আধুনিকীকরণের বাহন কী কী । আধুনিকীকরণের বাহনসমূহ আলোচনা কর
আধুনিকীকরণের বাহন কী কী । আধুনিকীকরণের বাহনসমূহ আলোচনা কর |
আধুনিকীকরণের বাহন কী কী । আধুনিকীকরণের বাহনসমূহ আলোচনা কর
উত্তরঃ ভূমিকা : আধুনিকীকরণের সুবিন্যস্ত ও ধারাবাহিক অধ্যয়ন একটি নতুন বিষয়। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর ঔপনিবেশিকতার অবসানের সাথে সাথে এর উদ্ভব হয়েছে। আধুনিকীকরণ হল একটি প্রক্রিয়া, যার দ্বারা পা সম্পদসমূহের যুক্তিযুক্ত সদ্ব্যবহার করা হয়।
এর মূল লক্ষ্য হচ্ছে আধুনিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করা এবং ভবিষ্যৎ সম্পদের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা। এককথায় আধুনিক হওয়ার প্রক্রিয়াকে আধুনিকীকরণ বলে।
আধুনিকীকরণের বাহন (Agent or media of modernization) : আধুনিকীকরণের জন্য সামাজিক, অর্থনৈতিক, মনস্তাত্ত্বিক ক্ষেত্রেও সমভাবে পরিবর্তন সাধন অত্যাবশ্যক। নিম্নে আধুনিকীকরণের বাহনগুলো সম্পর্কে আলোচনা করা হল :
১. বুদ্ধিজীবী শ্রেণি (Intellectual class) : বুদ্ধিজীবী শ্রেণি রাজনৈতিক আধুনিকীকরণ প্রক্রিয়ায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কারণ বুদ্ধিজীবীরা সংস্কারমুক্ত এবং স্বাধীন চিন্তার অনুসারী এবং পাশ্চাত্য শিক্ষা, আদর্শ ও ভাবধারার সাথে অতি পরিচিত।
তাছাড়া বহির্বিশ্বের সাথে তারা যোগাযোগ রক্ষা করে চলেন। বুদ্ধিজীবীরা আধুনিক বিশ্বের সর্বশেষ পরিস্থিতি সম্বন্ধে খোঁজখবর রাখতে প্রয়াসী কারণ তারা যুক্তি ও বিজ্ঞানে বিশ্বাসী।
ফলে বুদ্ধিজীবীরা তাদের লব্ধ জ্ঞান, দক্ষতা ও কলাকৌশলসমূহের সদ্ব্যবহার করে দেশের রাজনৈতিক আধুনিকীকরণ এবং উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয়।
২. যুব সম্প্রদায় (Youth community) : আধুনিকীকরণ প্রক্রিয়া যুব সম্প্রদায়ের উপর বহুলাংশে নির্ভরশীল। কেননা এ গোষ্ঠীর সদস্যগণ আধুনিক ভূমিকা গ্রহণে সর্বাপেক্ষা অধিক আগ্রহী হয়।
রাজনৈতিক আধুনিকীকরণ হল- পরিবর্তন ও উন্নয়নের এক দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া। এ প্রক্রিয়ায় অনেক সময় প্রচলিত ভাবাদর্শ ও মূল্যবোধকে প্রতিষ্ঠা করতে হয়।
প্রবীণগণ সাধারণ রক্ষণশীল মনোভাব পোষণ করেন এবং তাঁরা এসব পরিবর্তন বা সংস্কারের সাথে নিজেদেরকে খাপখাওয়াতে পারে না।
এক্ষেত্রে তরুণ ছাত্র সম্প্রদায় উন্নত বক্ষে এগিয়ে আসে এবং এসব নতুন নতুন ভাবাদর্শ ও মূল্যবোধকে প্রতিষ্ঠা ও সযত্নে লালন করে রাজনৈতিক আধুনিকীকরণের গতিকে সচল রাখে।
৩. আমলাতন্ত্র (Bureaucracy) : শাসক ও শাসিতের মধ্যে যোগাযোগ, সরকারি সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়ন, প্রশাসন পরিচালনা প্রভৃতি বিষয়ে আমলাতন্ত্র গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
আমলাতন্ত্র সরকারি নীতিমালা বাস্তবায়নের মাধ্যমে জনগণের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিকাশ ঘটায়। কাজেই আধুনিকীকরণের ক্ষেত্রে আমলাতন্ত্রের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
৪. শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান (Educational institution) : স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, বিভিন্ন প্রকৌশল ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান প্রভৃতি মানুষকে বিশেষ করে নবীনদেরকে নানা বিষয়ে আধুনিক জ্ঞান দান করে থাকে।
এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে মানুষ সর্বশেষ আবিষ্কার ও কলাকৌশল সম্বন্ধে জ্ঞাত হয়। তাই রাজনৈতিক আধুনিকীকরণের ক্ষেত্রে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভূমিকা অপরিসীম।
৫. জনগণের অংশগ্রহণ (Peoples participation) : আধুনিকীকরণের জন্য জনগণ দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে দেশের স্বার্থে যে কোন ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত থাকে। তারা আধুনিকীকরণ সম্পর্কে সচেতন এবং রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণ করে।
৬. রাজনৈতিক দল - (Political party) : রাজনৈতিক দলগুলো তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশের রাজনৈতিক আধুনিকীকরণের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশগুলোতে যেসব সমস্যা পরিলক্ষিত হতো তা মোকাবিলা করতে জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক দল এগিয়ে আসত।
এদল পরিবর্তিত অবস্থার প্রেক্ষিতে নতুন নতুন আদর্শ ও মূল্যবোধ প্রচার করে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে উদ্যম ও প্রেরণা যোগায়।
এভাবে জাতীয় জীবনে জাগরণ ও প্রাণচাঞ্চল্য সৃষ্টি করে রাজনৈতিক আধুনিকীকরণের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে ।
৭. উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা (Developed communication system) : উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা রাজনৈতিক আধুনিকীকরণের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম।
কেননা যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হলে তথ্য ও পণ্য দ্রব্য আমদানি রপ্তানি করা সহজ হয় এবং দেশ দ্রুত উন্নয়ন তথা আধুনিকীকরণের দিকে ধাবিত হয়।
উন্নত বিশ্বের দেশগুলোর আধুনিকীকরণের পিছনে তাদের উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে
৮. গণমাধ্যম (Mass-media) : একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থার কার্যাবলি সুচারুরূপে সম্পাদনের জন্য রাজনৈতিক যোগাযোগ একান্ত প্রয়োজন। এ যোগাযোগ কার্য সম্পাদনের ক্ষেত্রে গণমাধ্যমগুলোর ভূমিকা অপরিহার্য।
কেননা বেতার, টেলিভিশন, সংবাদপত্র প্রতিনিয়ত নতুন তত্ত্ব ও তথ্য সরবরাহ করছে এবং সরকারের পরিকল্পনা ও কর্মপন্থা জনগণের নিকট তুলে ধরছে।
ফলে একটি দেশের রাজনৈতিক আধুনিকীকরণে সরকারের সাথে জনগণের সম্পর্ক স্থাপিত হচ্ছে। অন্যদিকে, জনগণকে আধুনিক জীবনের বিভিন্ন দিক সম্বন্ধে অবগত করা সম্ভব নয়।
৯. নগরায়ন (Urbanization) : আধুনিকীকরণের একটি অন্যতম বাহন হল নগরায়ন যোগাযোগ ও পরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়ন, বিদ্যুতায়ন, শিল্পায়ন ও শিক্ষা সংস্কৃতির উন্নতি।
সর্বোপরি জনগণের মধ্যে রাজনৈতিক প্রজ্ঞার উল্লেখ একমাত্র নগরায়নের মাধ্যমেই সম্ভব। এটি এমন একটি মাধ্যম যা সমাজ বা রাষ্ট্রকে দ্রুত আধুনিকীকরণের পথে এগিয়ে নিয়ে যায়।
১০. শিল্পায়ন (Industrialization) : আধুনিকীকরণের আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বাহন হল শিল্পায়ন। কেননা আধুনিকীকরণের মূল শক্তি নিহিত অর্থনৈতিক উন্নয়নের মধ্যে।
আর অর্থনৈতিক উন্নয়ন হচ্ছে শিল্পায়ন। শিল্পায়নের ফলে কারখানার প্রসার লাভ করে এবং উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। এটি জাতীয় অর্থনীতিকে শক্তিশালী করে বলে আধুনিকীকরণ সম্ভব হয়।
১১. গণতন্ত্রায়ন : আধুনিক রাজনৈতিক ব্যবস্থার আধুনিকীকরণের ক্ষেত্রে গণতন্ত্রায়ন অন্যতম পূর্বশর্ত । বিশেষ করে গণতন্ত্রায়ন ছাড়া আধুনিকীকরণের পরিপূর্ণতা আসে না। গণতন্ত্রায়ন আধুনিকীকরণ ক্ষেত্রে জনগণকে জাগরিত করে।.
১২. রাজনৈতিক গতিশীলতা : আধুনিকীকরণের অন্যতম বাহন হচ্ছে রাজনৈতিক গতিশীলতা (Political mobility)। আধুনিকীকরণের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক গতিশীলতা অন্যতম পূর্বশর্ত।
বিশেষ করে যেসব রাষ্ট্র রাজনৈতিকভাবে গতিশীল নয় সেসব রাষ্ট্র আধুনিকীকরণের ক্ষেত্রে অনেক পিছিয়ে পড়েছে।
১৩. অর্থনৈতিক উন্নয়ন : আধুনিকীকরণের ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক উন্নয়ন অন্যতম পূর্বশর্ত। বিশেষত যে সমস্ত রাষ্ট্র অর্থনৈতিকভাবে উন্নত ও সুসংগঠিত, সেই সমস্ত রাষ্ট্রগুলো রাজনৈতিক আধুনিকীকরণের ক্ষেত্রে অনেকটা এগিয়ে।
উপসংহার : উপরিউক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, একটি সমাজের মূল লক্ষ্য থাকে আধুনিকীকরণের দিকে এগিয়ে যাওয়া।
আর এক্ষেত্রে আলোচিত বাহনগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কিন্তু রাজনৈতিক আধুনিকীকরণ একটা দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া। কাজেই আলোচিত বাহনগুলো চূড়ান্ত ও সম্পূর্ণ নয়।
আধুনিকীকরণ প্রক্রিয়ার বিভিন্ন স্তরে আরও অনেক বাহনের আবির্ভাব ঘটতে পারে। সুতরাং আধুনিকীকরণ ধারণাটি প্রকৃতপক্ষে আপেক্ষিক, চূড়ান্ত নয় ।