বাংলাদেশের এলিট সম্পর্কে বর্ণনা দাও
বাংলাদেশের এলিট সম্পর্কে বর্ণনা দাও |
বাংলাদেশের এলিট সম্পর্কে বর্ণনা দাও
- অথবা, বাংলাদেশের এলিটদের ইতিহাস বর্ণনা কর।
উত্তর : ভূমিকা : বর্তমান রাজনৈতিক ব্যবস্থায় এলিট (Elite) একটি বহুল আলোচিত বিষয়। যে কোন সমাজের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে এলিটের অস্তিত্ব পরিলক্ষিত হয়।
উন্নত বিশ্বের পাশাপাশি বাংলাদেশের মত উন্নয়নশীল দেশের জন্য এলিট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
বাংলাদেশের ইতিহাসে বিভিন্ন এলিটের অস্তিত্ব পরিলক্ষিত হয়। ১৯৭৫-৯০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে সামরিক এলিটগণ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিল।
এলিট : এলিট (Elite) একটি ইংরেজি শব্দ। এ ইংরেজি শব্দটির অর্থ হল উৎকর্ষে উচ্চতর (Superior)। প্রচলিত অর্থে 'এলিট' বলতে বাছাই করা ব্যক্তিবর্গের শ্রেণি বা সেরা শ্রেণি (Superior class) কে বুঝায়।
ভিলফ্রেডো প্যারেটোই (Vilfredo Pareto) প্রথম সমাজবিজ্ঞানের আলোচনায় এলিট শব্দটি প্রয়োগ করেন। সাধারণত এলিট বলতে সমাজের উচ্চ শ্রেণির ব্যক্তিবর্গের সমষ্টিকে বুঝায় যারা শাসনকার্য পরিচালনা করে ।
বাংলাদেশের এলিট : বাংলাদেশে স্বাধীনতা পূর্ব ও স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন এলিটের অস্তিত্ব পরিলক্ষিত হয়। তবে স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশে এলিটদের ভূমিকা বেশি পরিলক্ষিত হয়।
বাংলাদেশের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে এ সমস্ত এলিটগোষ্ঠী প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ভূমিকা রেখেছে।
বাংলাদেশের উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ক্ষমতা প্রয়োগকারী এলিটদের যদি চিহ্নিত করতে হয় তবে নিম্নে বর্ণিত প্রতিষ্ঠানের মুখ্য কর্মকর্তাদের নাম সর্বাগ্রে উল্লেখ করতে হবে :
১. রাষ্ট্রপতি।
২. উপ-রাষ্ট্রপতি/প্রধানমন্ত্রী।
৩. জাতীয় অর্থনৈতিক কাউন্সিল।
৪. পরিকল্পনা কমিশনের চেয়ারম্যান।
৫. বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সচিবগণ ।
৬. বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কর্পোরেশন, যেমন- বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড, কৃষি উন্নয়ন সংস্থা, শিল্প ঋণ সংস্থা, পানি উন্নয়ন বোর্ড ইত্যাদির মহাপরিচালকগণ ।
৭. বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক।
৮. ডাক্তার।
৯. ইঞ্জিনিয়ার।
১০. আইনজীবী।বাংলাদেশের এলিটদের ইতিহাস : বাংলাদেশ মূলত একটি এলিটভিত্তিক সমাজ। বাংলাদেশ স্বাধীনতাপূর্ব আমল থেকেই বিভিন্ন শাসকগোষ্ঠী বাংলাদেশ তথা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে এলিটের অস্তিত্ব পরিলক্ষিত হয়।
নিম্নে বাংলাদেশে বিভিন্ন সময়ে এলিটদের ইতিহাস বা অস্তিত্ব সম্পর্কে আলোচনা করা হল :
স্বাধীনতা পূর্ববর্তী সময়ে : স্বাধীনতা পূর্ববর্তী সময়ে বাংলাদেশের রাজনীতি অধ্যয়নের ক্ষেত্রে এলিট তত্ত্ব বিশেষভাবে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে দু'টি শ্রেণি বিদ্যমান-এক শ্রেণি শাসন করে এবং অপর শ্রেণি শাসিত হয়। Robert Michels বলেন, "কতিপয় ব্যক্তির শাসন বাংলাদেশের ক্ষেত্রে প্রয়োগযোগ্য।”
তিনি আরও বলেন, "বাংলাদেশ মূলত একপ্রকার এলিট সমাজ, এখানে না আছে অর্থনৈতিক উন্নয়ন, না আছে রাজনৈতিক উন্নয়ন।"
তদুপরি জাতিগঠনের মৌল উপাদানগুলো এখানে স্বাধীনতা পূর্ববর্তী সময়ে তেমন সুসংহত হয় নি। তাছাড়া এখানে রাজনৈতিক অবকাঠামো শক্তিশালী নয়।
কারণ বাংলাদেশে সুষ্ঠু রাজনৈতিক দলের অভাব, সুযোগ্য নেতৃত্বের অভাব, গণতান্ত্রিক পদ্ধতির অভাব, অর্থনৈতিক দুরবস্থা এবং সামরিক হস্তক্ষেপ এর কারণে এলিট শ্রেণি সহজেই ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব কায়েম করতে পেরেছে।
স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে : ১৯৭১ সালে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ পৃথিবীর বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়ায়।
বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকেই রাজনৈতিক প্রতিহিংসা, অস্থিরতা, রাজনৈতিক পরিবর্তন প্রভৃতি ঘটনা একটা সাধারণ বিষয়ে পরিণত হয়।
ফলে বাংলাদেশে রাজনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব হয় নি। স্বাধীনতার পর থেকে শুরু করে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় রাজনৈতিক এলিটগণ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিলেন।
আর সেই সময় থেকেই বাংলাদেশের রাজনীতিতে রাজনৈতিক এলিটের পাশাপাশি অবস্থান করতে থাকে সামরিক ও আমলাতান্ত্রিক এলিটগণ।
একদিকে সামরিক ও আমলাতান্ত্রিক এলিটগণের ভীত শক্তিশালী হতে থাকে অন্যদিকে রাজনৈতিক এলিটদের দূরদর্শিতার অভাবে দেশে বিদ্যমান সমস্যার পরিপ্রেক্ষিতে রাজনৈতিক এলিটদের ভিত বা অস্তিত্ব দুর্বল হতে থাকে।
এমনিভাবে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট এক সামরিক অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে সামরিক এলিটগণ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয় এবং ১৯৯০ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন সামরিক জান্তার হাত ধরে এদেশে সামরিক এলিটগণ তাদের ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব বজায় রাখে।
'৯০ থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত : বাংলাদেশে সামরিক এলিটগণ দীর্ঘকাল ক্ষমতায় টিকে থাকে। এখানে উল্লেখ্য যে, সামরিক এলিটগণ দীর্ঘকাল ধরে ক্ষমতায় থাকলেও প্রকৃতপক্ষে তখন কোয়ালিশন এলিটগণই শাসন পরিচালনা করেন।
১৯৯০ সালের স্বৈরাচার পতন অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে সামরিক এলিটদের পতন ঘটে। এরপর আবার ক্ষমতায় আসে রাজনৈতিক এলিটগণ।
কিন্তু এখানেও প্রকৃতপক্ষে রাজনৈতিক এলিটগণ শাসন পরিচালনা করেন নি। রাজনৈতিক এলিটদের অন্তরালে ছিল আমলাতান্ত্রিক এলিটরা, যা স্পষ্ট হয়ে উঠে পরবর্তী রাজনৈতিক এলিটগণের শাসন পরিচালনার মধ্য দিয়ে।
উপরিউক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে দেখা যায় যে, বাংলাদেশের রাজনীতিতে কখনও একক এলিট শ্রেণি ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিল না, ফলে কোয়ালিশন এলিট সরকার গঠিত নির্বাচন পদ্ধতি অনুসরণ করা হয় এবং পরবর্তীতে ১৯৯৬ সালে দীর্ঘ ২১ বছর আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসে। ১৯৯৬ সালের আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রিপরিষদের তালিকা থেকে এলিটদের অস্তিত্বের একটা ধারণা লাভ করা যায়। যেটা নিম্নে উল্লিখিত হল :
১. সাংগঠনিক আইনজীবী - ২৫%
২. ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার - ৯%
৩. আমলাতন্ত্রী - ৯%
৪. ট্রেড ইউনিয়নের সদস্য - 0%
৫. শিল্পপতি - ২৮%
৬. সামরিক সদস্য - ১৪%
৭. অন্যান্য - ১২%
বর্তমান ২০০৯ সালের জানুয়ারি আওয়ামী 'এলিট শ্রেণি' ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত রয়েছে।
উপসংহার : উপরিউক্ত আলোচনা শেষে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এলিট শ্রেণির অস্তিত্ব সর্বজনীন।
স্বাধীনতা পূর্ববর্তী সময় থেকে পরবর্তী সময়ে এবং বর্তমান সময়েও এলিট শ্রেণির অস্তিত্ব পরিলক্ষিত হয়। তবে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন শ্রেণির এলিটগণ এদেশের রাজনৈতিক ক্ষমতায় তাদের ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব কায়েম করে।
বর্তমানে সামরিক এলিটদের পদচারণা না থাকলেও রাজনৈতিক এলিটগণ তাদের ক্ষমতাকে যথাযথভাবে প্রয়োগ করেছেন।