সুলতানি আমলে বাংলার ইতিহাসের উপাদান সমূহ আলোচনা কর
সুলতানি আমলে বাংলার ইতিহাসের উপাদান সমূহ আলোচনা কর |
সুলতানি আমলে বাংলার ইতিহাসের উপাদান সমূহ আলোচনা কর
- অথবা, মধ্যযুগের ইতিহাসের উৎস হিসেবে বাংলায় সুলতানি আমলের উপাদানসমূহ আলোচনা
- কর।
- অথবা, সুলতানি শাসনামলে বাংলা ও বাংলা সম্পর্কিত সাহিত্যিক ও ঐতিহাসিক রচনাসমূহের ধারাবাহিক বিবরণ তুলে ধর।
উত্তর : ভূমিকা : ইতিহাসের ঘটনাসমূহকে ধারাবাহিকভাবে আলোচনার জন্য কয়েকটি ভাগে বিভক্ত সময়কালের মধ্যে মধ্যযুগ অন্যতম।
মধ্যযুগে সুলতানি ও মুঘল শাসন বিদ্যমান ছিল। তৎকালীন সময়ের সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় বিষয়ে জানতে হলে সমসাময়িক তথ্য-উপাত্তের উপর নির্ভর করতে হয়।
মধ্যযুগে বাংলায় মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠিত হলে সেখানে আন- বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিক চর্চা ধর্মভিত্তিকভাবে (মুসলিম) হত।মধ্যযুগের সুলতানি শাসনামলে সম্পর্কে বিশেষ তেমন ঐতিহাসিক রচনা নেই।
তবে অন্যান্য উৎস হতে তৎকালীন শাসন সম্পর্কে অনেক মূল্যবান তথ্য জানা যায়। পূর্ববর্তী সভ্যতা, পরবর্তী জাতিকে সম্মুখে অগ্রসরমান হতে সাহায্য করে।
→ মধ্যযুগে সুলতান আমলে বাংলার ইতিহাসের উৎস : প্রাচীনকাল হতে বাংলা ধনসম্পদ ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি। বাংলার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে একাধিক পর্যটক বাংলায় আসেন।
কিন্তু, বাংলার ইতিহাস আলোচনার জন্য নির্ভরযোগ, পর্যাপ্ত, প্রত্যক্ষ ও প্রমাণযোগ্য পাওয়া যায় খুব কম। প্রায় নেই বললে চলে। নিম্নে যা কিছু উপাদান পাওয়া যায় সে সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :
(ক) লিখিত উৎস : লিখিত যে সকল উৎস বা উপাদান পাওয়া যায়, তা পর্যাপ্ত নয়, তথাপি উৎসগুলো আলোকপাত করা হলো-
১. মুসলিম ধর্মাশ্রয়ী সাহিত্য : মুসলিম ধর্মাশ্রয়ী সাহিত্য মধ্যযুগে সুলতানি শাসনামলে বাংলার ইতিহাসের মন্যতম মাধ্যম। বাংলায় মুসলিম শাসন সুপ্রতিষ্ঠিত হলে ধর্মীয় ইতিহাসচর্চা অল্প পরিসরে চালু হয়।
যথা- আমির খসরুর রচনাবলি ঐতিহাসিক তথ্য সমৃদ্ধ ছিল। তার রচিত 'নুহসিপিহর' গ্রন্থে কুতুবউদ্দিন মোবারক শাহের আমলের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক অবস্থা বর্ণনা করা আছে।
এছাড়া, ইসলামি কর্তৃক রচিত ‘ফুতুহ-উস-সালাতিন' গ্রন্থে মধ্যযুগীয় ভারতের মূল্যবান ঘটনাপঞ্জি সম্পর্কে জানা যায়।
২. আরবি ও ফার্সি গ্রন্থ : সুলতানি আমলের ইতিহাস জানার জন্য আরবি ও ফার্সি ভাষায় লিখিত গ্রন্থের অবদান অসীম। যেমন : উত্তী কর্তৃক রচিত, গ্রন্থ 'তারিখ-ই-ইয়ামিনী'-তে গজনী সুলতানদের শাসন সম্পর্কে হালকা বর্ণনা আছে।
আবুল ফজল বাইহাকী কর্তৃক রচিত 'তারিখ-ই-আল-ই-সৰুক্তিগীন' পুস্তকটির খণ্ড বিশেষ ‘তারিখ-ই-বাইহাকী'-তে গজনী কেন্দ্রীয় সরকারের শাসনব্যবস্থার কিছুটা বিবরণ দেওয়া আছে।
জিয়াউদ্দিন বারানীর লেখা গ্রন্থ 'তারিখ-ই-ফিরোজশাহী" থেকেও কিছু তথ্য পাওয়া যায়। ইয়াহিয়া বিন আহমদ আস সরহিন্দীর রচিত 'তারিখ-ই- মোবারকশাহী” থেকে সুলতানদের শাসনামল (১৪৩৪ খ্রিঃ পর্যন্ত) সম্পর্কে বিবরণ পাওয় যায়।
৩. রাজনৈতিক ও আইনসংক্রান্ত পুস্তক : সুলতান শাসনামলের রাজনৈতিক ও আইনসংক্রান্ত পুস্তকগুলো মুসলিম শাসনব্যবস্থার ইতিহাসের প্রয়োজনীয় পটভূমি সৃষ্টি করেছে। “হিন্দায়াহ' ও 'ওয়াকেয়াহ' বিখ্যাত আইন গ্রন্থ।
ফকরউদ্দিন মুবারক শাহ রচিত পুস্তক 'আনব-উল মুলুক ওয়া কিফায়াত উল- মালুক ও হাজী আব্দুল হামিদ মুহারবির গজনভী রচিত 'দন্তরুল- আলবাব ফি ইলম ইল- হিসাব' পুস্তরে সমসাময়িক রাজনৈতিক, সামরিক অবস্থা ও সরকারের প্রশাসনিক কাঠামোর চিত্র চমৎকারভাবে অঙ্কিত হয়েছে।
বিদেশি লেখক ও ঐতিহাসিক এডওয়ার্ড টমাস ও এইচ লেনসন রাইটের পুস্তক ও তৎকালীন রাজনৈতিক ও আইন সংক্রান্ত বিষয়ে লেখা আছে।
৪. বিদেশি পর্যটকদের বিবরণ : সুলতানি শাসনামলে বিদেশি পর্যটকদের মধ্যে ইবনে বতুতা উল্লেখযোগ্য ছিলেন। তিনি ১৩৩৩ সালে ভারতে এসে মোট নয় বছর ছিলেন।
এসময় তিনি বাংলা পর্যটং করেন। তার পরিপ্রেক্ষিতে তিনি 'তুহফাত-উন-নূজ্জার যি-গরাইবাল-ই-আল-আমসার' নামক একটি বৃহৎ গ্রন্থ রচনা করেন।
এ গ্রন্থে সুলতানি আমলের শাসনব্যবস্থা, সামাজিক জীবন ও রাজদরবারের চমৎকার বর্ণনা দেন। এছাড়া ইবনে ফজল উলাহ আল উমারি ‘মাসালিক-উল-আবসার ফি-মুমালিক-আল-আমসার' গ্রন্থটির রচনা করেন। যেখানে, বিভিন্ন পর্যটকের তথ্য রয়েছে।
৫. সরকারি দলিলপত্র : ইতিহাসের উৎস হিসেবে দলিলপত্র গুরুত্বপূর্ণ একটি মাধ্যম। অথচ, সুলতানি শাসকগণ তাদের শাসনামলের কোনো মূল্যবান দলিল-পত্র সংরক্ষণ করেননি।
তবে সমকালীন বাংলার শাসকদের বিভিন্ন রাজার সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্র ধরে যে দলিল-পত্র পাওয়া যায় তার উপর নির্ভর করে ইতিহাস রচনা করা হয়। সুলতানি শাসনামলের পরবর্তী সময় হতে দলিল-পত্র সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়।
(খ) অলিখিত উৎস : সুলতানি আমলে বাংলায় লিখিত উৎসের অপর্যাপ্ততার জন্য অলিখিত উৎসের উপর অনেকটা নির্ভর করতে হয়। অলিখিত উৎসগুলো নিম্নে দেওয়া হলো :
১. শিলালিপি : শিলালিপি হচ্ছে পাথর বা শিলাখণ্ডে উৎকীর্ণ বিভিন্ন বাণী বা তথ্য। এসকল শিলালিপি আবিষ্কারের পর বিভিন্ন ঘটনার তারিখ, রাজ্যের সীমানা, শাসকের রাজ্য জয় সম্পর্কে জানা ড. যদুনাথ সরকার বলেছেন, “বঙ্গ দেশে মুসলিম শাসনামলের সামান্য কয়েকটি শিলালিপি পাওয়া গেছে।
এগুলো মসজিদ ও সমাধিগাত্রে আরবি ও ফার্সি ভাষায় লিখিত। এসব শিলালিপি থেকে বিভিন্ন রাজার রাজ্যের সীমানা, রাজ্য জয় ও পরলোকগত ব্যক্তির জন্ম ও মৃত্যুর সাল, তারিখ জানা যায়।”
২. মুদ্রা : যেসকল তথ্য অন্য কোন উপাদান থেকে পাওয়া যায় না, মুদ্রা থেকে সেইসকল তথ্য পাওয়া যায়। প্রাপ্ত মুদ্রা। থেকে সমকালীন বাংলার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অবস্থার চিত্র পাওয়া যায়।
আবার অর্থনৈতিক উন্নতি সম্পর্কেও জানা যায়। সমকালীন সুলতানগণ সিংহাসনে আরোহণ করেই সুলতানদের নাম ও তারিখ সংবলিত মুদ্রা জারি করতেন।
মুদ্রা থেকে টাকশালের নামও পাওয়া যায়। প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণার মাধ্যমে ২৬ জন শাসকের নামাঙ্কিত মুদ্রা পাওয়া গেছে। এগুলো ইতিহাস রচনায় নির্ভরযোগ্য তথ্য প্রদান করে ।
৩. স্মৃতিস্তম্ভ ও অট্টালিকা : বাংলায় মুসলিম শাসনামলে একাধিক অট্টালিকা ও সৌধ নির্মিত হতো। এগুলো মুসলিম কৃষ্টির পরিচয় বহন করে।
সৌধ ও অট্টালিকা নির্মাতাদের নাম ও তারিখ আছে । যা সমকালীন বাংলার সমাজ ও সাংস্কৃতির পরিচয় বহন করে ।
৪. ইতিহাসের উৎসের প্রসার : ভারতীয় মুসলিম ও অমুসলিম ঐতিহাসিকদের লেখা গ্রন্থের মধ্যে অনেক গ্রন্থ (আরবি ও ফার্সি) ইংরেজিতে অনুবাদ করা হয়। এভাবে সমসাময়িক সময়ে রচিত ঐতিহাসিক গ্রন্থসমূহ প্রসার বা বিস্তৃতি লাভ করে।
উপসংহার : উপরিউক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে একথা বলা যায় যে, মধ্যযুগে বাংলার ইতিহাস রচনার তথ্যের সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও উপর্যুক্ত উপকরণ থেকে যে তথ্য পাওয়া যায় তা একটি শাসনকালের ইতিহাস রচনার জন্য পর্যাপ্ত বলা যায় না।
তবে তুলনামূলকভাবে বাংলার ইতিহাস জানা যায় যথেষ্ট পরিমাণে। বাংলার ইতিহাস জানার জন্য আমরা 'লিখিত উৎস ও অলিখিত উৎস' এই দুই উৎসের উপর নির্ভর করে সুলতানি আমলে বাংলার নির্ভরযোগ্য তথ্য পাই।
একটি উৎস বাদ দিয়ে অন্য একটিকে নিয়ে ইতিহাস রচনা সম্ভব নয় এবং তা নির্ভরযোগ্য, তথ্যসমৃদ্ধ ও গ্রহণযোগ্য হবে না। তাই ইতিহাস রচনায় লিখিত ও অলিখিত দুটি উৎসের উপরই সমান গুরুত্ব দিতে হবে ও নির্ভর করতে হবে।