বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে প্যারেটোর এলিট চক্রাকার তত্ত্বটি আলোচনা কর
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে প্যারেটোর এলিট চক্রাকার তত্ত্বটি আলোচনা কর |
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে প্যারেটোর এলিট চক্রাকার তত্ত্বটি আলোচনা কর
উত্তরঃ ভূমিকা : রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞানের অন্যতম আলোচিত বিষয় হচ্ছে এলিট (Elite)। সামাজিক বিজ্ঞানের আলোচনায় ১৯৩০-৪০ এর মাঝামাঝি সময়ে ইতালীয় সমাজবিজ্ঞানী তিলফ্রেডো প্যারেটো (Vilfredo Pareto) তাঁর অনবদ্য সৃষ্টি "The Mind and Society" গ্রন্থে সর্বপ্রথম এলিটের উল্লেখ করেন।
এলিটরাই রাজনৈতিক ব্যবস্থার অবিচ্ছেদ্য অংশ। পৃথিবীর সকল সমাজব্যবস্থায় এলিটদের উপস্থিতি পরিলক্ষিত হয়।
উন্নত বিশ্বের পাশাপাশি উন্নয়নশীল দেশের রাজনীতিতে এলিটরাই গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তসমূহ গ্রহণ এবং সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠের উপর প্রশাসনিক কর্তৃত্ব কায়েম করে। তাই এলিটরাই আধুনিক সরকার ব্যবস্থার অন্যতম নিয়ন্ত্রক।
এলিট বা আভিজাত্যের সংজ্ঞা : এলিট (Elite) একটি ইংরেজি শব্দ। শাব্দিক অর্থে, এলিট বলতে সমাজের উৎকৃষ্ট শ্রেণিকে বুঝায়। তবে এলিট বলতে সমাজে বসবাসকারী এমন এক গোষ্ঠীকে বুঝায় যারা অধিক বুদ্ধিমত্তা, যোগ্যতা, ক্ষমতা ও প্রতিভার বলে মানসম্মান, প্রভাব-প্রতিপত্তি বিস্তারপূর্বক সমাজের নিম্নশ্রেণিকে নিয়ন্ত্রণ করে। প্রশাসনিক নীতি ও সিদ্ধান্ত প্রণয়ন এবং বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে এলিটদের বিকল্প নেই।
প্রামাণ্য সংজ্ঞা : এলিট সম্পর্কে বিভিন্ন সমাজতত্ত্ববিদ বিভিন্ন সংজ্ঞা প্রদান করেছেন। নিম্নে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য সংজ্ঞা উপস্থাপন করা হলো :
টি. বি. বটোমোর (T.B. Bottomore) এর মতে, “সমাজে উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন যে কোন বৃত্তিমূলক বিশেষকরে পেশাভিত্তিক গোষ্ঠীই এলিট।" (Elites is the functional mainly occupational groups which have high status in a society.)
সি. ডব্লিউ. মিল (C.W. Mills) বলেন, "Who decide whatever is decided of major consequence." এইচ. ডি. ল্যাসওয়েল (H. D. Lasswell ) এর মতে, “যে কোন সুবিধা লাভের অধিকাংশ উপভোগকারী কতিপয় ব্যক্তিই এলিট আর অবশিষ্টরা হচ্ছে সাধারণ লোক।" (The few who get the most of any value are the ; the rest are the rank and file.)
ভি. প্যারেটো (V. Pareto) বলেন, “এলিট গ্রুপ এমন ব্যক্তি সমন্বয়ে গঠিত যারা স্ব-স্ব কর্মক্ষেত্রে সর্বাধিক
রবার্ট মিচেলস (Robert Michels) এর মতে, “সকল রাজনৈতিক দলেই নেতৃত্ব প্রদান করে কতিপয় ব্যক্তি। এ কতিপয় ব্যক্তিই হলেন এলিট।”
গেইটানো মস্কা (G. Moscn) এর মতে, “প্রত্যেক রাজনৈতিক ব্যবস্থায় দুটি শ্রেণি বিদ্যমান। একটি শ্রেণি শাসন করে ও আর এক শ্রেণি শাসিত হয়। প্রথম শ্রেণি যদি রাজনৈতিক কার্যকলাপ সম্পন্ন করে একচেটিয়া ক্ষমতা প্রয়োগ করে তবে তারাই এলিট।"
উপর্যুক্ত সংজ্ঞাগুলোর আলোকে বলা যায় যে, এলিট বলতে সমাজের উচ্চতর শ্রেণিকে বুঝায় যারা তাদের উন্নত চিন্তা চেতনা ও কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে সমাজের নিম্নশ্রেণিকে পরিচালনা করে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে প্যারেটোর এলিট চক্রাকার তত্ত্ব : প্যারেটোর মতানুসারে সমাজের উচ্চতর শ্রেণি দুটি ভাগে বিভক্ত। একটি শাসক এলিট অপরটি অশাসক এলিট।
প্যারেটোর এলিট চক্রকার তত্ত্বের মূলকথা হচ্চে শাসক এলিট এবং অশাসক এলিটদের মধ্যে ক্ষমতার বিবর্তন। প্যারোটো বুঝিয়েছেন যে, ক্ষমতা চিরদিনই শাসক এলিটের হাতে থাকে না।
সময়ের পরিবর্তনের ফলে অশাসনকারী এলিট একসময় ক্ষমতা দখল করে শাসক এলিটের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। শাসক ও অশাসক এলিটের মধ্যে ক্ষমতার এই আবর্তনই প্যারেটোর "এলিট চক্রাকার তত্ত্ব" নামে পরিচিত।
প্যারেটোর এলিট চক্রাকার মতবাদটি প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির রেসিডিউসকে ভিত্তি করে আবর্তিত হয়। এখন আমাদের প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির রেসিডিউস সম্পর্কে ধারণা প্রয়োজন।
প্রথম শ্রেণির রেসিডিউসের অধিকারী হবেন তারা যাদের চিন্তা, উদ্ভাবনী ও কল্পনাশক্তি অন্যদের তুলনায় বেশি। এরা সর্বদাই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে নতুন নতুন উন্নয়ন, পরিবর্তন এবং মার্জিত রীতিনীতি প্রবর্তনে সচেষ্ট থাকে।
এককথায় এরা হলেন আধুনিক ও প্রগতিশীল ধ্যানধারণায় বিশ্বাসী। পক্ষান্তরে, দ্বিতীয় শ্রেণির রেসিডিউসের অধিকারী হলেন তারা যারা মূলত রক্ষণশীলতাকে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চায় এবং আধুনিকতাকে ভয় পায়।
চিন্তা চেতনার দিক থেকে এরা প্রচলিত ধ্যানধারণার উপর বহুলাংশে নির্ভরশীল।প্যারেটোর উপর্যুক্ত মতবাদ অনুযায়ী বাংলাদেশের সমাজকাঠামো বিশ্লেষণ করলে আমরা দেখি যে, বাংলাদেশের সমাজে যেমন- প্রথম শ্রেণির রেসিডিউসের অধিকারীরা বিদ্যমান ঠিক তেমনি ২য় শ্রেণির রেসিডিউসের অধিকারীরাও বিরাজমান ।
প্রথম শ্রেণি সর্বদাই সমাজকে পরিবর্তন করে আধুনিক কাঠামোর রূপদান সচেষ্ট থাকে। এরা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতাকে স্বাগত জানিয়ে পুরাতন জরাজীর্ণ সমাজকাঠামোকে ভেঙে আধুনিক সমাজ গঠনের অগ্রনায়ক।
অপরদিকে দ্বিতীয় শ্রেণির রেসিডিউসের অধিকারীরা পুরাতনকে আঁকড়ে ধরে পরগাছার ন্যায় টিকে থাকে এবং আধুনিকতাকে ভয় পায়।
এরা সর্বদাই পরিবর্তনবিরোধী মানসিকতা নিয়ে নতুনের নিন্দা ও সমালোচনা করে। এরা রক্ষণশীলতার পক্ষে বুদ্ধিবৃত্তিক কাঠামোকে অপরিবর্তনীয় রাখতে চায়।
বিশ্বায়নের এ যুগে তারা সর্বদাই পরাজিত এবং অসামঞ্জস্যপূর্ণ। তারা আধুনিক শিক্ষা, জ্ঞানবিজ্ঞানের চর্চাকে পাশ্চাত্যের অনুকরণ বলে এর বিরোধিতা করে।
প্যারেটোর মতানুসারে, এলিটদের মধ্যে প্রথম ও দ্বিতীয় এ দুই শ্রেণির রেসিডিউ প্রবলহারে বিদ্যমান থাকে। সমাজের গঠন-প্রকৃতির উপর ভিত্তি করে ঐ সমাজে যে কোন একটি রেসিডিউয়ের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়।
বাংলাদেশের সমাজেও প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির রেসিডিউসের লোক বিদ্যমান । তাই প্যারেটোর এলিট তত্ত্ব বাংলাদেশের সমাজব্যবস্থায় যুক্তিযুক্ত।
সমালোচনা : প্যারেটোর এলিট তত্ত্বের সমালোচনাসমূহ নিম্নরূপ :
(i) প্যারেটোর এলিট তত্ত্বটি বিমূর্ত কেননা এতে Residues এবং Derivations এর সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা অনুপস্থিত।
ii. প্যারেটো এলিট আবর্তনের সর্বজনীন কোন সূত্র প্রদান করেন নি।
iii. প্যারেটোর আবর্তন তত্ত্বটি বাস্তব পরীক্ষানিরীক্ষা বিবর্জিত।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, উপর্যুক্ত সমালোচনা সত্ত্বেও প্যারেটোর এলিট আবর্তন এক যুগান্তকারী তত্ত্ব। কেননা তিনিই সর্বপ্রথম শাসক শ্রেণির স্থায়িত্ব সম্পর্কে সন্দেহ পোষণ করে বলেন, যারা শাসন ক্ষমতায় থাকে তারা ক্ষুদ্র কিন্তু শক্তিশালী শ্রেণি ।
তারা চক্রাকারে ক্ষমতায় থাকে এবং তাদের শাসন ক্ষমতা কখনোই স্থায়ী হয় না। প্যারেটো তাঁর এলিটবাদ তত্ত্বে শাসক ও অশাসক এলিটের মধ্যে যে সম্পর্কের কথা বলেছেন তাকে অস্বীকার করার কোন সুযোগ নেই। তাছাড়া বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটেও এলিট তত্ত্বের সার্থকতা বিদ্যমান।