থানীয় কর্মচারীদের সাথে অন্যায় আচরণ করলে শায়েস্তা খান তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে ইংরেজরা ১৬৮৮ ও ১৬৮৭ সালে হিজলী আক্রমণ করলে শায়েস্তা খান শেষ পর্যন্ত হিজলী থেকে তাদের বিতাড়ন করেন।
বালাশের হতে ক্যাপ্টেন হীর্ঘ শেষ পর্যন্ত মাদ্রাজে প্রত্যাবর্তন করেন। ফলে বাংলায় ইংরেজদের ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ হয়ে যায়।
অবশ্য পরে সম্রাট আওরঙ্গজেব ইংরেজদেরকে পুনরায় বাংলায় বাণিজ্য করার অনুমতি দেন। ১৬৮৮ সালে বাংলার এই মহান শাসকের মৃত্যু হয়।
৬. শাসক হিসেবে শায়েস্তা খান : শাসক হিসেবে শায়েস্তা খান ছিলেন একজন দক্ষ শাসক। শাহী পরিবারের সাথে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। তার প্রতি মুঘলদের পরিপূর্ণ বিশ্বাসকে তিনি অক্ষুণ্ণ রেখে বিশ্বস্ততার সাথে বাংলায় মুঘল শাসন সুদৃঢ় করেন।
তিনি একজন উদার ও প্রজাহিতৈষী শাসক ছিলেন। কুচবিহারে মুঘল শাসন প্রতিষ্ঠা, চট্টগ্রাম দখল এবং সেখানকার মগ ও ফিরিঙ্গি জলদস্যুদের দমন করে তিনি শাসক হিসেবে শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদার। তি
নি ইংরেজ বণিকদেরও সমুচিত শাস্তি দেন। তার সুশাসনে এদেশ সুখ ও শান্তিতে সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে। ঐতিহাসিক জন স্টুয়ার্ট বলেন, “শায়েস্তা খান উদারতা, ন্যায়পরায়ণতা ও প্রজা কল্যাণের প্রতি দৃষ্টি নিয়ে বাংলা শাসন করেন।"
৭. অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জন : বাংলার অর্থনীতি বিকাশে শায়েস্তা খানের অসামান্য কৃতিত্ব রয়েছে। তিনি বিধবা মহিলা, অভিজাত ব্যক্তিদের লাখেরাজ বা নিষ্কর জমি দান করতেন।
তিনি প্রতি বছর ৫০ হাজার টাকা দান করতেন। সাম্রাজ্যের সর্বত্র তিনি অসংখ্য সরাইখানা, রাস্তা ও সেতু নির্মাণ করেন। তার আমলে দ্রব্যের দাম এত সস্তা ছিল যে, টাকায় আট মন চাল পাওয়া যেত।
এ সময় কৃষি ও শিল্পের ব্যাপক প্রসার ঘটে। এজন্য বিদেশি পর্যটক বার্নিয়ার বলেন, "বিচিত্র পণ্য সম্ভারে তখন এদেশ ভরপুর ছিল। এসব পণ্য সম্ভার বিদেশি বণিকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।”
৮. স্থাপত্য শিল্পের বিকাশ : সুবাদার শায়েস্তা খানের শাসনামল এদেশের স্থাপত্য শিল্পের জন্যেও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি স্থাপত্য শিল্পের একজন উদার পৃষ্ঠপোষক ছিলেন।
তার নির্মিত স্থাপত্য কীর্তির মধ্যে ঢাকার ছোট কাটরা, বড় কাটরা, লালবাগ কেল্লা, পরী বিবির সমাধি, হোসেনি দালান ইত্যাদি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
এজন্যে ঐতিহাসিক ই: জি. ব্রাউনি বলেন, “অন্য কোন সুবাদার বা শাসনকর্তা ঢাকায় শায়েস্তা খানের মত এত বেশি নিদর্শন রেখে যেতে পারেন নি।”
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, বাংলার একজন যোগ্য সুবাদার হিসেবে শায়েস্তা খানের কৃতিত্ব উল্লেখযোগ্য। শায়েস্তা খানের শাসনকাল ছিল বাংলার জন্য একটি গৌরবময় অধ্যায় ।
তিনি তার বিভিন্নমুখী কার্যাবলি ও কৃতিত্বের জন্য স্মরণীয় হয়ে আছেন। তার শাসনকাল ছিল এদেশের জন্য সুখ ও সমৃদ্ধির যুগ।