আধুনিকীকরণের বৈশিষ্ট্য গুলি কি কি । আধুনিকীকরণের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে আলোচনা কর
আধুনিকীকরণের বৈশিষ্ট্য গুলি কি কি । আধুনিকীকরণের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে আলোচনা কর |
আধুনিকীকরণের বৈশিষ্ট্য গুলি কি কি । আধুনিকীকরণের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে আলোচনা কর
- অথবা, আধুনিকায়ন কী কী বিষয়ের সমন্বয়ে গড়ে উঠে সে সম্পর্কে ধারণা দাও।
- অথবা, আধুনিকীকরণের বৈশিষ্ট্যসমূহ আলোচনা কর।
উত্তরঃ ভূমিকা : আধুনিকীকরণ প্রত্যয়টি একদিনের বিষয় নয়। এটা বহুদিন ধরে চলে আসছে। আধুনিকীকরণ সম্পর্কে Benjamin Schwartz বলেছেন, "Systematic sustained and purposeful application of human energies to the rational control of man's physical and social environment for various human purposes." এজন্যই বলা হয় আধুনিকীকরণ এক চিরন্তন ও জটিল বিষয়। আধুনিকীকরণটাই মূলত মুখ্য বিষয় ।
আধুনিকীকরণের বৈশিষ্ট্য (Characteristics of modernization) : আধুনিকীকরণ বা Modernization এর কিছু নিজস্ব বৈশিষ্ট্য রয়েছে। যার আলোকেই সনাতন চিন্তাচেতনা ও সমাজকাঠামো ভেঙে দিয়ে আধুনিকায়ন করা সম্ভব হয়। নিম্নে আধুনিকীকরণের বৈশিষ্ট্য তুলে ধরা হল :
১. যুক্তিনির্ভরশীল (Logical dependency) : আধুনিকীকরণের একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য যুক্তিনির্ভরশীল জ্ঞান । এখানে যুক্তি বিবর্জিত বিষয়ের কোন স্থান নেই। যুক্তিনির্ভরশীল হওয়ার কারণে এটি অপরীক্ষিত জীবন ও চেতনার বিরোধী।
আধুনিকীকরণ মানুষকে যুক্তি নিরিখে সত্যের পথে পরিচালিত করে এবং সামাজিক ও রাজনৈতিক ঘটনাকে বিশ্বাসের পরিবর্তে যুক্তির নিরিখে ব্যাখ্যা করে ।
২. বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি (Scientific views ) : আধুনিকায়ন ঘটাতে হলে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি অর্জন করতে হবে। যৌক্তিকতার নিরিখেই বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির জন্ম।
আধুনিকায়ন মানুষকে ভাগ্য বা ধর্মবিশ্বাস থেকে বের করে নিয়ে এসে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করে।
মানুষকে এমন শিক্ষা দেয়া হয় যেন যে কোন ঘটনাকে পর্যালোচনা করার সময় বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির উপর নির্ভর করে এবং সত্যানুসন্ধানে যুক্তির প্রয়োগ ঘটায় ।
৩. কর্মঠ করে তোলা (To make active ) : আধুনিকায়ন বা আধুনিকতা মানুষকে কর্মঠ হওয়ার শিক্ষা দিয়ে থাকে। কারণ সনাতন সমাজব্যবস্থাতে বিশ্বাসী জনগণ ধর্ম ও ভাগ্যের প্রতি বিশ্বাসী থাকে।
কিন্তু আধুনিকায়ন তার সম্পূর্ণ বিরোধী। আধুনিকতার ধারণায় মানুষ বিশ্বাস করতে শিখে যে সে নিজেই ভাগ্যের পরিচালক, সে চাইলে শ্রম দ্বারা ভাগ্য পরিবর্তন করতে পারে।
আধুনিকায়নের মাধ্যমে মানুষ বিভিন্ন লক্ষ্য সাধনের জন্য পরিবেশের উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপের উদ্দেশ্যমূলকভাবে নিজের ক্ষমতা ও শক্তিকে ব্যবহার করতে শিখে।
৪. বিপ্লব (Revolution) : আধুনিকীকরণকে Intellectual Revolution বলা হয়। কারণ আধুনিকতা অর্জনের নেশায় মানুষ যুগ যুগ ধরে সাধনার মাধ্যমে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নতি করেছে। যার কারণে মানুষের মাঝে সৃজনশীলতা ও নতুন নতুন আবিষ্কারের নেশা ও প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে।
৫. প্রযুক্তির প্রসারতা (Expansion of technology ) : Modernization বা আধুনিকীকরণের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হল ব্যাপক হারে প্রযুক্তির প্রসারতা, প্রযুক্তির উন্নয়নের শিক্ষা দেয় আধুনিকীকরণ।
প্রযুক্তিগত উন্নতির ফলে মানুষ যন্ত্রপাতির আবিষ্কার, কলকারখানার আবিষ্কার ও ক্ষুদ্র কুটির শিল্পের পরিবর্তে আধুনিক শিল্প গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে।
৬. ব্যক্তিস্বাধীনতা নিশ্চিতকরণ (Ensure individual liberty ) : Modemization বা আধুনিকীকরণ ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য্য ও ব্যক্তিকে তার প্রাপ্য স্বাধীনতা প্রদান এবং স্বমর্যাদায় প্রতিষ্ঠা করাকে নৈতিক মূল্যবোধ হিসেবে বিবেচনা করে।
Modernization ব্যক্তিস্বাধীনতা ও সাম্যে বিশ্বাসী। এছাড়া ব্যক্তিগত উদ্যোগকে কঠোর গুরুত্ব দেয়া হয়। Modernization উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার পরিচায়ক।
গণমাধ্যমের সম্পূর্ণ বিকাশ সাধিত হয়েছে Modernization এর মাধ্যমে। আর এজন্য বিশ্ব এখন মানুষের হাতের নাগালে ।
৭. অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের প্রসারতা (Expansion of economic activities ) : Modernization বা আধুনিকীকরণ উন্নত ব্যবস্থার অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের পরিধি বৃদ্ধি করেছে। আধুনিকীকরণের ফলে শিক্ষা, উৎপাদন ও মানুষের আয়ের প্রসারতা নিশ্চিত করে।
Modernization এর মাধ্যমে মানুষের মনস্তাত্ত্বিক গতিশীলতা বৃদ্ধি পায়। আধুনিকীকরণ মানুষকে সচেতন করে তোলে।
৮. সামাজিক পরিবর্তন (Social change ) : Modernization বা আধুনিকীকরণ সামাজিক পরিবর্তনশীলতায় বিশ্বাসী। সমাজের দীর্ঘদিনের চিন্তাচেতনা, রীতিনীতি ও আচার আচরণের পরিবর্তন ঘটায়।
মানুষ আধুনিক যুগোপযোগী সমাজকাঠামো গড়ে তুলতে তৎপর হয়। Modernization বা আধুনিকীকরণ সমাজকে গতিশীল করে তোলে।
৯. ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ (Power decentralization) : Modernization বা আধুনিকীকরণ ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ ঘটায়। এখানে সনাতন পদ্ধতি অনুযায়ী ক্ষমতাকে কেন্দ্রীভূত করে রাখা হয় না।
আধুনিকীকরণ সমাজে বিরাজমান জটিলতা সৃষ্টি ও কর্মপরিধি সম্প্রসারণের সাথে সাথে সুষ্ঠু কর্মসম্পাদনের মানসে কাঠামোগত পৃথকীকরণ ও কর্ম বিশেষীকরণের নীতিকে প্রতিষ্ঠা করে।
১০. সমতার নীতি প্রতিষ্ঠাকরণ (Establish equal policy) : আধুনিকীকরণ বা Modernization সমতার নীতি প্রতিষ্ঠার জন্য জোর দেয়। Modernization একটি সমাজ বা রাষ্ট্রে বিভিন্ন শ্রেণি, গোষ্ঠী, উপগোষ্ঠীর অস্তিত্ব বিদ্যমান।
তাই বৈষম্য নিরসন করে সকল প্রতিষ্ঠান ও সুযোগ সুবিধা গ্রহণের ক্ষেত্রে সমতার নীতি প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আধুনিকীকরণ বলে যোগ্যতার ভিত্তিতে নিয়োগ নীতি চালু করতে হবে।
১১. ধর্মনিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি অর্জন (Achieved secular views ) : Modernization বা আধুনিকীকরণ সর্বদা Secularism বা ধর্মনিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি অর্জনের প্রতি জোর দেয়। আধুনিকীকরণ মানুষকে যুক্তিনির্ভর করে তোলে।
আর যুক্তিনির্ভরতা মানুষকে ধর্মনিরপেক্ষ হিসেবে গড়ে তোলে। রাষ্ট্রীয় ও প্রশাসনিক ক্ষেত্রে মর্যাদা, ভূমিকা বা সম্পর্ক ও অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে আধুনিকতা ধর্মনিরপেক্ষ মূল্যবোধের উপর গুরুত্বারোপ করে।
১২. জীবনযাত্রার মানের বিকাশ : আধুনিকায়ন প্রক্রিয়া অনেকটা নির্ভর করে জীবনযাত্রার মানের উপর। যে দেশের জীবনযাত্রার মান যত বেশি আধুনিক ও উন্নত সে দেশের আধুনিকায়ন প্রক্রিয়া তত বেশি দ্রুততর ও কার্যকর হয়।
পাশ্চাত্যে অধিকাংশ রাষ্ট্রের জীবনযাত্রার মান উন্নত বিধায় তাদের আধুনিকায়ন প্রক্রিয়া তত বেশি দ্রুততর করা সম্ভব হয়েছে।
১৩. রাজনৈতিক গতিশীলতা (Political mobility) : আধুনিকীকরণের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে রাজনৈতিক গতিশীলতা। যে সমস্ত রাষ্ট্রের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো সক্রিয়, সে রাষ্ট্র উন্নয়নের দিকে মাত্রায় ক্রিয়াশীল। তাছাড়া রাজনৈতিক অংশগ্রহণ ছাড়া আধুনিকীকরণের ধারণা পরিপূর্ণভাবে বিকশিত হয় না।
উপসংহার : উপরিউক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, Modernization বা আধুনিকীকরণ ধারণা প্রতিটি রাষ্ট্রের উন্নয়নে একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
আর প্রকৃতপক্ষে আধুনিকায়ন ছাড়া সামগ্রিক উন্নয়ন সম্ভব হয় না। সেজন্য রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের মাধ্যমে প্রকৃত আধুনিকীকরণ অর্জন করার জন্য সকলকে সচেষ্ট থাকতে হবে।
S. P. Huntington Political Order in Changing Societies a, "Modernization is many sided process involving changes in all aspects of human thought and activity."