আধুনিকতার কারণে ঔপনিবেশিকতার বিকাশ ঘটে মিশেল ফুকো আলোচনা কর
আধুনিকতার কারণে ঔপনিবেশিকতার বিকাশ ঘটে মিশেল ফুকো আলোচনা কর |
আধুনিকতার কারণে ঔপনিবেশিকতার বিকাশ ঘটে মিশেল ফুকো আলোচনা কর
- অথবা, “উন্নয়নশীল দেশ আধুনিকায়ন ঘটার মধ্যে নতুন করে ঔপনিবেশিকতার জন্য দেয়”- মিশেল ফুকো ।
- অথবা, আধুনিকতা ঔপনিবেশিকতার জন্য দেয়-মিশেল ফুকো ।
উত্তরঃ ভূমিকা : Modernization বা আধুনিকায়ন একটা সময়ের দাবি। যুগের সাথে সামঞ্জস্য রেখে চলার জন্য যুগোপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণ একান্ত কাম্য।
কিন্তু আধুনিকতার নেতিবাচক প্রভাব রাষ্ট্র ও সমাজজীবনে ধ্বংসাত্মক রূপও নিয়ে থাকে। মিশেল ফুকো আধুনিকতার আড়ালে ঔপনিবেশিকতা চর্চা বলে অভিহিত করেছেন।
মূলত আধুনিকায়ন হওয়া উচিত জনগণের কল্যাণার্থে এর অপপ্রয়োগ কখনও সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতি ইতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করতে হবে।
আধুনিকীকরণ (Modernisation) : আধুনিকতার ধারণাটি মূলত সামাজিক বিজ্ঞান হতে নেয়া হয়েছে। সামাজিক পরিবর্তনের ধারণার উপরই আধুনিকীকরণের ধারণা আলোচিত হয়।
সাধারণভাবে বলতে গেলে কোন রাজনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যে কতকগুলো সমৃদ্ধি অর্জন করতে সহায়তা করে। নব্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত রাষ্ট্রগুলোতে আধুনিকীকরণ একটি আন্দোলন বা বিপ্লব হিসেবে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে।
এসব রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তনকে আধুনিকীকরণ বিপ্লবের অংশ হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে।
আধুনিকতায় ঔপনিবেশিকতার কারণ (Causes of colonialism in modernization) : Modernization বা আধুনিকতা ঔপনিবেশিকতার কারণ বলে উল্লেখ করেছে ফুকো।
ফুকো আধুনিকতা অনুসরণ করতে গিয়ে বা চর্চা করতে গিয়ে উন্নয়নশীল দেশের জনসমষ্টি যে ঔপনিবেশিকতার বেড়াজালে জড়িয়ে পড়ছে তাই ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন ।
নিম্নে এর পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করা হল :
১. পাশ্চাত্য শিক্ষা গ্রহণ (Accept western education) : উন্নয়নশীল দেশের শিক্ষার মান উন্নয়নে Western. education বা পশ্চিমা ধাঁচের শিক্ষাব্যবস্থাকে অনুসরণ করা হয়। পশ্চিমা শিক্ষা পদ্ধতি আধুনিক ও যুগোপযোগী।
তাই সে পদ্ধতি অনুসরণ ও বাস্তবায়নে নানা ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের কারিকুলাম বিদেশী পদ্ধতিতে নির্ধারণ করা হয়, আবার বিদেশ থেকে ডিগ্রি আনা হয়।
সবকিছু মিলিয়ে দেখা যায়, উন্নয়নশীল দেশগুলো আধুনিকতার ছোঁয়া পায় যতটুকু তার চেয়ে বেশি জড়িয়ে পড়ে পরোক্ষভাবে বিদেশী ঔপনিবেশিকতার বেড়াজালে। তাই মিশেল ফুকো বলেছেন, আধুনিকতাই ঔপনিবেশিকতার কারণ।
২. বিদেশী সংস্কৃতি অনুসরণ (Follow foreign culture) : উন্নয়নশীল দেশগুলো আধুনিক ও উন্নত হওয়ার জন্য পশ্চিমা ধাঁচের আধুনিক সংস্কৃতি অনুসরণ, অনুকরণের চেষ্টা করে।
প্রযুক্তির কল্যাণে স্যাটেলাইটের মাধ্যমে বিদেশী সংস্কৃতি, সভ্যতা জীবনযাপন পদ্ধতি রপ্ত করার চেষ্টা করা হয়। তাছাড়া উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণের জন্য বিদেশ যাওয়ার ফলে সেখানকার সংস্কৃতির সাথে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে।
যেমন- বর্তমান সময়ে যৌথ পরিবার ভেঙে যে একক পরিবার ব্যবস্থার রীতি চালু হয়েছে এটা সম্পূর্ণ পশ্চিমা সংস্কৃতির প্রভাব।
আর এভাবেই আধুনিকতার ছোঁয়া পেতে গিয়ে তাদের সংস্কৃতি ও সভ্যতার সাথে জড়িয়ে পড়া মানে ঔপনিবেশিকতার বেড়াজালে পরোক্ষভাবে জড়িয়ে পড়া।
৩. রাজনৈতিক আধুনিকীকরণ নীতি গ্রহণ (Accept political modernization policy) : রাজনৈতিক আধুনিকীকরণ বা Political modernization ঘটাতে গিয়ে উন্নত বিশ্বের রাজনৈতিক রীতি পদ্ধতি অনুসরণ ও তাদের নীতি গ্রহণের ফলে দেখা যায় বিদেশী রাজনৈতিক যোদ্ধারা রাজনৈতিক উপদেশ দিতে গিয়ে তাদের দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি অনুকরণ ও বাস্তবায়নের পরামর্শ দেয়।
আর ঐ ধরনের পরামর্শ গ্রহণের ফলে সেখানে তাদের আধিপত্য বিস্তারের সুযোগ ঘটে, যা ঔপনিবেশিক শাসনে রূপ নেয়। এজন্যই মিশেল ফুকো বলেছেন আধুনিকায়ন ঔপনিবেশিকতার কারণ।
৪. বাণিজ্যিক সম্প্রসারণ নীতি (Expansion of commercial policy) : GATT এর পরিবর্তে যে WTO বা World Trade Organization' এর গোঁড়াপত্তন ঘটেছে সেখানে মুক্ত বাণিজ্য নীতি গ্রহণ করা হয়েছে।
মুক্ত বাণিজ্য নীতির মাধ্যমে উন্নয়নশীল রাষ্ট্রগুলোকে আধুনিক ও যুগোপযোগী বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে বলা হয়েছে।
তাই WTO এর সদস্য লাভকারী উন্নয়নশীল রাষ্ট্র তাদের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নয়নের জন্য চেষ্টা চালাচ্ছে।
কিন্তু দেখা যাচ্ছে WTO এর বিভিন্ন সম্মেলনে যেসব সিদ্ধান্ত ও নীতি গ্রহণ করা হয়েছে তার সিংহভাগই উন্নত দেশগুলোর বাণিজ্যিক সম্প্রসারণের সহায়ক ও উন্নয়নশীল রাষ্ট্রে বহুজাতিক কোম্পানি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আধিপত্য বিস্তারের অনুকূল।
এজন্য বলা যায় যে, উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের ভাগ্যে প্রকৃতপক্ষে কোন উন্নতি ঘটে না, বরং তারা পরোক্ষভাবে শোষণ, বঞ্চনা ও ঔপনিবেশিক শাসনের নাগপাশে আবদ্ধ হয় ।
৫. বৈদেশিক নীতি (Foreign policy) : বৈদেশিক নীতি বা Foreign policy গ্রহণ করা হয় যে কোন দেশের জাতীয় স্বার্থকে রক্ষা করে বৈদেশিক রাষ্ট্রের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার জন্য, পারস্পরিক সাহায্য সহযোগিতার জন্য।
কিন্তু দেখা যায় উন্নয়নশীল ও অপেক্ষাকৃত দুর্বল রাষ্ট্রের যে বৈদেশিক নীতি গ্রহণ করা হয় তা দ্বারা তার জাতীয় স্বার্থ ও স্বকীয়তা খুব কম অক্ষুণ্ণ থাকে।
পার্শ্ববর্তী অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী রাষ্ট্র তার অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের সুযোগ খুঁজে এবং নিজস্ব আধিপত্য বজায় রাখার চেষ্টা চালায়, আর এভাবেই জন্ম হয় নতুন ঔপনিবেশিকতার। এজন্য মিশেল ফুকোর উক্তিটি যথোপযুক্ত।
৬. বৈদেশিক সাহায্য (Foreign aid): বৈদেশিক সাহায্য গ্রহণের মাধ্যমে উন্নয়নশীল রাষ্ট্রগুলো তাদের সার্বিক অবস্থার উন্নয়নের চেষ্টা চালায়। এর ফলে উন্নয়নশীল রাষ্ট্রগুলো আধুনিকতার ছোঁয়া পায়।
কিন্তু যতটুকু আধুনিক ও উন্নত হয় তার চেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যেমন- খাদ্য সাহায্য প্রদানের নামে নষ্ট, পঁচা, মেয়াদ উত্তীর্ণ খাদ্য সরবরাহ করে প্রচুর পরিমাণে অর্থ হাতিয়ে নেয়।
পণ্য সাহায্যের শর্ত হিসেবে নিজেদের বাজার সৃষ্টির মাধ্যমে Market dumping করা হয়। আবার প্রকল্প সাদৃশ্যের নামে প্রদেয় অর্থের সিংহভাগ নিজ দেশে ফিরিয়ে নেয়া হয়, যা আধুনিকীকরণে সাহায্যের নামে ঔপনিবেশিকতার বেড়াজালে আবদ্ধ করে।
৭. প্রযুক্তি ব্যবহার ও অভিজ্ঞ লোক নিয়োগ (Use technology and appointment expert people) : আধুনিক যুগে আধুনিকায়ন ঘটাতে হলে সর্বত্র আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করা জরুরি।
আর উন্নয়নশীল রাষ্ট্রগুলো অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল থাকায় সর্বত্র প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিতকরণ কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে।
সেজন্য উন্নত রাষ্ট্র থেকে তারা সাহায্য হিসেবে কলকারখানা ও অন্যান্য ক্ষেত্রে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করে।
আর উন্নত রাষ্ট্রগুলো তাদের প্রযুক্তি প্রদানের পাশাপাশি প্রযুক্তি অভিজ্ঞদেরও প্রেরণ করে। এতে দেশীয় প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞদের মর্যাদা কমে যায় এবং বিদেশীদের আধিপত্য বিস্তারের সুযোগ ঘটে।
৮. মানব সম্পদ পাচার (Dispatch human resources) : দ্বিপাক্ষিক চুক্তির শর্ত হিসেবে উন্নয়নশীল রাষ্ট্রগুলো বিদেশে মানব সম্পদ পাচার করে। এতে উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের মেধাবী ও দক্ষ জনবল আর্থিক সুবিধা পাওয়া ও সামাজিক মর্যাদা প্রাপ্তির লোভে বিদেশে পাড়ি জমায়।
এভাবে উন্নত রাষ্ট্রগুলো দ্বিপাক্ষিক চুক্তির কৌশল হিসেবে সস্তা শ্রমমূল্যে মেধা কিনে নেয়। আর উন্নয়নশীল রাষ্ট্রগুলো পরনির্ভরশীল হয়ে পড়ে অতিমাত্রায়, যা তাদের ঔপনিবেশিক শাসন প্রতিষ্ঠার সহায়ক।
৯. বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন ( Alleniated movement) : আধুনিক প্রযুক্তির কল্যাণে স্যাটেলাইটের মাধ্যমে বিশ্বের প্রত্যেকটি রাষ্ট্রের জনগণ রাষ্ট্রীয় পদ্ধতি, জাতীয়তাবাদ, রাজনৈতিক চেতনা, দাবিদাওয়া সম্পর্কে অবহিত হতে পারছে।
এর ফলে নেতিবাচক প্রভাব হিসেবে দেখা যায় প্রত্যেক রাষ্ট্রে বসবাসকারী সংখালঘু শ্রেণী বিভিন্ন দাবির প্রেক্ষিতে যে আন্দোলন সংগ্রামের পথ বেছে নেয় তা পারস্পরিক দেখাশোনার সুযোগে আরও বেশি কৌশলী হয়ে উঠে এবং উন্নত রাষ্ট্রগুলো তাদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার কৌশল হিসেবে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের অর্থ ও অস্ত্র দিয়ে সহযোগিতা করে থাকে, যা আধুনিকতার নেতিবাচক প্রভাব হিসেবে ঔপনিবেশিকতার সূচনা হয়।
১০. সামাজিক শ্রেণীর বিকাশ ও দ্বন্দ্ব (Development and conflict of social class) : আধুনিকতার ইতিবাচক দিকের পাশাপাশি অনেক নেতিবাচক দিকও রয়েছে। যেমন- বিশ্ববাণিজ্য সম্প্রসারণ ও পুঁজিবাদের বিকাশের মাধ্যমে সমাজে পুঁজিপতি শ্রেণীর জন্যলাভ হয়।
সমাজ বিভক্ত হয়ে গেছে ধনী ও গরিব দু'টি শ্রেণীতে। এর ফলে শোষক ও শোষিতের মাঝে দ্বন্দ্বময় সম্পর্ক গড়ে উঠে, যা ঔপনিবেশিকতার ধ্বংসাত্মক রূপ হিসেবে বিবেচিত। এজন্যই মিশেল ফুকো বলেছেন, আধুনিকতার জন্যই ঔপনিবেশিকতার বিকাশ ঘটে।
উপসংহার : উপরিউক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে আধুনিকতার কারণে বা প্রভাবে অনেক দেশে বিশেষ করে উন্নয়নশীল বা অনুন্নত দেশে ঔপনিবেশকতার বিকাশ ঘটে।
কেননা উন্নয়নশীল রাষ্ট্রগুলো সর্বদা পরমুখাপেক্ষী থাকে যে কারণে তারা আধুনিকতার প্রকৃত ছোঁয়া থেকে বঞ্চিত হয়।
আর আধুনিকতা থেকেই ঔপনিবেশিকতার ধারণা জন্ম নেয়। এজন্য বিশিষ্ট মনীষী মিশেল ফুকো বলেছেন, "আধুনিকতা ঔপনিবেশিকতার জন্য দেয়।”