সুলতানি আমলে বাংলার রাজনীতিতে সুফিদের ভূমিকা আলোচনা কর

সুলতানি আমলে বাংলার রাজনীতিতে সুফিদের ভূমিকা আলোচনা কর
সুলতানি আমলে বাংলার রাজনীতিতে সুফিদের ভূমিকা আলোচনা কর

সুলতানি আমলে বাংলার রাজনীতিতে সুফিদের ভূমিকা আলোচনা কর

  • অথবা, নূর কুতুব-উল-আলমের উল্লেখপূর্বক সুলতানী বাংলার রাজনীতিতে সুফিদের ভূমিকা আলোচনা কর।

উত্তর: ভূমিকা : মধ্যযুগে বাংলার ইতিহাসে সুলতানি আ একটি বিশিষ্ট স্থান দখল করে আছে। এ বংশের সুলতানগণ (১৩৩৮-১৫৫৮) খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত প্রায় দুইশত বছর স্বাধীনভাবে বাংলা শাসন করেন। 

এই সময় বাংলা সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রভৃতি দিক থেকে বাংলা উন্নতি লাভ করে। স্বাধীন সুলতানদের সময়ে বাংলার সুফিদের আগমন ঘটেছিল। আর সুফিরা মধ্যযুগে বাংলার রাজনীতিতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

নূর-কুতুব-উল-আলমের পরিচয় : নূর-কুতুব-উল-আলম ছিলেন মধ্যযুগে বাংলার একজন দরবেশ। পান্ডুয়ার পীর আউলিয়াদের মধ্যে তিনি সবচেয়ে বেশি মর্যাদার অধিকারি ছিলেন। 

ভার পিতা শেখ আলাউল হকও একজন পীর ছিলেন। পিতার মতো নূর-কুতুব-উল-আলম ছিলেন চিশতিয়া তরিকার পীর। নূর-কুতুব- উল আলম সব ধরনের কায়িক শ্রম করতেন। 

দরগায় আগত ফকিরদের সেবা ডিনি ব্যক্তিগতভাবে করতেন। তার পুত্র শেখ রক্ষকাতউদ্দিন, শেখ আনোয়ার তার কাছে আধ্যাত্বিক শিক্ষালাভ করেছিলেন। 

শেখ রাফকাতউদ্দিনের পুত্র শেখ জাহিদও দরবেশ হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। শেখ হুসামউদ্দিন মানিকপুরী ছিলেন নূর-কুতুব-উল-আলমের অন্যতম প্রধান মুরিদ।

বাংলায় ইসলাম প্রচারে নূর-কুতুব-উল-আলমের ভূমিকা ও কার্যাবলি : দরবেশ নূর-কুতুব-উল-আলম মধ্যযুগে বাংলায় ইসলাম প্রসারে অসামান্য অবদান রাখেন। তাঁর সময় মুসলমানদের মধ্যে যখন কোনো সমস্যা দেখা দিত, তিনি ভা থেকে তাদেরকে রক্ষা করার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করতেন।

নূর-কুতুব-উল-আলম বাংলায় ইসলাম প্রসারের ফলে ইসলাম ধর্মের অনুসারী মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছিল। ঠিক এমন সময় ইলিয়াসশাহী সুলতানদের দুর্বলতার সুযোগে রাজা গদেশের আবির্ভাব ঘটে।

তিনি বাংলা হিন্দু রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করার জন্য বিশেষ করে ওলামা ও শেখদের উপর অত্যাচার আরম্ভ করেন। যার ফলে মুসলিম রাষ্ট্র ও সমাজ এক বিরাট বিপদের সম্মুখীন হয়। 

রাজা গণেশের হাত থেকে মুসলিম রাষ্ট্রকে রক্ষার জন্য নূর-কুতুব-উল-আলম মুঘলমানদের মধ্যে ঐক্য স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন। 

হিন্দু রাজার অত্যাচারে ইসলাম কিন্তু হয়ে পড়ার সুফি নূর কুতুব-উল-আলম শঙ্কিত হয়ে পড়েন এবং জৌনপুরের শাসনকর্তা ইব্রাহিম শর্কির সাহায্য প্রার্থনা করেন। 

ইব্রাহিম শর্কির অভিযানে রাজা গণেশ নূর-কুতুব-উল- আলমের নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করেন। নূর-কুতুব-উল-আলম সকল বাধা বিপত্তি দূর করে বাংলায় ইসলাম প্রসারে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন।

সুলতানি আমলে বাংলার রাজনীতিতে সুফিদের ভূমিকা : সুলতানি আমলে বাংলায় সুতিদের আগমন ঘটে। সুফিরা বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সুলতানদের বুদ্ধি পরামর্শ পান করতেন। নিচে সুলতানি আমলে বাংলার রাজনীতিতে সুফিদের ভূমিকা আলোচনা করা হলো-

১. ফখরুদ্দিন মুবারক শাহের রাজত্বকালে সুফিদের ভূমিকা : ১৩৩৮ সালে ফখরুদ্দিন মুবারক শাহ সোনারগাঁওয়ের সিংহাসনে আরোহণ করেন। সিংহাসনে আরোহণ করে তিনি সুফি সাধকদের পৃষ্ঠপোষকতা করে। 

তিনি সুফি সাধকদের বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা প্রদান করতেন। এবং রাষ্ট্রীয় কার্যাদি পরিচালনায় তিনি বুদ্ধি পরামর্শ গ্রহণ করতেন। তার সময়ে সুফিরা বাংলায় প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করে ।

২. ইখতিয়ার উদ্দিন গাজী শাহের রাজত্বকালে সুফিদের ভূমিকা : ফখরুদ্দিন মুবারক শাহের মৃত্যুর পর সিংহাসনে আরোহণ করেন ইখতিয়ার উদ্দিন পাঞ্জী শাহ। তার সময়ে সুফিরা বাংলায় প্রভাব বিস্তার করতে থাকে। 

ইখতিয়ার উদ্দিন গাজী শাহ তার রাজত্বকালে ধর্মীয় কাজ কিংবা রাষ্ট্রীয় কাজ পরিচালনার জন্য সুফিদের উপর নির্ভর করত। 

সুফিদের পরামর্শ নিয়ে তিনি রাষ্ট্রীয় কাজ পরিচালনা করতেন। তিনি সুফিদের এতই প্রিয়ভাজন ছিলেন যে, সমসাময়িক সুফি সাহিত্যে তার নাম পাওয়া যায়।

৩. ইলিয়াস শাহের রাজত্বকালে সুফিদের ভূমিকা : ইলিয়াস শাহ ১৩৪২ সালে শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ উপাধি ধারণ করে সিংহাসনে আরোহণ করেন। তিনি একজন ধার্মিক শাসক ছিলেন। 

তার সময়ে দুই জন বিখ্যাত সুফির আগমন ঘটে। একজন হলো পীর সিরাজউদ্দিন আর অন্যজন শেখ বিরাধানি। এদের | সহযোগিতায় ইলিয়াস শাহ রাজ্য পরিচালনা করতেন। 

তিনি রিফা উদ্দিনের শিষ্য আলাওলের সম্মান রক্ষার্থে একটি মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন। তিনি সুফি সাধকদের অভ্যধিক সম্মান করতেন।

৪. সিকান্দার শাহের রাজত্বকালে সুফিদের ভূমিকা : ইলিয়াস শাহের মৃত্যুর পর সিংহাসনে আরোহণ করেন সিকান্দার শাহ। সিকান্দার শাহ সুফি সাধকদের মতো জীবনযাপন করতেন। 

তিনি রাষ্ট্রীয়, কোনো কাজ সিরাজউদ্দিনের শিষ্য শেখ আলাগুলের পরামর্শ ব্যতীত করতেন না। সুফি সাধকরা সবচেয়ে বেশি অবদান রেখেছিলেন সিকান্দার শাহের রাজত্বকালে।

৫. গিয়াসউদ্দিন আযম শাহের রাজত্বকালে সুফিসের ভূমিকা : গিয়াসউদ্দিন আজম শাহ তার পিতা সিকান্দার শাহের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন এবং যুদ্ধে পিতাকে হত্যা করে সিংহাসনে আরোহণ করেন। 

পিতা ও পিতামহের মতো তিনি সুফিদের অত্যন্ত ভক্তি করতেন। তার রাজত্বকালে সুফিদের মধ্যে শায়খ আল-উল হবের পুত্র ও শিষ্য শায়খ মুর-কুতুব-ই আজম অত্যন্ত প্রসিদ্ধ ছিলেন। 

পিতার মৃত্যুর পর শায়খ নূর কুতুব-ই আজম পাণ্ডুয়ায় খানকাহ স্থাপন করেন এবং বাংলায় সুফিনের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। নূর কুতুব-ই আলমের ভাই আজম খান আজম শাহের উজির ছিলেন। 

আজম শাহ রাষ্ট্রের বিভিন্ন বিষয়ে শায়খ মুর-কুতুব-ই আলমের নিকট পরামর্শ ও উপদেশ নিতেন। মওলানা বলখী চিঠিতে আজম শাহকে ধর্ম বিষয়ে ও শাসন বিষয়ে বিভিন্ন উপদেশ দিতেন ।

৬. রুকুনউদ্দিন বরবক শাহের রাজত্বকালে সুফিদের ভূমিকা : সুলতান মাহমুদের মৃত্যুর পর তার পুত্র রুকুনউদ্দিন বরবক শাহ 'সিংহাসনে আরোহণ করেন। রুকুনউদ্দিন বরবক শাহ একজন ধার্মিক ব্যক্তি ছিলেন। 

তার সময়ে সুফিরা ইসলাম প্রচারে পুর্ণনিয়োগ করত। সুফি সাধকরা ইসলাম প্রচারে জন্য রংপুর জেলার কাঁটাপুরিতে বসতি স্থাপন করেছিল। তাছাড়া তিনি নিজেও একজন দরবেশের মতো জীবন যাপন করতেন।

৭. হোসেন শাহী শাসনামলে সুফিদের প্রভাব : হোসেন শাহী শাসনামলে সুফিরা তেমন কোনো প্রভাব বিস্তার করতে পারেননি। এই শাসনামলে রাজ্য কিছুটা হলেও সুফিদের বিরোধিতা করেছিলেন।

৮. রাজা গণেশের সময়ে সুফিদের ভূমিকা : রাজা গণেশ ছিলেন হিন্দু ধর্মাবলম্বী । রাজা গণেশের সময়ে সুফিদের চরম অত্যাচার ভোগ করতে হয়। 

কিন্তু গণেশের ছেলে সুফিদের দ্বারা এতটাই প্রভাবিত হয়েছিলেন যে, তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। 

রাজাগণেশের পুত্র যদুর সময়ে অনেক সুফির বাংলায় আগমন ঘটে এবং সুফিরা সুলতানকে রাষ্ট্রীয় কাজে পরামর্শ দান করতেন ।

উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, মধ্যযুগে বাংলায় সুফিরা শুধু ইসলাম প্রচার করেন নি বরং রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও এক অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন। তারা সুলতানদের বিভিন্ন রাজনৈতিক বিষয়ে বুদ্ধি পরামর্শ দান করতেন। 

এবং অনেক সময় সামরিক অভিযানেও তাদেরকে উৎসাহ যুগিয়েছিলেন। সুলতানি শাসকদের রাজ্য শাসনের বিষয়ে সুফিরা বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেছিলেন। 

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url
আরও পড়ুনঃ
আরও পড়ুনঃ